Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

দুর্গতিনাশিনী দুর্গা ফিরছেন স্বর্গলোকে


২৬ অক্টোবর ২০২০ ১০:০৩

ঢাকা: দুর্গতিনাশিনী দুর্গা স্বর্গলোক (দূর কৈলাশ) থেকে এবার মর্ত্যলোকে (পৃথিবী) এসেছিলেন দোলায় (পালকি) চড়ে। আর সপরিবারে স্বর্গালোকে ফিরে যাচ্ছেন গজে (হাতি) চড়ে। যার ফল হচ্ছে — শস্যপূর্ণ বসুন্ধরা। সনাতন বিশ্বাসমতে দেবীদুর্গার আশীর্বাদে শ্রীরামচন্দ্র রাক্ষসরাজ রাবণকে পরাজিত করে সীতাকে উদ্ধার করেন। সেই থেকে শরৎকালে দুর্গাপূজা হয়ে আসছে।

শাস্ত্রমতে, শরৎকালে অর্থাৎ দক্ষিণায়নে সব দেব-দেবীর মতো দেবীদুর্গাও নিদ্রিত থাকেন। শারদীয় দুর্গাপূজার বোধন হচ্ছে নিদ্রিত দেবীকে জাগ্রত করা। শরৎকালে অকাল বোধনের দ্বারা দেবীকে জাগ্রত করা হয় বলে দুর্গার অপর নাম শারদীয়া। শরৎকালে এই দুর্গাপূজা হয়, তাই তাকে শারদীয় দুর্গাপূজা বলা হয়। যদিও আজ ১০ কার্তিক অর্থাৎ হেমন্তকাল।

বিজ্ঞাপন

চণ্ডীর বর্ণনা অনুযায়ী, দুর্গা শব্দের অর্থ জীবের দুর্গতি হননকারী। আরেকটি অর্থ দুর্জয়া। জীবকে দুর্গতিতে ফেলা ‘দুর্গম’ নামক অসুরকে বধ করায় দেবী মায়ের নাম হয় দুর্গা। দুর্গমকে বধ করে স্বর্গ থেকে বিতাড়িত দেবগণকে হৃতরাজ্য ফিরিয়ে দেন তিনি এবং দুর্গতির হাত থেকে জীবকে রক্ষা করেন। এ কারণেই তাকে বলা হয় দুর্গতিনাশিনী।

মহাভারতের বিরাট পর্বের ২৪ অধ্যায়ে উল্লেখ আছে — রাজ্যভ্রষ্ট রাজা যুধিষ্ঠির বিপদ থেকে মুক্তিলাভ করার জন্য মা দুর্গার আরাধনা করেছিলেন। দুর্গা শক্তিদায়িনী। যুগে যুগে বিভিন্ন সংকটের সময় তিনি মর্ত্যধামে আবির্ভূত হয়েছেন বিভিন্ন রূপে, বিভিন্ন নামে। যেমন— আদ্যশক্তি মহামায়া, ব্রহ্মসনাতনী, দুর্গা, মহিষমর্দিনী, শলিনী, পার্বতী, কালিকা, ভারতী, অম্বিকা, গিরিজা, বৈষ্ণবী, কৌমারী, বাহারী, চণ্ডী, লক্ষ্মী, উমা, হৈমবর্তী, কমলা, শিবানী, যোগনিন্দা প্রভৃতি।

বিজ্ঞাপন

শাস্ত্রমতে, ত্রিনয়নী মহাদেবী দুর্গা মর্তলোকে আবিভূর্ত হন দুষ্টের দমনে শিষ্টের পালনে। দুর্গা পূজার মূর্তি কল্পনায় যে বিষয়গুলো ফুটিয়ে তোলা হয়, সেগুলো হলো—

শৌর্য-বীর্য (কার্তিক), জ্ঞানভক্তি (সরস্বতী), সিদ্ধি (গণেশ), সম্পদ (লক্ষ্মী), মানবজীবনের ইহকালের বস্তুলাভ এবং অন্তিমকালে মাতৃক্রোড়ে চির আশ্রয়। আর মায়ের পদতলে মহিষাসুর অশুভ এবং অহংকারের প্রতীক, যা জগতের অমঙ্গলের হেতু।

টানা পাঁচ দিনব্যাপী শারদীয় দুর্গোৎসবের প্রথম দিন পূজার ষষ্ঠীতে দেবীর ষষ্ঠাদিকল্প অর্থাৎ আবাহন, বোধন, আমন্ত্রণ, অধিবাস প্রভৃতি অনুষ্ঠান হয়ে থাকে। ষষ্ঠীতে সন্ধ্যাকালে দেবীর বোধন হয়। শাস্ত্রমতে, দেবীর বোধন হয় বিল্ববৃক্ষে বা বিল্বশাখায়। অন্যদিকে সপ্তমী থেকে নবমী পর্যন্ত প্রতিমায় দেবীর অর্চনা করা হয়ে থাকে। পূজার অষ্টমীতে বিশেষ অনুষ্ঠান অষ্টমী ও নবমী তিথির সন্ধিতে দেবীর বিশেষ পূজা ‘সন্ধিপূজা’। অষ্টমী তিথিতে কুমারী বালিকাকে পূজা করা হয়। দক্ষিণ ভারতে কন্যাকুমারী মন্দিরের কুমারী প্রতিমা পূজা দেবীদুর্গারই ঐতিহ্য বহন করে। ১৯০১ সালের ১৮ অক্টোবর স্বামী বিবেকানন্দ বেলুড় মঠে প্রথম দুর্গাপূজায় কুমারীপূজা করেছিলেন।

সনাতন বিশ্বাসমতে, কুমারীপূজা মাতৃভাবে ঈশ্বরেরই আরাধনা। কুমারী কন্যাকে জীবন্ত প্রতিমা করে জগজ্জননীর উদ্দেশে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়। দুর্গাপূজার অষ্টমী বা নবমীতে সাধারণত পাঁচ থেকে সাত বছরের একটি কুমারীকে প্রতিমার পাশে বসিয়ে দেবীজ্ঞানে পূজা করা হয়। দুর্গাজ্ঞানে পূজা করে সবার মধ্যে মাতৃভাবেরই সঞ্চার করা হয়। প্রায় সর্বজাতিয়া কন্যাকেই কুমারীরূপে পূজা করা হয়। তবে স্বত্বগুণসম্পন্না—শান্ত, পবিত্র, সত্যশীলা ও দৈব সম্পদের অধিকারিণী কুমারীকেই জগজ্জননীর প্রতিমারূপে গ্রহণের বিধি আছে। পাখি যেমন একটি ডানায় উড়তে পারে না, সমাজও তেমনি শুধু পুরুষশক্তি দ্বারা চলতে পারে না। কুমারীপূজা নারীকে মূল্যায়নের একটি সর্বোচ্চ শাস্ত্রীয় বিধি।

নবমীতে হোমযজ্ঞের দ্বারা পূজার পূর্ণহূতি দেওয়ার রীতি আছে। দুর্গাপূজায় দশমী তিথিতে হয় দেবীর বিসর্জন। পূজায় দশমী তিথি বিজয়া দশমী নামে খ্যাত। হিন্দুদের প্রচলিত বিশ্বাস অনুসারে এই দিনে শ্রীরামচন্দ্র কর্তৃক রাবণ নিহত হয়েছিলেন।একই কারণে স্বর্গ-মর্ত্যে দুর্দিনে দুর্গতিনাশিনী দুর্গার আবির্ভাব হয়েছিল। সব দেবতার সম্মিলিত তেজ সৃষ্টি করেছিল মহামায়াকে। আবার সেই শক্তিতে বলীয়ান হয়েই দেবী চণ্ডী অশুভকে বিনাশ করে স্বর্গ-মর্ত্যে ন্যায় আর শান্তি প্রতিষ্ঠা করে ধর্মের অন্তর্নিহিত অর্থকেই আবার ঊর্ধ্বে তুলে ধরেছিলেন।

প্রতিবছর কৈলাশ থেকে দুর্গা আসেন, ভক্তের পূজা নিয়ে আবার ফিরে যান কৈলাশে। শরতের কাশবনে যখন ফুলের শুভ্রতা, সনাতন বাঙালিরা তখন প্রস্তুতি নেয় মা দুর্গাকে মর্ত্যে বরণ করার জন্য। মায়ের আগমনে সন্তানের আনন্দ। আজিকে তোমার মধুর মুরতি/ হেরিনু শারদ প্রভাতে/ হে মাতঃ বঙ্গ! শ্যামল অঙ্গ/ঝলিছে অমল শোভাতে।’

সোমবার (২৬ অক্টোবর) প্রতিমা বিসর্জনের মধ্য দিয়ে এবারের মতো শেষ হচ্ছে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের প্রধান ধর্মীয়ং উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজা। সজল নয়নে ভক্তরা দুর্গতিনাশিনী দেবী দুর্গাকে বিদায় জানাচ্ছেন। পাঁচ দিনব্যাপী আয়োজনে প্রতিটি পূজামণ্ডপে ছিল ঢাকঢোল, কাঁসর-ঘণ্টাসহ বিভিন্ন বাদ্য, ধূপ আরতি ও দেবীর পূজা-অর্চনায় ভরপুর। সেই সঙ্গে ছিল করোনামুক্ত বিশ্বের প্রার্থনাও।

করোনা মহামারির মধ্যে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের প্রধান এ ধর্মীয় উৎসবে স্বাস্থ্যবিধি মানার একটা তাগিদ ছিল। সে তাগিদ যেমন রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে, তেমনি ব্যক্তি পর্যায়েও। এখানে ধর্মীয় আচারকে গুরুত্বের জায়গায় রেখে বৈশ্বিক মহামারির ব্যাপারে সচেতন থেকেছেন সবাই। ‘‘প্রতি মা’তে-ই ‘প্রতিমা’ আছে। এবার ঘরে থাকুন’’ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ রকমন পোস্ট দিয়েছেন সনাতন ধর্মাবলম্বী অনেকেই।

রাজধানীর প্রধান পুজাপণ্ডপ ঢাকেশ্বরী মন্দির, রামকৃষ্ণ মিশন, বনানী মাঠ পূজামণ্ডপ, জয়কালী মন্দিরসহ অন্যান্য পূজামণ্ডপে হ্যান্ড স্যানিটাইজিং স্ট্যান্ড স্থাপন করা হয়েছে। বাঙালির চিরায়ত সম্প্রতির বন্ধন এবার পুজাও ছিল অটুট। প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতারা করোনা মহামারির মধ্যেও পুজাপণ্ডপ পরিদর্শন করেছেন। ভিন্ন ধর্মাবলম্বীরাও বরাবরের মতো পুজাপণ্ডপ পরিদর্শন, বন্ধুদের সঙ্গে হৈহুল্লর করেছেন। পস্পরের মধ্যে উপহার সামগ্রী আদান-প্রদান হয়েছে। মুষ্টিমেয় কয়েকটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া তেমন কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি।

বিজয়া দশমী উপলক্ষে বাংলাদেশ বেতার, বাংলাদেশ টেলিভিশনসহ অন্যান্য বেসরকারি টিভি চ্যানেল ও রেডিও বিশেষ অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করেছে। জাতীয় দৈনিকগুলো এ উপলক্ষে বিশেষ নিবন্ধ প্রকাশ করবে।

শারদীয় দুর্গোৎসব উপলক্ষে দেশের সনাতন ধর্মাবলম্বীদের শুভেচ্ছা জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, বিরোধী দলের নেতা রওশন এরশাদ, জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদেরসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতারা।

দুর্গাপূজা বিজয়া দশমী বিসর্জন

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর