Tuesday 19 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

মনিরের সাফল্যের পথ ধরে লেবু চাষে ঝুঁকেছেন গফরগাঁওয়ের চাষিরা


১৪ অক্টোবর ২০২০ ০৮:৩৩

ময়মনসিংহ: করোনাকালে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে ‘ভিটামিন সি’ জাতীয় খাবারের চাহিদা বেড়েছে দ্বিগুণ। ভিটামিন সি এর উৎসের ক্ষেত্রে লেবুর কথাই আসে সবার আগে। দামে সস্তা ও গুণেমানে সেরা লেবুর চাহিদা করোনাকালে অনেক বেড়ে গেছে। আর এই লেবু চাষ করেই আর্থিক সচ্ছলতার মুখ দেখেছেন গফরগাঁওয়ের মনির হোসেন। করোনাকালে এই লেবু চাষি লেবু ও লেবু গাছের কলম বিক্রি করে আয় করেছেন ১০ লাখ টাকা। তার সাফল্য দেখে এলাকার অনেক কৃষকই লেবুচাষে উদ্বুদ্ধ হয়েছেন। সাফল্য পাচ্ছেন তারাও।

বিজ্ঞাপন

লেবু চাষি মনির হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, ‘বিদেশ যাওয়ার চিন্তা ভেস্তে যাওয়ার পর গয়েশপুরের ব্যবসায়ী মামার পরামর্শে লেবু বাগান করি। ধীরে ধীরে লেবু বাগান থেকে বেশ সাবলম্বী হতে পারি। আমার সফলতায় আশেপাশে বিভিন্ন জায়গা থেকে লোকজন আসে পরামর্শ ও লেবুর চারা নেওয়ার জন্য। চারার অর্ডার আসে অনেক বেশি। আমার এখন মালটার বাগান করার ইচ্ছা আছে। এ জমিতে মালটার ফলনও ভালো হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানিয়েছে কৃষি বিভাগ।’

বিজ্ঞাপন

ছেলের সাফল্যে কথা জানিয়ে মনিরের বাবা রিপন মিয়া বলেন, এই করোনাকালে আট থেকে ১০ লাখ টাকা আয় করেছে মনির। তাতে পরিবারের সবাই বেশ আনন্দিত। ছেলেকে বিদেশে না পাঠাতে পারার হতাশা এখন আর নেই। বরং পরিবারে স্বচ্ছলতা ফিরে আসায় তারা এখন সন্তানকে নিয়েই গর্বিত। রিপন মিয়া জানালেন, এখনো প্রায় প্রতিদিনই লেবু ও চারা বিক্রি করছেন মনির।

করোনাকালে মনির ও তার বাবার ঘুরে দাঁড়ানোর লড়াই দেখে এলাকার অনেকে কৃষক আগ্রহী হয়ে এগিয়ে এসেছেন লেবু চাষে। তারাও মনিরের কাছ থেকে চারা নিয়ে বাগান করেছেন।

এখনকার সাফল্যে সবার মুখে হাসি ফুটলেও করোনাকালের শুরুতেও রিপন মিয়ার পরিবারের চিত্রটি এমন ছিল না। গফরগাঁয়ের গয়েশপুর জয়দরখালির অধিবাসী রিপন মিয়ার পরিবারে রয়েছেন স্ত্রী, এক ছেলে ও এক মেয়ে। মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন সাত বছর আগে। ছেলেকে কাজের জন্য দেশের বাইরে পাঠানোর জন্য রিপন মিয়া চেষ্টা করছিলেন দীর্ঘ দিন ধরে। একাধিকবার দালালদের খপ্পড়ে পড়ে প্রতারণার শিকার হয়ে খোয়াতে হয়েছে অনেক টাকা। এরকম পরিস্থিতিতে ছেলেকে নিয়ে ভেঙ পড়েছিলেন রিপন মিয়া। তার সঙ্গে সঙ্গে ছেলে মনিরের চোখেও তখন কেবলই হতাশা।

এসব কথা তিন বছর আগের। ওই সময় এগিয়ে আসেন মনিরের মামা। তিনি পরামর্শ দেন লেবু চাষ করার। তার পরামর্শে মনির ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন নিয়ে লেবু চাষ করতে শুরু করেন। তিন বছর ধরে অল্প অল্প করে প্রায় তিন একর জমিতে বিস্তৃত হয় তার লেবুর আবাদ। এর মধ্যেও দেশের বাইরে যাওয়ার চিন্তা একেবারে ছেড়ে দেননি। কারণ আবাদ বাড়লেও লেবু চাষ থেকে খুব একটা লাভ মিলছিল না, কোনোমতে সংসারটা চলছিল।

এরকম সময় পার করতে করতেই মার্চে শুরু হলো করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব। ওই সময়ে চিকিৎসক ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা জানালেন, করোনাভাইরাসের প্রতিরোধ করতে শরীরের সক্ষমতা বাড়াতে ‘ভিটামিন সি’ অত্যন্ত কার্যকর। কোনো ওষুধের বদলে লেবুর মতো ফল এই ‘ভিটামিন সি’র প্রয়োজনীয় চাহিদাকে মেটাতে বেশি কার্যকর। ওই সময় হঠাৎ করেই লেবুর চাহিদা ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়। তিন বছর ধরে লেবু চাষ করে আসা মনিরের লেবু বাগানের ফলন তাকে দেয় আশাতীত আর্থিক সাফল্য।

মনির বলেন, তিন বছর ধরে লেবু চাষ করলেও লেবুর এত চাহিদা কখনো দেখিনি। বাগানে প্রচুর লেবু ছিল। সেগুলোর খুব ভালো দাম পেয়েছি। শুধু তাই নয়, আমার দেখাদেখি অন্যরা লেবু চাষ করতে এগিয়ে এলে কলমও বিক্রি করেছি প্রচুর।

মনির ও স্থানীয় কৃষিবিদদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, লালমাটি হওয়ায় গফরগাঁও ও এর আশপাশে লেবু ও মালটা চাষের রয়েছে ব্যাপক সম্ভাবনা। মনির যে লেবু বাগান করেছেন, সেটি বীজহীন লেবুর জাত। ফলে কলম ছাড়া এর বিস্তার সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে কলম চারার জোগানে মনির ও তার বাবার বাগান হতে পারে এর কলমের ব্যাংক।

মনিরের বাগানের লেবুর প্রশংসা করলেন মাওনা বাজারের পাইকার শফিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘মনিরের লেবু খুব ভালো জাতের। ঢাকার বাজারে দিলেই ভালো দাম পাওয়া যায়।’ সেই ভালো জাতের লেবু চাষ করতেই মনিরের বাগানে কলমের জন্য এখন মানুষের ভিড়। মনির তাই প্রতিদিন যেমন লেবু বিক্রি করছেন, তেমনি দূর-দূরান্ত থেকে আসা কৃষকদের কাছে বিক্রি করছেন লেবুর চারাও।

মনিরের বাগানের এই সাফল্যের পেছনে স্থানীয় কৃষি কর্মকর্তাদেরও সহায়তা রয়েছে। ময়মনসিংহ কৃষি বিভাগের সহকারী উদ্যান তত্ত্ববিদ রুহুল আমিন সারাবাংলাকে বলেন, ‘মনিরের লেবু বাগানের কথা শুনে আমি এর চাষাবাদ কলাকৌশল ও রোগবালাই সম্পর্কে মনিরকে অবগত করি। সরেজমিনে বাগানে গিয়ে বিভিন্ন ধরনের কীটনাশক ও সার দিতে বলি। ভালো পরিচর্যার ফলে এখন সফলতার মুখ দেখছেন মনির ও তার বাবা। তাকে মালটা চাষের ব্যাপারেও পরামর্শ ও সহায়তা দিচ্ছি আমরা।’

ময়মনসিংহ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর (খামার বাড়ি) অতিরিক্ত উপপরিচালক (উদ্যান) ড. উম্মে হাবিবা বলেন, সম্ভাবনাময় লেবু চাষে আগ্রহী করে তোলা হচ্ছে কৃষকদের। এই করোনা পরিস্থিতিতে লেবুর বিভিন্ন গুনাগুণ নিয়ে কৃষকদের হাতে কলমে পরামর্শ, প্রশিক্ষণ, আর্থিক সহায়তাসহ চাষাবাদ কলাকৌশল শেখানো হয়েছে। তাদের আরও কোনো সহায়তা প্রয়োজন হলে তা দিতে আমরা সবসময় প্রস্তুত।

ময়মনসিংহ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের (খামার বাড়ি) ভারপ্রাপ্ত উপপরিচালক মো. মতিউজ্জামান সারাবাংলাকে বলেন, ‘এ বছর জেলায় ১৫শ হেক্টর জমিতে লেবু চাষ হয়েছে। লেবু চাষিদের মধ্যে মনির ব্যাপক সাফল্য পেয়েছেন। আমরাও কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে তাকে যথাসম্ভব সহায়তা ও পরামর্শ দিয়েছি। আশা করছি বেকার মনির যেভাবে স্বাবলম্বী হয়েছেন, তার পথ অনুসরণ করে আগামীতে আরও অনেকেই লেবু চাষে উৎসাহী হয়ে উঠবেন।’ অন্যান্য কৃষি ও উদ্যান কর্মকর্তাদের মতো তিনিও বলছেন, মনির হোসেন এখন গোটা অঞ্চলের দৃষ্টান্তে পরিণত হয়েছেন।

করোনাকাল ভিটামিন সি ময়মনসিংহ লেবু চাষ

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর