‘বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যর্থতায় পিপলসের টাকা লুট হয়েছে’
১৯ অক্টোবর ২০২০ ১৮:০৬
ঢাকা: বাংলাদেশ ব্যাংক সঠিকভাবে নজরদারি না করায় পিপলস লিজিংয়ের টাকা প্রতিষ্ঠানটির পরিচালকরা লুট করে নিয়ে গেছেন বলে অভিযোগ করেছেন প্রতিষ্ঠানটির আমানতকারীরা। শুধু তাই নয়, এর পেছনে কোনো কোনো ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক শ্রেণির অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজশও দেখছেন তারা।
তাদের অভিযোগ, বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা ২০১৫ সাল থেকে পিপলস লিজিংয়ে সার্বক্ষণিক উপস্থিত থাকার পরও কিভাবে পিপলস লিজিংয়ের হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাট হলো? এসব লুটপাটের দায় কোনোভাবেই বাংলাদেশ ব্যাংক এড়াতে পারে না।
সোমবার (১৯ অক্টোবর) রাজধানীর মতিঝিলে সিটি সেন্টারের সামনে পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেডের (পিএলএফসিএল) ক্ষুদ্র আমানতকারীদের উদ্যোগে এক মানববন্ধন কর্মসূচিতে বক্তারা এসব কথা বলেন।
মানববন্ধন কর্মসূচিতে বক্তব্য রাখেন পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স কোম্পানি ব্যক্তি আমানতকারীদের কনভেনার ও প্রধান সমন্বয়কারী মোহাম্মদ আতিকুর রহমান আতিক, সেক্রেটারি জেনারেল রানা ঘোষ, আমানতকারী সামিয়া বিনতে মাহবুবসহ কয়েকশ ক্ষুদ্র আমানতকারী উপস্থিত ছিলেন। মানববন্ধন শেষে আমানতকারীরা মিছিল নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক কার্যালয়ে গিয়ে একটি স্বারকলিপি দেন।
মানববন্ধন কর্মসূচিতে আমানতকারীরা বলেন, পিপলস লিজিং বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি লাইসেন্সধারী প্রতিষ্ঠান এবং পুঁজিবাজারের তালিকাভুক্ত কোম্পানি। ১৯৯৩ সালের বাংলাদেশ সরকারের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অর্ডিন্যান্স ও নীতিমালা অনুযায়ী পিপলস লিজিংয়ের সঠিক তদারকির দায়িত্ব বাংলাদেশ ব্যাংকের। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক তার সঠিক দায়িত্ব পালনে সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের আমজাত হোসেনসহ কিছু কর্মকর্তা পিপলস লিজিংয়ে রাখা আমানতকারীদের অর্থ প্রতিষ্ঠানটির পরিচালকরা যেন লুটপাট করতে পারেন, সেই সুযোগ করে দিয়েছেন। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঠিক তদারকি না থাকায় এবং তাদের ব্যর্থতার কারণে ২০১৯ সালে পিপলস লিজিং অবসায়ন করা হয়েছে। এতে করে ৬ হাজার ব্যক্তি শ্রেণির আমানতকারীর হাজার কোটি টাকা আটকে পড়েছে।
আমানতকারীরা আরও বলেন, পিপলসের আমানতকারীরা আমানতের টাকা তুলতে না পারায় বর্তমানে অনেকে চরম মানবেতর জীবনযাপন করেছেন। কেউ অর্ধহারে অনাহারে দিনযাপন করছেন। কেউ আবার টাকার অভাবে বিনা চিকিৎসায় মরতে বসেছে। তাই অবিলম্বে আমানতাকারীদের টাকা ফেরত দেওয়ার ব্যবস্থা করা হোক। অথবা প্রতিষ্ঠানটি পুনর্গঠন করা হোক।
আরও পড়ুন-
- পিপলস লিজিংয়ের দায় দেনা নিরীক্ষা করবে ‘একনাবিন’
- পিপলস লিজিংয়ের অবসায়ক বাংলাদেশ ব্যাংকের ডিজিএম
- পিপলস লিজিংয়ের পরিচালকদের তালিকা চেয়েছেন হাইকোর্ট
- পিপলস লিজিংয়ে আটকে রয়েছে গ্রাহকের ২ হাজার কোটি টাকা
- পিপলস লিজিং: ১৪টি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান পাবে ৮৩১ কোটি টাকা
- পিপলস লিজিংয়ের আর্থিক প্রতিবেদন আমলে নেয়নি বাংলাদেশ ব্যাংক
- মাসে খরচ ১৫ লাখ, ১০ মাসে ‘আদায় হয়নি’ পিপলস লিজিংয়ের ১ টাকাও
মোহাম্মদ আতিকুর রহমান আতিক বলেন, গত দেড় বছর ধরে আমাদের সারাজীবনের সঞ্চিত টাকা পিপলস লিজিংয়ে আটকে পড়ে আছে। আমরা আমাদের টাকা ফেরত চাই। আগামী একমাসের মধ্যে টাকা ফেরত না দিলে দেশের আটটি বিভাগীয় শহরে কঠোর কর্মসূচি দেওয়া হবে।
তিনি বলেন, অনেক মুক্তিযোদ্ধা, অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, প্রবাসীসহ সমাজের বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ তাদের সারাজীবনের সঞ্চয় এখানে আমানত রেখেছেন। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যর্থতা, অদক্ষতা এবং ক্ষেত্রবিশেষে দুর্নীতির কারণে পিপলস লিজিং অবসায়ন করতে হয়েছে। বর্তমানে আমানতের টাকা ফেরত না পেয়ে আমানতকারীরা মানবেতর জীবনযাপন করেছেন।
আমানতকারী সামিয়া বিনতে মাহবুব সারাবাংলাকে বলেন, পিপলসে ব্যক্তি শ্রেণির ছয় হাজার আমানতকারীর ৭১২ কোটি টাকা আটকে রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক এই টাকা পিপলস লিজিংকে ঋণ দিয়ে ব্যক্তি শ্রেণির আমানতকারীর টাকা পরিশোধে সহায়তা করতো পারত। বাংলাদেশ ব্যাংক পরে ঋণের টাকা পিপলসের সম্পদ বিক্রি করে আদায় করে নিলে সমস্যার কিছুটা হলেও সমাধান হতো।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের দুর্বল মনিটরিংয়ের কারণে পিপলস লিজিংয়ের টাকা লুটপাট হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক নির্বাহী পরিচালক আমজাদ হোসেন পিপলসের প্রশাসক হিসেবে যখন অফিস করতেন, তখন পিপলসে টাকা রাখতে আমাদের উৎসাহিত করেছেন। তার উৎসাহে অনেকেই টাকা রেখেছেন।
সামিয়া বিনতে মাহবুব বলেন, ২০১৫ সালের পর থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক সার্বক্ষণিক প্রতিষ্ঠানটি তদারকি করেছে। তাদের তদারকির মধ্যেই পিপলসের পরিচালকরা প্রতিষ্ঠানটির হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করলেন কিভাবে? এ দায় কি বাংলাদেশ ব্যাংক এড়াতে পারে?
মানববন্ধনে লিখিত বক্তব্য বলা হয়, পিপলসের টাকা আত্মসাৎ করে বিদেশে পাচার করা হয়েছে। সেখানে সেকেন্ড হোম বানাচ্ছে। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ ব্যাংক কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না। পিপলসের পরিচালক প্রশান্ত কুমার হালদার (পি কে হালদার) একাই সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করে কানাডা পালিয়ে গেছেন। কিভাবে পালিয়ে গেলেন তিনি?
মানববন্ধনে অংশ নেওয়া আমানতকারীদের অভিযোগ, পিপলসের টাকা আত্মসাৎ করে অনেকে দেশে ঘুরে বেড়ালেও তাদের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না। তাই দ্রুত পিপলসের টাকা উদ্ধার করে আমানতকারীদের ফেরত দেওয়ার দাবি জানান তারা।
উল্লেখ্য, ১৯৯৭ সালেল ২৪ নভেম্বর পিপলস লিজিং আর্থিক প্রতিষ্ঠান হিসাবে অনুমোদন পাওয়ার পর ২০০৫ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়। ২০১৪ সাল থেকে প্রতিষ্ঠানটি লোকসানে ছিল। ২০১৯ সালে ২১ মে বাংলাদেশ ব্যাংক অর্থ মন্ত্রণালয়ে প্রতিষ্ঠানটির অবসায়নের আবেদন করে। গত ২৬ জুন অর্থ মন্ত্রণালয় তা অনুমোদন করলে ১০ জুলাই অবসানের বিষয়টি অনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক।
এরপর ১১ জুলাই বাংলাদেশ ব্যাংক পিপলস লিজিং থেকে টাকা উত্তোলনে বিধিনিষেধ আরোপ করে এবং ১৪ জুলাই বাংলাদেক ব্যাংকের ডিজিএম মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান খানকে অবসায়ক নিয়োগ দেওয়া হয়। প্রতিষ্ঠানটিতে ছয় হাজার ব্যক্তি শ্রেণির আমানতকারী এবং বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক আমানতাকারীর ১ হাজার ৯৯৬ কোটি টাকা আটকে পড়েছে। এই টাকার পুরোটাই পিপলস ঋণ হিসেবে বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কাছে পাওনা রয়েছে, যার একটি বড় অংশ প্রতিষ্ঠানটির পরিচালকরা নামে-বেনামে ঋণ নিয়ে আত্মসাৎ করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।