‘আইন সবকিছু নয়, ধর্ষণের প্রেক্ষাপট শোধরানোর ব্যবস্থা নিতে হবে’
১২ অক্টোবর ২০২০ ২৩:৪৩
ঢাকা: ধর্ষণের ঘটনায় আইন দিয়েই সবকিছু করা সম্ভব নয়। এ ধরনের ঘটনা প্রতিরোধে সময়োপযোগী আইন যেমন প্রয়োজন, তেমনি প্রয়োজন আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে প্রভাবমুক্ত থেকে স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ করে দেওয়া। এর পাশাপাশি অনেক বেশি প্রয়োজন নৈতিকতার চর্চা। ধর্ষণের যে প্রেক্ষাপট রয়েছে, সেটি শোধরাতে হবে। সার্বিকভাবে নারীর প্রতি সহিংস আচরণের যে দৃষ্টিভঙ্গি, সেটিতে পরিবর্তন আনতে হবে। আর আইন ও নৈতিকতার বাইরেও রয়েছে সংবেদনশীলতা। মানুষের মাঝে সংবেদনশীলতা জাগিয়ে তুলতে হবে।
সোমবার (১২ অক্টোবর) সারাবাংলা ডটনেটের নিয়মিত আয়োজন ‘সারাবাংলা ফোকাস’ অনুষ্ঠানে যুক্ত হয়ে অতিথিরা এসব কথা বলেন। ‘নারী নির্যাতন এবং আমরা’ শীর্ষক এই অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে যুক্ত ছিলেন চিকিৎসা বিজ্ঞানী, শিক্ষাবিদ ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠক অধ্যাপক ডা. লিয়াকত আলি, সমতা সাইকোথেরাপিস্ট ও ‘প্রেরনা’র সাধারণ সম্পাদক রেজিনা পারভীন এবং সিনিয়র কাউন্সিলিং সাইকোলজিস্ট নাঈমা হক। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন সারাবাংলা ডটনেটের স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট এমএকে জিলানী।
আলোচনায় অধ্যাপক ডা. লিয়াকত আলি বলেন, আইন দিয়ে সবকিছু সমাধান করা যায় না। সঙ্গে নৈতিকতার চর্চাও থাকতে হয়। তার সঙ্গে আরেকটি বিষয় প্রয়োজন— সংবেদনশীলতা। অন্যদিকে কোনো রাজনৈতিক দল যখন ক্ষমতায় যায়, তখন তারা তাদের মতো করে ঘনঘন পাঠ্যপুস্তক বদলায়। ফলে একজন শিক্ষার্থী কী শিখবে, সেটি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পাল্টে যায়। আবার সমাজে ‘রোল মডেল’ কারা, সেটি কিন্তু একটি জনগোষ্ঠীকে সার্বিকভাবে প্রভাবিত করে। এসব বিষয় নিয়ে আমাদের কাজ করতে হবে। দৃষ্টিভঙ্গিটাকে প্রসারিত করতে হবে।
তিনি বলেন, করোনাকালে নারী নিযার্তন ও ধর্ষণ আরেক মহামারি আকারে হাজির হয়েছে। এটি হয়তো আমাদের মধ্যে আগে থেকেই ছিল। আসলে কোনো একটি মহামারি যখন আসে, সেটি অন্তর্নিহিত অন্য মহামারিকে প্রভাবিত করে বাইরে নিয়ে আসতে পারে। এ ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। আজ তাই সভ্যতাসহ সবকিছু ভীষণ প্রশ্নের মুখে পড়েছে। আধুনিক প্রযুক্তি হাতের মুঠোয় থাকলেই যে আমরা সভ্য হয়ে গেছি, তা কিন্তু নয়। হৃদয়ের সংবেদনশীলতা প্রয়োজন। সেটির জন্য কাজ করা প্রয়োজন।
ডা. লিয়াকত বলেন, সংসদ আইন প্রণয়ন করে, বাস্তবায়ন করে না। বাস্তবায়ন করে বিচার বিভাগ। সেখানে কোনো ধরনের প্রভাব বিস্তার হলে স্বাধীনভাবে আইন বাস্তবায়ন সম্ভব হয় না। এটা দিনশেষে রাজনীতির খেলা। আমরা যদি রাজনীতিতে শুদ্ধতা না আনি, আর জনগনের আস্থা না থাকে, তাহলে কোনোদিনই এগুলোর সহজ সমাধান হবে না।
এই বিজ্ঞানী আরও বলেন, রাষ্ট্রীয় পুরষ্কার এমন মানুষ পাচ্ছেন, যারা হয়তো নারীবান্ধব নন। কিংবা কখনো নারীদের নিয়ে কাজই করেননি। অন্যদিকে টেকনোলজি মনিটরিং আমাদের এখানে নেই। শিল্প-সংস্কৃতির চর্চা কমে গেছে। ফলে নির্দিষ্ট একটি বা দু’টি বিষয়ে মনোযোগ দিলে হবে না। সার্বিক দিক বিবেচনা করে সেভাবে পদক্ষেপ নিতে হবে। আমি আবারও বলব— করোনার মতো নারী নিপীড়নের এই মহামারি থেকেও মুক্তি পেতে হলে আমাদের চিকিৎসা যেমন প্রয়োজন, তেমনি প্রয়োজন প্রতিষেধক বা ভ্যাকসিন। তার জন্য সমন্বিত পদক্ষেপ দরকার। আইন, নৈতিকতা ও সংবেদনশীলতা— তিনটির মধ্যে যেন ব্যালেন্স থাকে, সেটি নিশ্চিত করতে হবে।
রেজিনা পারভীন বলেন, নৈতিকতার যে জায়গাটা আমাদের ছিল, সেই জায়গায় কিন্তু আমরা নেই। আমার কর্মজীবন ২৪ বছরের। আমার নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, এই সময়ের মধ্যে নৈতিকতার স্খলন হয়েছে। একটি শিশুর সুস্থভাবে গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে সুস্থ পরিবেশ, বিনোদন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সেই বিনোদনের মাধ্যম যদি হয় পর্নোগ্রাফি, তাহলে নৈতিকতার সেই জায়গাটি অত্যন্ত দুর্বল হয়ে যায়।
তিনি বলেন, একজন পুরুষের সবচেয়ে বড় জায়গা হলো সে নিজেকের ক্ষমতাশালী মনে করে। ফলে নারী তার কাছে দুর্বল। সেখান থেকে তার মধ্যে শক্তি ও ক্ষমতার প্রয়োগের জায়গাটি তৈরি হয়। সেটি এই করোনার মধ্যে আরও অনেক বেড়েছে। আমরা অনলাইনে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা দিয়ে থাকি। আমরা কেবল সেপ্টেম্বর মাসেই নারী সহিংসতার শিকার ১০৯ জনকে সেবা দিয়েছি। এর মধ্যে কেবল সমাজের প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষ নেই। বরং এর মধ্যে উচ্চ মধ্যবিত্ত বা উচ্চবিত্ত পরিবারের নারীর সংখ্যাই বেশি। সম্মানজনক চাকরি করেন— এমন অনেক নারী নির্যাতন-সহিংসতার শিকার হয়েছেন। এমন অনেকেই আবার তথাকথিত সম্মানের কারণে বিচারও চাইতে পারেন না।
রেজিনা পারভীন বলেন, সব মিলিয়ে যেটি বলতে চাই— ধর্ষণ বা নারী নির্যাতনের যে প্রেক্ষাপট, সেটিতে বদলাতে হবে। আর সেটি করার জন্য অনেক অনেক আইন প্রণয়ন বা সংশোধন করতে হবে। একইসঙ্গে মানসিকভাবে নির্যাতনের শিকার নারীরা যেন আইনের আশ্রয় নিতে পারেন, সেই সুযোগ তৈরি করতে হবে। আমরা যেন নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবাইকে মানুষ হিসেবে সম্মান করতে পারি।
নাঈমা হক বলেন, নিযার্তন শারীরিক ও মানসিক— দুইভাবেই হচ্ছে। শিক্ষিত সমাজে এ ধরনের নির্যাতন অহরহ ঘটছে। এর পেছনে রয়েছে পারিবারিক মূল্যবোধ ও নৈতিকতার অবক্ষয়। আবার পুরুষতান্ত্রিক সমাজের ক্ষমতা প্রদর্শনের যে প্রবণতা, সেটি অন্যতম মূল কারণ। এখন যে বিষয়টি চলে এসেছে, নারীদের নির্যাতন করতে গিয়ে সর্বোচ্চ প্রতিশোধ প্রবণতা হিসেবে ধর্ষণ সামনে চলে এসেছে।
তিনি বলেন, নারীদের মানসিক নির্যাতনের শিকার হওয়ার বিষয়টিকে আমাদের দেশে খুব বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয় না। এগুলোকে অত্যন্ত ছোটখাটো অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। অথচ নির্যাতনের শিকার সেই নারীই জানেন, তাকে কী ধরনের পরিস্থিতির মধ্যে থাকতে হচ্ছে। এই যে করোনা সংক্রমণের সময় আমরা শারীরিক স্বাস্থ্য নিয়ে অনেক চিন্তিত, কিন্তু মানসিক স্বাস্থ্যের দিকটি অবহেলিত। বরং এই করোনার সময়েও পরিবারের মধ্যেই নারীকে মানসিক নির্যাতন ও সহিংসতার শিকার হতে হচ্ছে।
নাঈমা হক আরও বলেন, মেয়েদের সহ্য করার বিষয় যেটি আমরা ছোটবেলা থেকে শিখিয়ে আসছি, সেটিতে পরিবর্তন আনতে হবে। এ ক্ষেত্রে মেয়েদের প্রতিবাদ করার শিক্ষাটি দিতে হবে। পাশাপাশি আমরা যে যত কথাই বলি না কেন, নিজের মাইন্ডসেটটি পরিবর্তন করতে হবে। পাশাপাশি আমি আরও বলব, আইনটা যেন আরও শক্তিশালী হয়। আইনের প্রয়োগ যত ভালো হবে, এ ধরনের নিযার্তন তত কমে যাবে।
ডা. লিয়াকত আলি ধর্ষণ নাঈমা হক নারী নির্যাতন নারীর প্রতি সহিংসতা রেজিনা পারভীন সারাবাংলা ফোকাস