Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

আপ্যায়ন-অনুদানে ধান গবেষণার ডিজির ‘পরিশ্রমী’ লুটপাট!


২২ অক্টোবর ২০২০ ২৩:০৬

বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) ও এর মহাপরিচালক কৃষি বিজ্ঞানী ড. মোঃ শাহজাহান কবীর। ছবি: উইকিপিডিয়া ও ব্রি-এর ওয়েবসাইট

ঢাকা: বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) মহাপরিচালক (চলতি দায়িত্ব) ড. মো. শাহজাহান কবীরের বিরুদ্ধে অতিথি আপ্যায়নের নামে অর্থ লুটপাটের অভিযোগ পাওয়া গেছে। করোনাকালে মার্চ মাসেই অতিথি আপ্যায়নে তিনি প্রায় পৌনে এক লাখ টাকা খরচ করেছেন। বরাদ্দকৃত ২৫ হাজার টাকার বাড়তি খরচ করতে গিয়ে তিনি যে পাঁচটি চাহিদাপত্রে ওই খরচ দেখিয়েছেন, তার সবকটিতে একই দামে একই পণ্য কেনা হয়েছে। শুধুমাত্র ওই পাঁচটি চাহিদাপত্রে ভিন্ন ভিন্ন তারিখ দেখানো হয়েছে। ব্রি কর্মকর্তারা বলছেন, অতিথি আপ্যায়নের নামে এই অর্থ লুট করা হয়েছে।

বিজ্ঞাপন

শুধু এই একটিই নয়, ‘অতিথিপরায়ণ’ এই ডিজির বিরুদ্ধে অভিযোগের অন্ত নেই! চলতি দায়িত্বে থাকলেও তার অফিসিয়াল ভিজিটিং কার্ড ও কক্ষের নেমপ্লেটে চলতি শব্দটি উল্লেখ নেই। বরং তিনি নিজেকে নিজেই ‘কঠোর পরিশ্রমী’ উল্লেখ করে গত দুই বছরে তার মূল বেতনের সমান সাতটি ভাতা অর্থাৎ ৬ লাখ টাকা প্রতিষ্ঠানটি থেকে তুলে নিয়েছেন। এ ছাড়াও ব্রি’র গবেষণা ফান্ড থেকে ২ কোটি টাকারও বেশি অনুদান হিসেবে ব্রি উচ্চ বিদ্যালয় ও ব্রি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তিনি দান করেছেন!

বিজ্ঞাপন

সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, এসব অর্থও লুটপাটের উদ্দেশ্যে অনুদান হিসাবে দেওয়া হয়েছে। অবৈধভাবে শ্রমিক নিয়োগ, বিজ্ঞানীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার, প্রকল্পের অর্থের অপচয়, বাড়ি, গাড়ি, ফটক ও নতুন ভবন নির্মাণে দুর্নীতিসহ নানা অনিয়মনের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। এ ছাড়া প্রতিষ্ঠানটিতে তিনি স্বেচ্ছাচারিতা চালিয়ে আসছেন বলেও ব্রি’র কর্মকর্তাদের অভিযোগ। এ নিয়ে এর আগেও সারাবাংলায় প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে।

আরও পড়ুন: বাড়ি-গাড়ি-ভবন নির্মাণে অনিয়ম: অভিযুক্ত ধান গবেষণার ডিজি

ড. শাহজাহান কবীরের বিরুদ্ধে সম্প্রতি এমন হাজারও অভিযোগ জমা পড়ে কৃষি মন্ত্রণালয়ে। এসব অভিযোগ অনুসন্ধানে কৃষি মন্ত্রণালয় তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি করে। গেল ১ অক্টোবর ওই কমিটির পাঠানো এক চিঠিতে ড. মো. শাহজাহান কবীরকে মন্ত্রণালয়ে তলব করা হয়েছিল। মন্ত্রণালয়ের ওই চিঠিতে বলা হয়, দুর্নীতি, অনিয়ম, স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগের বিষয়ে ২৯ সেপ্টেম্বর তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক অতিরিক্ত সচিবের (পিপিসি) সভাপতিত্বে একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ওই বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী শাহজাহান কবীরের বক্তব্য জানতে ৮ অক্টোবর তাকে ডাকা হয়েছিল।

ড. শাহজাহান সেদিন মন্ত্রণালয়ে হাজির হয়েছিলেন। তবে তদন্ত কমিটির কর্মকর্তারা মন্ত্রণালয়ের অন্য কাজে ব্যস্ত থাকায় সেদিন তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়নি। পরবর্তী সময়ে তাকে আবারও জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে বলে সারাবাংলাকে তখন জানিয়েছিলেন তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক অতিরিক্ত সচিব (পিপিসি) ড. মো. আবদুর রৌফ। সাধারণত একজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে একাধিক গুরুতর অভিযোগ পেলে মন্ত্রণালয় এমন তদন্ত কমিটি করে থাকে বলেও সেদিন জানিয়েছিলেন তিনি।

জানতে চাইলে বুধবার (২১ অক্টোবর) রাতে তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক অতিরিক্ত সচিব (পিপিসি) ড. মো. আবদুর রৌফ সারাবাংলাকে বলেন, ‘কঠোর পরিশ্রমী কর্মকর্তা হিসেবে সবাই নিজের জন্য নিজেই অর্থ গ্রহণ করে। পরে যখন জিজ্ঞাসা করা হয়, তখন বলেন— আমার অধীনস্ত সব কর্মকর্তাই আমাকে কঠোর পরিশ্রমীর তালিকায় রাখতে অনুরোধ করেছেন। আর উনার (ড. শাহজাহান) আগের রেকর্ড স্টাডি করলেও পাওয়া যাবে, তিনি সেখানে অবৈধভাবে এসেছেন। তিনি কোনো কৃষিবিদ নন। প্রতিষ্ঠানটিতে তিনি কৃষিবিদদের মাথা তুলে দাঁড়াতে দিচ্ছেন না। যোগ্য অনেক কর্মকর্তা সেখানে বঞ্চিত। আর তিনি নিজে ওপরের মহলের অনেককে তুষ্ট করে চলেন। ধূর্ত প্রকৃতির লোক। অনেক সময় অনেক কিছু প্রমাণও রাখেন না। কিন্তু আমরা নিরপেক্ষভাবেই তদন্ত শেষ করব।’

আবদুর রৌফ আরও বলেন, ‘তদন্তের সময়ের জন্য আমাকে টাইমলাইন বেঁধে দেওয়া হয়নি। আমরা উনাকে ডেকেছিলাম। তিনিও এসেছিলেন। আমরা ব্যস্ত থাকায় সেদিন তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা যায়নি। আমরা বসে উনাকে আবারও জিজ্ঞাসাবাদের সময় নির্ধারণ করব। আশা করি, সপ্তাহখানেকের মধ্যে এই তদন্ত শেষ করতে পারব।’

এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘আমরা নিজেরা এই তদন্ত করতে গিয়ে তিনটি মিটিং করেছি। আমরা নিরপেক্ষভাবেই তদন্ত রিপোর্ট দেবো।’ আরেক এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি আরও বলেন, ‘মন্ত্রণালয় চাইলে তদন্তকালেও তিনি মহাপরিচালকের দায়িত্বে থাকতে পারেন।’

মন্তব্য জানতে চাইলে দুর্নীতিবিরোধী আন্তর্জাতিক সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান সারাবাংলাকে বলেন, ‘তার (ব্রি মহাপরিচালক) বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ, তা করতে গিয়ে তিনি ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন। ব্যক্তিস্বার্থে আর্থিক সুবিধা নিয়েছেন। আর এসব করতে গিয়ে তিনি প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছেন, যা ফৌজদারি অপরাধ। এ জন্য বিভাগীয় তদন্ত হতে পারে। আর তিনি যা করেছেন, তা খতিয়ে দেখা দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) তদন্তের এখতিয়ারভুক্ত। বিষয়টি দুদকের খতিয়ে দেখা উচিত। যদি বৈধ আয় ব্যতীত তার কোনো অসামঞ্জস্যপূর্ণ সম্পদ পাওয়া যায়, তাহলে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া উচিত বলে আমি মনে করি।’

অভিযোগের এসব বিষয়ে মন্তব্য জানতে বুধবার (২১ অক্টোবর) ব্রি’র মহাপরিচালক ড. শাহজাহান কবীরকে একাধিবার কল দেওয়া হলেও তিনি তা ধরেননি। এসএমএস পাঠিয়েও উত্তর পাওয়া যায়নি। তবে এর আগে গত ৮ অক্টোবর সারাবাংলার কাছে দাবি করেছিলেন, কোনো দুর্নীতির সঙ্গে তিনি যুক্ত নন। মন্ত্রণালয়ে যে চিঠি পাঠানো হয়েছে তা উড়ো চিঠি।

এদিকে, মন্ত্রণালয়ে পাঠানো ও সারাবাংলার হাতে থাকা মার্চ মাসের ডিজি দফতরের অতিথি আপ্যায়ন সংক্রান্ত খরচের হিসাব থেকে জানা গেছে, ২০২০ সালের মার্চ মাসে অতিথি আপ্যায়নে ডিজির দফতরে চা, চিনি, বিস্কুট ও ফল বাবদ খরচ দেখানো হয়েছে ৫২ হাজার ৭২৫ টাকা। তবে ডিজির দফতরে রি-ভলবিং খরচ হিসাবে মাসে ২৫ হাজার টাকা দেওয়া হয়। তা সত্ত্বেও ব্রি’র হোস্টেল ম্যানেজারের কাছে ইনডেন্ট (চাহিদাপত্র) দিয়ে শুধু মার্চ মাসেই ১, ৫, ১১, ১৬ ও ২২ তারিখে পৃথক পাঁচটি চাহিদাপত্র দিয়েছেন তিনি। এর প্রতিটিতিই গ্রিন টি পাঁচ প্যাকেটের দাম ৭২৫ টাকা, চিনি ৪ কেজির দাম ২৪০ টাকা, লেক্সাস বিস্কুট ৫ প্যাকেট ৪৫০ টাকা, ওয়েল ফুড বিস্কুট ৪ কেজি ১২০০ টাকা, কফি ৬ প্যাকেট ২৯৭০ টাকা, কফি ম্যাট ৬ প্যাকেট ১৬২০ টাকা, বেকারি বিস্কুট ৫ কেজি ১৫০০ টাকা, আনার ৪ কেজি ১০০০ টাকা এবং ওয়াটার ৫ কেস ৮৪০ টাকার হিসাব দেখিয়েছেন। এই পাঁচটি বিলের প্রতিটিতে খরচ দেখানো হয়েছে ১০ হাজার ৫৪৫ টাকা।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে ব্রি’র একজন বিজ্ঞানী সারাবাংলাকে বলেন, ‘পাঁচটি চাহিদাপত্রেই হুবহু একই পণ্যের একই পরিমাণ এবং একই দাম লেখার বিষয়টি থেকেই বোঝা যায়, অসৎ উদ্দেশ্যে একটি চাহিদাপত্র তৈরি করে ফটোকপি করে শুধু তারিখ ভিন্ন দেখিয়ে টাকা তুলে লুট করা হয়েছে। এ ছাড়া কোনো বিশেষ কারণ ছাড়া অতিথি আপ্যায়নে রি-ভলবিং ফান্ডের টাকাই যথেষ্ট। একজন মহাপরিচালক কতটা অনৈতিক এবং দুর্নীতিপরায়ণ হলে এটা সম্ভব, তা সহজেয় অনুমেয়।’

এছাড়া ব্রি’র মহাপরিচালক নিজেকে নিজেই ‘কঠোর পরিশ্রমী’ উল্লেখ করে গত দুই বছরে তার মূল বেতনের সমান সাতটি ভাতা তুলেছেন। এর পরিমাণ প্রায় ছয় লাখ টাকা। প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তাদের অভিযোগ, যে গবেষক বা বিজ্ঞানীদের জন্য এই প্রতিষ্ঠান, সেখানে কোনো গবেষক এ ধরনের একটি ভাতাও পাননি। আর ব্রি মহাপরিচালক যেসব কাজকে কঠোর পরিশ্রম বলে মনে করছেন, সেগুলো মূলত তার রুটিন কাজ। বিষয়টিকে তার ব্যক্তিগত নৈতিক স্খলন হিসাবে দেখছেন ব্রি কর্মকর্তারা।

জানা গেছে, মহাপরিচালকের দায়িত্ব নেওয়ার পর বেতন-ভাতা প্রদান, উৎসব ভাতা প্রদান, ঠিকাদারের বিল পরিশোধসহ আরও কিছু কাজকে কঠোর পরিশ্রম উল্লেখ করে শাহজাহান কবীর অনৈতিকভাবে প্রথম ভাতা উত্তোলন করেন ২০১৮ সালের ২৭ মে। সংশ্লিষ্ট নথি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, পরবর্তী সময়ে তিনি একই বছরের ৭ আগস্ট, ২০১৯ সালের ১৪ মে, ২৬ জুন ও ১১ ডিসেম্বর এবং ২০২০ সালের ১৪ জুলাই ও ১৭ মে মোট সাতটি ভাতা উত্তোলন করেন। অথচ অর্থ মন্ত্রণালয়ের পরিপত্র অনুযায়ী সংস্থার ৫ম গ্রেড থেকে ২০তম গ্রেডভুক্ত কর্মচারীর মধ্য থেকে যিনি আকস্মিক প্রয়োজনে কঠোর পরিশ্রম করেছেন, তাকে এ ভাতা দেওয়ার জন্য সংস্থা প্রধান ওই কর্মকর্তাকে মনোনীত করবেন।

এছাড়া ব্রি উচ্চ বিদ্যালয় এমপিওভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হলেও গত ২০১৯-২০ অর্থবছরে স্কুলটিকে অনুদান দেওয়া হয় ১ কোটি ১৪ লাখ ২৫ হাজার ২৪৮ টাকা এবং ব্রি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে অনুদান দেওয়া হয়েছে ৮২ লাখ ১৮ হাজার ১৩৩ টাকা। এই সম্পূর্ণ টাকা দেওয়া হয়েছে ব্রি’র গবেষণা খাত থেকে (অর্থনৈতিক কোড নং -৩২৫৭১০৫)। অভিযোগ রয়েছে, এ টাকা অনুদানের নামে লুটপাট করা হয়েছে।

এদিকে, ড. শাহজাহান কবীরকে স্বপদে বহাল রেখে তদন্ত করায় মন্ত্রণালয়ের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। ব্রি’র একাধিক বিজ্ঞানী ও কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে সারাবাংলাকে জানান, যার বিরুদ্ধে অভিযোগ, তাকে স্বপদে রেখে তদন্ত সুষ্ঠু হওয়া কঠিন। এক্ষেত্রে ডিজিকে স্বপদে রেখে তদন্ত করায় তদন্তের ফলাফল নিয়ে শঙ্কা রয়েছে। তারা বলছেন, অবশ্যই তদন্ত হতে হবে বস্তুনিষ্ঠ। এক্ষেত্রে ডিজিকে স্বপদে রেখে সেটা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। তদন্তকালে তাকে সাময়িকভাবে হলেও দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিতে হবে। যদি তিনি ( ডিজি) নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে পারেন, তবে অবশ্যই তিনি দায়িত্বে ফিরে আসতে পারবেন।

ড. শাহজাহান কবীর কৃষি মন্ত্রণালয়ে বিভিন্নভাবে তদবির করছেন বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে। তদন্ত কমিটিকে বিষয়টি দ্রুত শেষ করে দিতেও বলেছে একটি পক্ষ। তবে তদন্ত কমিটির আহ্ববায়ক ড. মো. আবদুর রৌফ সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমি এর আগেও সাত থেকে আটটি তদন্তের দায়িত্ব পালন করেছি। সবগুলো তদন্তই নিরপেক্ষ হয়েছে। আমার সঙ্গে এই কমিটিতে আরও যে দু’জন আছেন, তারাও যথেষ্ট স্বচ্ছ। আমরা সর্বোচ্চ নিরপেক্ষতা বজায় রেখে তথ্য প্রমাণ সাপেক্ষেই তদন্ত শেষ করব।’

আপ্যায়ন খরচ গবেষণা চাহিদাপত্র ড. শাহজাহান কবীর ধান ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট মহাপরিচালক লুটপাট

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর