সবার জন্য ন্যায় বিচারের প্রত্যয়ে দারিদ্র্য বিমোচন দিবস আজ
১৭ অক্টোবর ২০২০ ০৩:৫৩
ঢাকা: বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) অভিঘাতে গত এপ্রিল থেকে জুলাইয়ের চার মাসে দেশে নতুন করে ২০ দশমিক ৩৬ শতাংশ মানুষ বেকার হয়েছে। শুধু তাই নয়, শতকরা প্রায় ৬৮ দশমিক ৩৯ শতাংশ পরিবারকে কোনো না কোনোভাবে করোনার প্রভাবে আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়তে হয়েছে। বিশেষ করে প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষকে এই সময়ে কর্মহীন-উপার্জনহীন সময় কাটাতে হয়েছে।
কোনো বেসরকারি সংস্থা নয়, এই হিসাব বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস)। বাংলাদেশে করোনার এই আঘাত বাকি পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন কিছু নয়। কারণ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর তথ্যই বলছে, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের কমপক্ষে ৪০ কোটি মানুষ নতুন করে চরম দারিদ্র্যসীমায় নেমে গেছে। সব মিলিয়ে এমন চরম দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বিশ্বব্যাপী ১১০ কোটি। দারিদ্র্য দূরীকরণে বিশ্বের গত এক-দেড় দশকের যা কিছু অর্জন, তার সবই বলতে গেলে কেড়ে নিয়েছে এই করোনাভাইরাস, তথা কোভিড-১৯।
ঠিক এমন একটি পরিস্থিতিতে আজ শনিবার (১৭ অক্টোবর) বিশ্বব্যাপী পালিত হতে যাচ্ছে ‘দারিদ্র্য বিমোচন দিবস ২০২০’। করোনার আক্রমণে যখন বিশ্ব শত বছরের সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক মন্দায় আক্রান্ত, তখন জাতিসংঘ স্বীকৃত এই দিবসটির এ বছরের প্রতিপাদ্য— ‘সবার জন্য সামাজিক ও পরিবেশগত ন্যায় বিচার অর্জনে যৌথভাবে কাজ করা’।
করোনার অভিঘাত ও দারিদ্র্য নিরসন নিয়ে আরও খবর-
- করোনার পর বাড়বে দারিদ্র্য: গবেষণা
- ‘সংকট কাটিয়ে দ্রুতগতিতে আগের অবস্থায় ফিরছে বাংলাদেশ’
- করোনায় চরম দারিদ্র্যে ৬০ ভাগ মানুষ, খাবারই পাচ্ছে না ১৪ ভাগ
- দারিদ্র্য জয়ে মাইলফলক স্থাপন করেছে বাংলাদেশ: সরকারি প্রতিবেদন
- এসডিজি প্রতিবেদন: সামাজিক সুরক্ষার সুফল মিলেছে দারিদ্র্য নিরসনে
- কোভিড-১৯ অভিঘাত: ৪ মাসে বেকার হয়েছিল ২০.৩৬ শতাংশ মানুষ: বিবিএস
বাংলাদেশের জন্য এই দিবসটি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। কেননা, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা তথা এসডিজি’র প্রথম লক্ষ্যই হলো দারিদ্র্য বিমোচন। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ গত এক দশকে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে। সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের (জিইডি) এসডিজি অগ্রগতি প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, ২০১০ সালে যেখানে দেশে দারিদ্র্যের হার ছিল ৩১ দশমিক ৫ শতাংশ, ২০১৮ সালে সেটি নেমে এসেছিল ২১ দশমিক ৬ শতাংশে। তবে করোনার অভিঘাতে জুনে দারিদ্র্যের হার বেড়ে হয় ২৯ দশমিক ৪ শতাংশ।
এদিকে, ২০১০ সালে দেশে অতি দারিদ্র্যের হার ছিল ১৭ দশমিক ৭ শতাংশ। ২০১৮ সালে তা কমে দাঁড়িয়ে ৯ দশমিক ৪ শতাংশে। করোনার কারণে জুনে তা আবার বেড়ে হয় ২০ দশমিক ৫ শতাংশ। অবশ্য বিবিএসের প্রতিবেদন বলছে, করোনার অভিঘাত কাটিয়েও ফের অর্থনীতির চাকা সচল হতে শুরু করেছে। যেমন— জুলাইয়ে যখন আগের চার মাসে নতুন করে বেকার পাওয়া যায় ২০ শতাংশ মানুষকে, সেপ্টেম্বরেই এর পরিমাণ নেমে আসে ৪ শতাংশের নিচে। আবার মার্চেও আয় করা যে পরিবারটি এপ্রিল-মে-জুনে উপার্জনহীন হয়ে পড়েছিল, জুলাই থেকে তারা ফের উপার্জনে ফিরতে শুরু করেছে। আগস্ট নাগাদ তারা মার্চের তুলনায় ৮০ শতাংশ উপার্জনে ফিরতে পেরেছে।
এ অবস্থায় এসডিজি’র প্রথম লক্ষ্য দারিদ্র্য দূরীকরণে গত এক দশকের অর্জন করোনাভাইরাসের কারণে নস্যাৎ হবে না বলেই মনে করছেন সরকারের সংশ্লিষ্টরা। তবে জিইডি বিভাগ মনে করছে, এই দারিদ্র্য নিসরনের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা হলো বৈষম্য। সেটি নিয়ন্ত্রণ করা গেলেই দারিদ্র্য বিমোচনে আরও সাফল্য মিলবে।
প্রতিপাদ্যে সামাজিক ও পরিবেশগত ন্যায় বিচার
এ বছরের প্রতিপাদ্য নির্ধারণের ব্যাখ্যায় জাতিসংঘ বলছে, দারিদ্র্যের যে বহুমুখী চরিত্র, তা বিশ্লেষণ করলে এটা স্পষ্ট যে এই দুইটি ইস্যু (সামাজিক ও পরিবেশগত ন্যায় বিচার) ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে। পরিবেশগত ইস্যুতে সবার জন্য ন্যায় বিচার নিশ্চিত না করা গেলে সামাজিক ন্যায় বিচারও নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। অন্যদিকে উপার্জনের দিক থেকে দারিদ্র্য নিসরনে কিছু অগ্রগতি থাকলেও পরিবেশের মতো গুরুত্বপূর্ণ সব বিষয়সহ সার্বিকভাবে দারিদ্র্য দূর করার ক্ষেত্রে খুব বেশি সাফল্য আসেনি। যেসব এলাকায় মানুষকে চরম দারিদ্র্যের মধ্যে বাস করতে হচ্ছে, সেখানকার জনগণের মধ্যে হয়তো তাদের পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে কিছু প্রচেষ্টা আছে। সেক্ষেত্রে তাদের অনেকে সফল হলেও তাদের কণ্ঠস্বরগুলো ম্রিয়মাণ, বিশেষ করে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর কাছে তাদের কোনো মূল্যায়ন নেই।
এ পরিস্থিতি বদলাতে হবে উল্লেখ করে জাতিসংঘ বলছে, দারিদ্র্যের মধ্যে যারা বাস করছে, তাদের অংশগ্রহণ, তাদের জ্ঞান, তাদের অবদান ও অভিজ্ঞতাকে অবশ্যই মূল্যায়ন করতে হবে, সম্মান করতে হবে এবং আমাদের প্রচেষ্টার মধ্যেও তাদের অন্তর্ভুক্ত করে নেওয়ার প্রতিফলন থাকতে হবে। তাহলেই কেবল সামাজিক ও পরিবেশগত ন্যায় বিচার নিশ্চিত করার উপযোগী একটি টেকসই ও সাম্যের বিশ্ব গড়ে তোলা সম্ভব হবে।
যেভাবে দারিদ্র্য বিমোচন দিবস
এই দিবসটি বিশ্বব্যাপী পালনের ইতিহাস খুব বেশি পুরনো নয়। জানা যায়, ১৯৮৭ সালের ১৭ অক্টোবর ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে সমবেত হয়েছিলেন কয়েক লাখ মানুষ। চরম দারিদ্র্য, সহিংসতা ও ক্ষুধায় যেসব মানুষকে প্রাণ দিতে হয়েছে, তাদের স্মরণ করতেই তারা একত্রিত হয়েছিলেন। দারিদ্র্য বিমোচন নিয়ে বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন সংস্থা ও ব্যক্তি যারা কাজ করছিলেন, তারা এই সমাবেশকে একটি দৃষ্টান্ত হিসেবে নেন। তারা এই দিনটিতে দারিদ্র্য বিমোচনে নিজেদের যে অঙ্গীকার, সেটি নিজেদেরই স্মরণ করিয়ে দেওয়ার জন্য দিনটি পালন করতে শুরু করেন।
আন্তর্জাতিকভাবে বিষয়টি কয়েকবছর ধরে প্রচার পেলে ১৯৯২ সালের ২২ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে দারিদ্র্য বিমোচন নিয়ে একটি দিবস উদযাপনের প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়। পরে ওই প্রস্তাবটি সর্বসম্মতিক্রমে পাস হয়। ওই প্রস্তাব অনুযায়ীই ১৭ অক্টোবরকে আন্তর্জাতিক দারিদ্র্য বিমোচন দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়। পরের বছর, অর্থাৎ ১৯৯৩ সাল থেকে দিবসটি পালিত হয়ে আসছে সারাবিশ্বে।
এসডিজি জাতিসংঘ টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা দারিদ্র্য দূরীকরণ দারিদ্র্য নিরসন দারিদ্র্য বিমোচন দারিদ্র্য বিমোচন দিবস বাংলাদেশ