ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিপক্ষে বাম নেতারা
১২ অক্টোবর ২০২০ ২১:০৭
ঢাকা: দেশব্যাপী ধর্ষণ ও নারী নির্যাতন-নিপীড়নের বিরুদ্ধে আন্দোলনের মুখে ধর্ষণের সাজা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড থেকে বাড়িয়ে মৃত্যুদণ্ড রেখে আইনের সংশোধনীর খসড়ায় অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা। আগামীকাল মঙ্গলবার (১৩ অক্টোবর) এই সংশোধনী কার্যকর করতে অধ্যাদেশ জারি হবে। তবে আইনের এই সংশোধনীর বিপক্ষে মত দিয়েছেন বাম ছাত্রনেতারা। তারা বলছেন, ধর্ষণের বিরুদ্ধে আন্দোলন করলেও তারা এই অপরাধের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড করার দাবি তোলেননি। বরং আইনের কার্যকর প্রয়োগ ও বিচার প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রিতা দূর করে ধর্ষণের শিকার ব্যক্তির দ্রুত বিচারপ্রাপ্তি নিশ্চিত করার দাবি জানিয়েছিলেন। কেননা, আইন যাই হোক, তার সঠিক প্রয়োগ না ঘটলে ওই আইন অর্থহীন হয়ে পড়বে।
ছাত্রনেতারা আশঙ্কা করছেন, ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড করা হলে ধর্ষণের শিকার নারীকে হত্যা করার প্রবণতা বাড়তে পারে। একইসঙ্গে ধর্ষণের শিকার নারীকে গুম করে দেওয়ার ঘটনাও বাড়তে পারে। শুধু তাই নয়, প্রতিপক্ষকে ফাঁসিয়ে দিতে ধর্ষণের মতো বিকৃত বিষয়কেও পূঁজি করা হতে পারে বলে আশঙ্কা তাদের।
দেশে নারী ও শিশু নির্যাতন আইন অনুযায়ী ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি ছিল যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড এবং এর সঙ্গে অর্থদণ্ড। গত ২৫ সেপ্টেম্বর সিলেটের মুরারীচাঁদ (এমসি) কলেজে স্বামীকে আটকে রেখে স্ত্রীকে দলবেঁধে ধর্ষণ এবং নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে এক নারীকে বিবস্ত্র করে বর্বরোচিত নিপীড়নের ভিডিও গত ৪ অক্টোবর ভাইরাল হওয়াসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় একের পর এক নারী ও শিশু ধর্ষণের ঘটনা ঘটলে দেশব্যাপী ধর্ষণ ও নারীর প্রতি সহিংসতাবিরোধী আন্দোলন ছড়িয়ে পড়তে থাকে। এসব আন্দোলন থেকে কেউ কেউ ধর্ষণের সাজা বাড়িয়ে মৃত্যুদণ্ডের দাবি তোলেন।
এ পরিস্থিতিতে সোমবার (১২ অক্টোবর) মন্ত্রিসভার বৈঠকে ধর্ষণের সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ড রেখে নারী ও শিশু নির্যাতন আইনের সংশোধনীর খসড়ায় অনুমোদন দেওয়া হয়। এখনই সংসদের কোনো অধিবেশন না থাকায় এই সংশোধনী অবিলম্বে কার্যকর করতে আগামীকাল মঙ্গলবার অধ্যাদেশ জারি করা হবে বলে মন্ত্রিসভার বৈঠক শেষে জানিয়েছেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম।
ধর্ষণের সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ডের বিরোধিতা করে যুব ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক বাম ছাত্রনেতা খান আসাদুজ্জামান মাসুম সারাবাংলাকে বলেন, ‘ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড করা হলে তার অপব্যবহার ঘটবে। কারণ আমরা এখন পর্যন্ত যা দেখছি, নারী নির্যাতনের মামলার অপব্যবহার সবচেয়ে বেশি ঘটছে। এক্ষেত্রে মৃত্যুদণ্ডের বিধান করা হলে একটি পক্ষের মধ্যে অন্যকে ঘায়েল করার মনোবৃত্তি তৈরি হবে। এছাড়া এখন যে ক্রয়ফায়ার হচ্ছে, মৃত্যুদণ্ডের বিধান সেটাকেও বৈধতা দেবে।’
তিনি বলেন, “আমরা যেমন ধর্ষণের বিচার চাই, তেমনি আর যেন কোনো ধর্ষক গড়ে না ওঠে, সেটাও চাই। ধর্ষণের যথাযথ বিচার বা আইন হওয়া উচিত। এর মানে এই নয় যে ফাঁসি হতে হবে। এই আইন হলে যাকে ধর্ষণ করা হলো, তাকে হত্যাও করা হবে। আলামতকে নস্যাৎ করে দেওয়ার জন্য ভিকটিমকে খুন করার প্রবণতা তৈরি হবে। আমাদের আন্দোলন থেকে ধর্ষণের শাস্তি চাওয়া হয়েছে, অতি উৎসাহী কেউ কেউ হয়তো বলেছে ‘ফাঁসি, ফাঁসি, ফাঁসি চাই’। কিন্তু আমরা দায়িত্বশীল কেউ মৃত্যুদণ্ডের পক্ষে নই।”
গণসংহতি আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সংগঠক ও ছাত্র ফেডারেশনের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি সৈকত মল্লিক সারাবাংলাকে বলেন, ‘ধর্ষণের শাস্তির মাত্রা বাড়ালেই ধর্ষণ কমে যাবে না, বরং সহিংসতা আরও তীব্র হবে। ধর্ষণ পরবর্তী খুন বেড়ে যাবে। গুণ্ডাতন্ত্রই পুষ্ট হবে।’
তিনি বলেন, অনেক ক্ষেত্রে পরিবারের সদস্য, পূর্ব-পরিচিতরাও ধর্ষণ করে। সেক্ষেত্রে মৃত্যুদণ্ডের কথা চিন্তা করে সেটা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা আরও বেশি হবে। ধর্ষণের শিকার ব্যক্তি নিজেই যেহেতু সবচেয়ে বড় সাক্ষী, ফলে তাকে হত্যা করে সাক্ষী না রাখার প্রবণতাও আশঙ্কাজনক হারে বাড়বে। বর্তমান আইনে ধর্ষণের শাস্তি যাবজ্জীবন হওয়ার পরও মাত্র ৩ শতাংশ ঘটনার বিচার হয়, সেখানে মৃত্যুদণ্ডের বিধান হলে তা আরও কমে যেতে পারে। ফলে আগে চলমান আইনেই শতভাগ বিচার নিশ্চিত করা জরুরি। ধর্ষকদের মদতদাতাদেরও বিচারের আওতায় আনা প্রয়োজন। আর আর ২০২০ সালে এসে শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ড কতটা যৌক্তিক, সেটা ভাবার সময় এসেছে।
ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি মেহেদি হাসান নোবেল সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা মনে করি মৃত্যুদণ্ড দিয়ে ধর্ষণের সংস্কৃতি দূর করা যাবে না। আগে যে আইন ছিল, মেয়াদ ছিল, তারই প্রয়োগ হচ্ছে না। দীর্ঘসূত্রিতায় বিচার আটকে যাচ্ছে। আইনের যথাযথ প্রয়োগ হচ্ছে না। এর জন্যে আমরা মনে করি নারীর প্রতি রাষ্ট্রের যে দৃষ্টিভঙ্গি, তার পরিবর্তন ঘটাতে হবে।’
একই সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক অনিক রায় সারাবাংলাকে বলেন, ‘আইন দিয়ে কোনো অপরাধ দমন করা সম্ভব নয়। এখানে লম্বা সময় ধরে বিচার প্রক্রিয়া চলে, বিচারহীনতার সংস্কৃতি রয়েছে। ব্রিটিশ আমলের আইনের কেবল একটি ধারার পরিবর্তন আনলে ধর্ষণ থেমে যাবে না। ধর্ষণের শাস্তি সর্বোচ্চ করে দিলে ধর্ষণের শিকার নারীকে হত্যা বা গুম করে দেওয়ার প্রবণতা তৈরি হতে পারে। ক্যাপিটাল পানিশমেন্ট দিলে আলামত ধ্বংস করার প্রবণতা তৈরি হবে। তাই আমরা বলতে চাই, প্রশাসনকে তার ব্যর্থতা স্বীকার করতে হবে। একইসঙ্গে নিরাপত্তা দিতে না পারার কারণে আমরা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর অপসরণ চাই।’
সামজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের সাধারণ সম্পাদক নাসির উদ্দিন প্রিন্স সারাবাংলাকে বলেন, ‘ধর্ষণের শাস্তি তো আগেই যাবজ্জীবন ছিল। কিন্তু এখন পর্যন্ত রুজু হওয়া মামলার মাত্র ৩ শতাংশের বিচার হয়েছে। এখনো ১৮০০ আসামি কনডেম সেলে রয়েছেন। বিচার হচ্ছে না। আমরা ভিকটিমকে সুরক্ষা দিতে পারছি না। কিন্তু যদি ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড করা হয়, তবে এই আইন অপব্যবহারের সুযোগ তৈরি হবে। আমরা বলতে চাই, বিচার প্রক্রিয়াকে স্বচ্ছ এবং দ্রুত করতে হবে।’
বর্ষীয়ান বাম নেতা জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) সভাপতি হাসানুল হক ইনু অবশ্য ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের পক্ষে রয়েছেন। সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘ধর্ষণ একটি জঘন্য অপরাধ। এর সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদপণ্ডের পক্ষে আমি। আমার মত হচ্ছে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখে তা ৯০ দিনে কার্যকর করা উচিত।’
আর ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন সারাবাংলাকে বলেন, ‘ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি হওয়া উচিত। তবে প্রয়োগ ছাড়া এই আইন অর্থহীন হয়ে যাবে। আর আইন করলেই ধর্ষণ কমে যাবে, আমার তা মনে হয় না। আইন যাই হোক, তার প্রয়োগ করতে হবে।’
এদিকে, ধর্ষকের সর্বোচ্চ শাস্তি ফাঁসির পক্ষে নন সব সাধারণ শিক্ষার্থীরাও। রোববার (১২ অক্টোবর) বাংলাদেশ ক্রাইম রিপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে কয়েকজন শিক্ষার্থী তাদের এই অবস্থান তুলে ধরেন।
সংবাদ সম্মেলনে ভিকারুননিসা নূন কলেজের চৌধুরী নদী ও তাসফিয়া তারান্নাম রিদিতা, গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি কলেজের শিক্ষার্থী ইসরাত জাহিন আহমেদ এবং ব্রিটিশ কাউন্সিলের সাদিয়া আরাফাত সুচিতাসহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সাবেক ও বর্তমান শিক্ষার্থীরা অংশগ্রহণ করেন। তারা ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের পরিবর্তে আমৃত্যু কারাদণ্ড করার পক্ষে অবস্থানের কথা জানিয়ে সাত দফা দাবি তুলে ধরেন।
সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের উত্তরে শিক্ষার্থী তানহা তানজিন বলেন, ‘একজনকে ফাঁসি দিলেই কি এ দেশে ধর্ষণ বন্ধ হবে? ধর্ষণ তখনও বন্ধ হবে না। বরং এটা হতে পারে যে, ধর্ষক যখন মনে করবে আমার তো ফাঁসি হয়ে যাবে, তখন মেরেই ফেলি। এটা হিতে বিপরীত হবে। তাই আমরা আমৃত্যু যাবজ্জীবন চাই।’
তবে মন্ত্রিসভার বৈঠকের পর এক সংবাদ সম্মেলনে আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলেন, ‘আমরা নিশ্চয় বিশ্বাস করি, ধর্ষণের সাজা যাবজ্জীবন থেকে মৃত্যুদণ্ড করায় এই অপরাধ কমে আসবে। না হলে সাজা বাড়ানোর প্রশ্নে আসতাম না।’
একই মত দিয়েছেন মহিলা ও শিশু বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী ফজিলাতুন নেসা ইন্দিরাও। তিনি বলেন, আমি বিশ্বাস করি— নতুন যে সংশোধনী আনা হয়েছে, সেটি কাজ করবে। বিচারের যে দীর্ঘ প্রক্রিয়াটা, সেটাও কমে আসবে বলে আশা করছি।
গণসংহতি আন্দোলন ছাত্র ইউনিয়ন ছাত্র ফেডারেশন ধর্ষণ ধর্ষণের সর্বোচ্চ সাজা ধর্ষণের সাজা নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন বাম ছাত্রনেতা মন্ত্রিসভা মন্ত্রিসভার বৈঠক মৃত্যুদণ্ড সামজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট