বাংলাদেশ কি ‘হার্ড ইমিউনিটি’ অর্জনের পথে?
১৩ অক্টোবর ২০২০ ১৪:২৫
ঢাকা: রাজধানী ঢাকার ৪৫ শতাংশ মানুষের শরীরে নভেল করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) অ্যান্টিবডি পজিটিভ পাওয়া গেছে। বস্তি অঞ্চলে এই হার আরও বেশি— প্রায় ৭৪ শতাংশ। রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর) এবং আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশ (আইসিডিডিআর,বি)-এর এক যৌথ জরিপে এ তথ্য উঠে এসেছে। বস্তিতে প্রায় তিন-চতুর্থাংশ এবং বস্তির বাইরে রাজধানীর অধিবাসী প্রায় অর্ধেক মানুষের শরীরে করোনাভাইরাসের অ্যান্টিবডির এই উপস্থিতিতে প্রশ্ন উঠেছে, বাংলাদেশ কি তাহলে করোনাভাইরাসের ‘হার্ড ইমিউনিটি’ অর্জনের পথে রয়েছে?
গবেষণা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গবেষণায় পাওয়া এই সেরোপজিটিভিটি তথ্য ‘হার্ড ইমিউনিটি’র ক্ষেত্রে যথেষ্ট উৎসাহব্যঞ্জক। তবে সেরোপজিটিভিটির এই মাত্রা কমিউনিটি পর্যায়ের সংক্রমণ প্রতিরোধ ক্ষমতা রোধে কতটুকু সক্ষম হবে, সেটি বুঝতে আরও গবেষণা করতে হবে। বিশেষজ্ঞরাও বলছেন, এই তথ্য দিয়ে ‘হার্ড ইমিউনিটি’ অর্জিত হয়েছে কি না, সেটি বলার সুযোগ এখনই নেই। ‘হার্ড ইমিউনিটি’ বিষয়ে সুনির্দিষ্টভাবে কিছু বলতে হলে আরও বিস্তৃত পরিসরে গবেষণা চালাতে হবে।
সোমবার (১২ অক্টোবর) বিকেলে ঢাকায় কোভিড-১৯-এর সংক্রমণ পরিস্থিতি ও জিন রূপান্তর বিষয়ে রাজধানীর হোটেল লেকশোরে অনুষ্ঠিত এক সেমিনারে আইইডিসিআর ও আইসিডিডিআর,বি’র যৌথ জরিপের তথ্য প্রকাশ করা হয়। এই জরিপে সহায়তা দিয়েছে ইউএসএইড।
সেমিনারে জানানো হয়, গবেষণায় ঢাকা উত্তর ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ১২৯টি ওয়ার্ডের মধ্য থেকে দৈবচয়ন ভিত্তিতে ২৫টি ওয়ার্ড বেছে নেওয়া হয়। প্রতি ওয়ার্ড থেকে বাছাই করা হয় একটি মহল্লা। প্রতি মহল্লা থেকে ১২০টি খানা জরিপে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এ ছাড়া আটটি বস্তিকে এ জরিপে যুক্ত করা হয়। ঢাকা শহরের সাধারণ খানার নমুনা সংগ্রহ করা হয় মধ্য এপ্রিল থেকে মধ্য জুলাই পর্যন্ত। আর বস্তির মানুষের নমুনা সংগ্রহ করা হয় মধ্য জুলাই থেকে আগস্টের শেষ পর্যন্ত।
গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্য
ঢাকার ২৫টি ওয়ার্ডে ১২ হাজার ৬৯৯ জনের নমুনা পরীক্ষা করা হয় জরিপের আওতায়। এসব নমুনায় ৯ দশমিক ৮ শতাংশে করোনা পজিটিভ পাওয়া গেছে। বস্তিতে বসবাসকারীদের মধ্যে এ হার ছিল ৫ দশমিক ৭ শতাংশ।
জিনগত সংক্রামক রোগ বিস্তার নিয়ে পরিচালিত গবেষণার তথ্য তুলে ধরে বলা হয়, দেশে সার্স কোভ-২ তথা করোনাভাইরাসের ১৯টি ভিন্ন ধরন বা বংশক্রম শনাক্ত করা গেছে। এর মধ্যে বাংলাদেশে ভাইরাসটির অভিযোজিত প্রধান তিনটি স্থানীয় সংস্করণ হচ্ছে— বি .১.১, বি .১.২.২৫ ও বি.১.৩৬। এর মধ্যে প্রথম দুইটি বংশ-বৈশিষ্ট্যের ভাইরাস সারাদেশের আটটি বিভাগেই ছড়িয়েছে। অন্যদিকে শেষটির বিস্তৃতি চট্টগ্রাম বিভাগে সীমাবদ্ধ ছিল।
জরিপে অংশ নেওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার লক্ষণ-উপসর্গ পাওয়া গেছে মাত্র ছয় শতাংশের মধ্যে, মৃদু লক্ষণ ছিল ১২ শতাংশের। এর বাইরে ৮২ শতাংশেরই কোনো লক্ষণ-উপসর্গ ছিল না। আবার লক্ষণযুক্ত এই রোগীদের মধ্যে ১৫ শতাংশকে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিতে হয়েছে।
ঢাকায় ৪৫% মানুষের করোনা অ্যান্টিবডি পজিটিভ, বস্তিতে ৭৪%
গবেষণা চলাকালে রাজধানী ঢাকার ৩ হাজার ২২৭টি পরিবারের ৫৩৩ জন উপসর্গযুক্ত এবং ৮১৭ জন উপসর্গহীন আক্রান্তের দেহে IgM ও IgG অ্যান্টিবডি টেস্ট করা হয়। একইসঙ্গে বস্তিতে বসবাসকারী ৯৬০টি পরিবারের ৯৬ জন উপসর্গযুক্ত এবং ৩১৪ জন উপসর্গহীন আক্রান্তদের দেহেও IgM ও IgG অ্যান্টিবডি গড়ে উঠছে কি না— তা পরীক্ষা করে দেখেন দেশের বিজ্ঞানীরা। পরীক্ষায় বস্তি এলাকায় ৭৪ শতাংশ ও বস্তির বাইরে ঢাকা শহরে ৪৫ শতাংশ মানুষের শরীরে অ্যান্টিবডির উপস্থিতি পাওয়া গেছে।
অ্যান্টিবডির এই তথ্য প্রকাশ পাওয়ার পর অনেকেই বিষয়টিকে ‘হার্ড ইমিসনিটি’র পথে একধাপ এগিয়ে যাওয়ার ইঙ্গিত দেখছেন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে কি বাংলাদেশ ‘হার্ড ইমিউনিটি’ অর্জনের পথে রয়েছে?
‘হার্ড ইমিউনিটি’ কী?
যখন কোনো জনগোষ্ঠীর বেশিরভাগ সদস্যের মধ্যে নির্দিষ্ট কোনো সংক্রামক রোগে আক্রান্ত হওয়ার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে ওঠে, তখন বাকি সদস্যদের মধ্যেও ওই সংক্রামক রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কমে যায়। এ পরিস্থিতিকেই বলা হয় ‘হার্ড ইমিউনিটি’ (Herd immunity)। প্রকৃতপক্ষে বেশিরভাগ জনগোষ্ঠীর মধ্যে ওই রোগের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা থাকায় তারা সংক্রামক রোগটিতে আক্রান্ত কোনো ব্যক্তির সংস্পর্শে এলেও তা আর তাদের আক্রান্ত করে না। ফলে ওই রোগের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে চলে আসে।
কোনো রোগের সংক্রমণের মাত্রা বিবেচনায় কোনো জনগোষ্ঠীর ৫০ থেকে ৯০ শতাংশ ব্যক্তির মধ্যে রোগের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা তথা ইমিউনিটি গড়ে উঠলে ওই জনগোষ্ঠী ‘হার্ড ইমিউনিটি’ অর্জন করেছে বলা যায়।
৪৫% মানুষের শরীরে অ্যান্টিবডি, হার্ড ইমিউনিটি কি আসছে?
গবেষণা জরিপের ফল নিয়ে জানতে চাইলে আইসিডিডিআর,বি’র প্রধান গবেষক ফেরদৌসী কাদরি বলেন, রাজধানী ঢাকার বাসিন্দাদের মধ্যে অ্যান্টিবডি গড়ে ওঠার এ হার খুবই আশা জাগানিয়া সংবাদ। এর অর্থ হলো আমরা হার্ড ইমিউনিটি বা গোষ্ঠীবদ্ধভাবে ভাইরাস প্রতিরোধী সক্ষমতা অর্জনের সূচনালগ্নে রয়েছি। তবে অ্যান্টিবডি তো আসলে স্থায়ী থাকে না। একটা টার্নওভার রেট হয়। অ্যান্টিবডি যখন প্রথমবার হয়, IgM তখন কমে যায়। IgGটা থাকে তিন থেকে চার মাস পর্যন্ত। দ্বিতীয়বার যদি হয় সেটা আরও দীর্ঘস্থায়ী হয়।
গবেষণায় ৪৫ শতাংশ মানুষের শরীরে অ্যান্টিবডি পাওয়ার বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাইলে আইইডিসিআরের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. এ এস এম আলমগীর বলেন, এর অর্থ হলো এই যে এই জনগোষ্ঠীর শরীরে কখনো না কখনো করোনাভাইরাসের অস্তিত্ব ছিল, যাদের মধ্যে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়েছে। যাদের করোনায় আক্রান্তের লক্ষণ নেই, তাদের বেশিরভাগ অংশ স্বাভাবিকভাবেই নমুনা পরীক্ষা করতে আসবেন না। কিন্তু লক্ষণহীন হলেও তারা কিন্তু ভাইরাস নিয়েই ঘুরে বেড়াচ্ছে। তার মধ্য থেকেই হয়তো আমরা দেখছি যে ৪৫ শতাংশের মাঝে অ্যান্টিবডি ডেভেলপ করেছে।
এই গবেষণার মাধ্যমে হার্ড ইমিউনিটি বিষয়ে কিছু বলা যাবে কি না— এ বিষয়ে তিনি বলেন, এই গবেষণা ফলাফলের ওপরে নির্ভর করে ‘হার্ড ইমিউনিটির পথে বাংলাদেশ’— এমনটা বলা সঠিক হবে না। আমরা যে সেরোপজিটিভিটি দেখছি, সেটা নিয়ে আমাদের আরও বিস্তৃত আকারে গবেষণা করতে হবে। আমাদের যে নমুনা পরীক্ষার সংখ্যা, তা দিয়ে আসলে কোনো সিদ্ধান্তে আসা কষ্টসাধ্য। জাতীয় পর্যায়ে সব জেলা থেকে আমাদের যে ডাটা কালেকশন হয়েছে, সেটা যখন বর্তমান জরিপের ফলে সঙ্গে মেলানো যাবে, তখন হয়তো কিছু বলা সম্ভব হবে।
ডা. আলমগীর আরও বলেন, এই গবেষণা, এর নমুনা সংখ্যা খুব অল্প। এটা দিয়ে সিদ্ধান্তে আসা খুব ডিফিকাল্ট হবে। তাছাড়া কোভিড-১৯-এর ক্ষেত্রে তিন থেকে ছয় মাস পরে শরীরে আর অ্যান্টিবডি থাকে না বলেই এখন পর্যন্ত তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। সেক্ষেত্রে আমরা বলতে পারি, ভ্যাকসিন ছাড়া হার্ড ইমিউনিটি হওয়া অনেকটাই অসম্ভব।
আইইডিসিআরের অন্যতম উপদেষ্টা ও প্রতিষ্ঠানটির চিকিৎসা সামাজিক বিজ্ঞান বিভাগের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মুশতাক হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, সাধারণত কোনো অঞ্চলের মোট জনসংখ্যার কমপক্ষে ৬০ শতাংশের দেহে অ্যান্টিবডি গড়ে উঠলে সে পরিস্থিতিতে ‘হার্ড ইমিউনিটি’ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সেই হিসাবে দেখা গেছে, বস্তিতে বসবাসকারীদের মধ্যে অ্যান্টিবডি তৈরি হওয়ার ঘটনা বেশি ঘটেছে। তবে দেশে হার্ড ইমিউনিটি হয়েছে কি না, এটা এখনই নিশ্চিত করে বলা যায় না। আরও তথ্য বিশ্লেষণ করে এই সিদ্ধান্তে পৌছাঁতে হবে, যেখানে ঢাকার বাইরের তথ্যও থাকতে হবে।
জানতে চাইলে আইসিডিডিআর,বি’র মাতৃস্বাস্থ্য বিভাগের জ্যেষ্ঠ পরিচালক শামস-এল-আরেফিন সারাবাংলাকে বলেন, বর্তমান অবস্থায় আসলে হার্ড ইমিউনিটির কোন পর্যায়ে আছি, এটা বলা মুশকিল। একেকটা রোগের হার্ড ইমিউনিটি একেকভাবে হয়। যেহেতু কোভিড-১৯ সম্পূর্ণ নতুন একটি রোগ, তাই এটা বলা কষ্টসাধ্য বিষয়। আজকে যে গবেষণা ফলাফল জানানো হলো, তাতে বোঝা যায় আমাদের এখানে এরই মধ্যে অনেক মানুষ সংক্রমিত হয়েছেন। আর ৪৫ শতাংশ সংক্রমণের যে তথ্য বলা হয়েছে, সেটি এপ্রিল থেকে জুলাইয়ের তথ্য। এর পরে হয়তো সংক্রমণ আরও বেড়েছে। সেসব তথ্যও বিশ্লেষণ করা জরুরি।
‘হার্ড ইমিউনিটিতে পৌঁছানো নিয়ে সিদ্ধান্তে যাওয়া ভুল হবে’
তিনি বলেন, বাংলাদেশে হার্ড ইমিউনিটি হয়েছে— এটা বলা খুবই ডিফিকাল্ট। যেহেতু সম্পূর্ণ নতুন একটি ভাইরাস, তাই এখনো এর অ্যান্টিবডি কতদিন থাকতে পারে, তা বলা যায় না। এগুলো নিয়ে কাজ হচ্ছে। আবার অ্যান্টিবডি হওয়া মানেই যে কেউ নিরাপদ, বিষয়টি তেমনও না। যদি কারো কোভিড-১৯ পজিটিভ শনাক্ত হয়ে থাকে তবে ধরে নেওয়া যেতে পারে তার অ্যান্টিবডি হয়ে যেতে পারে। কিন্তু অ্যান্টিবডি তৈরি হবেই, সে বিষয়ে নিশ্চয়তা দেওয়া যায় না। আসলে করোনাভাইরাস সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট করে বলার মতো অনেক তথ্যই আমাদের হাতে নেই।
শামস-এল-আরেফিন বলেন, গবেষণার তথ্য অনুযায়ী আমরা এটা বলতে পারি যে আমরা হয়তো হার্ড ইমিউনিটির কাছাকাছি গিয়েছি। কিন্তু হার্ড ইমিউনিটি অর্জিত হয়েছে, এটা বলার সুযোগ নেই। আবার এটিও মনে রাখতে হবে, এখনো যারা আক্রান্ত হচ্ছেন, তাদের বড় একটি অংশ রাজধানী ঢাকার। হার্ড ইমিউনিটি অর্জনের দিকে গেলে কিন্তু সংক্রমণের হার কমে যাওয়ার কথা। ঢাকায় কি সেটি কমছে? কমছে না। ফলে হার্ড ইমিউনিটি নিয়ে বেশি চিন্তা না করে সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে। কারণ এখনো এই ভাইরাস আমাদের আশপাশেই রয়েছে। সেটি কখন কাকে সংক্রমিত করবে আর কার ক্ষেত্রে প্রাণঘাতী হয়ে উঠবে— সেটি নিশ্চিত করে বলার সুযোগ নেই।