এখনো বাড়িছাড়া মিঠাপুকুরের সেই পরিবার, পুলিশ-প্রশাসন নিরুদ্যোগ
২২ অক্টোবর ২০২০ ২১:১৮
ঢাকা: ২১ আগস্ট ও ১১ অক্টোবর দুই দফা হামলা শিকার হয়ে স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে বাড়িছাড়া রংপুরের মিঠাপুকুরে উপজেলার বাসিন্দা আব্দুল আলিম মিঠু। এর আগে সংবাদ সম্মেলন করেছেন। দ্বিতীয় দফা হামলার শিকার হলে মামলাও করেছেন। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া তিন শিক্ষার্থীর এই বাবা নিজের ও পরিবারের নিরাপত্তা নিয়ে এখনো শঙ্কিত। তাদের বাড়িটি এখনো হামলাকারীদের দখলে। ফলে তাদের আত্মীয়-স্বজনদের বাড়িতে থাকতে হচ্ছে। আর মামলা হলেও পুলিশ কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি। পরিবারটিকে তাদের নিজেদের বাড়িতে উঠতেও কোনো সহযোগিতা করেনি।
ভুক্তভোগী পরিবারটির অভিযোগ, ক্ষমতার বলে সবকিছু করছেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগাঠনিক সম্পাদক আনোয়ার সাদাত লিমন ও তার অনুসারীরা। হামলার পর পুলিশ এসে ঘুরে গেলেও হামলাকারীরা লাঠিসোটা নিয়ে বাড়ির সামনে দিনরাত পালা করে পাহারা দিচ্ছেন, যেন কোনোভাবেই তারা বাসায় ঢুকতে না পারেন। পুলিশ-প্রশাসনসহ স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের দ্বারস্থ হয়েও তারা কোনো ফল পাচ্ছেন না।
জানা গেছে, মিঠাপুকুরে লিমনের চাচাত ভাই-বোনদের বাড়িতে ভাড়া থাকতেন আব্দুল আলিম মিঠু। তিনি বাড়ির যে অংশটিতে থাকতেন, একপর্যায়ে লিমনের চাচাত বোন নাসিম আরা বেগমের কাছ থেকে সেই অংশটি কিনে নেন। লিমনের বক্তব্য, মিঠু স্রেফ ভাড়াটিয়াই ছিলেন। বাড়ি কেনার কথা বলে সেটি দখলে নিয়েছেন। জায়গাটি তার চাচাত ভাইয়ের। তারা সেই জায়গাটি মিঠুর ‘অবৈধ দখল’ থেকে ‘উদ্ধার’ করেছেন।
এদিকে, ভুক্তভোগী পরিবারের অভিযোগ, গত ২১ আগস্ট বিকেলে লাঠিসোটা, ছোরা ও ধারালো অস্ত্রে সজ্জিত দেড় শতাধিক লোকজন নিয়ে লিমন আব্দুল আলিম মিঠুর বাড়ি ও দোকানে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর করেন এবং তালা ঝুলিয়ে দেন। অবরুদ্ধ সন্তানদের নিরাপত্তা ও সন্ত্রাসীদের তাণ্ডব থেকে বাঁচতে মিঠাপুকুর থানা পুলিশের ওসিসহ অন্যান্য কর্মকর্তাদের এবং ৯৯৯ নম্বরে ফোন করলে ঘণ্টা তিনেক পর পুলিশ এসে বাসার তালা ভেঙে তাদের উদ্ধার করে। এ ঘটনার পর থেকে এখনো মিঠুর দোকানে তালা ঝুলছে।
এ ঘটনার পর ২৩ আগস্ট তিন সন্তানের নিরাপত্তা চেয়ে সংবাদ সম্মেলন করেন আব্দুল আলিম মিঠু। রংপুর রিপোর্টার্স ক্লাব কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি সন্তানদের নিরাপত্তা চেয়ে প্রশাসনের কাছে আকুতি জানান। সংবাদ সম্মেলনে মিঠু জানান, জমিজমা সংক্রান্ত বিরোধ নিয়ে আদালতে মামলা চলমান থাকলেও বিভিন্ন সময়ে স্থানীয় নেতা আনোয়ার সাদাত হোসেন লিমন ও তার ভাই সাজ্জাদ হোসেন ভিক্টর তাদের হুমকি-ধমকি দিয়ে আসছিলেন।
লিখিত বক্তব্যে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী আব্দুল আলিম মিঠু বলেন, তার বড় ছেলে খালিদ হাসান মান্না টাঙ্গাইলের মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিদ্যালয়ের আইটি ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী। ছোট ছেলে ওমর ফারুক মুন্না রাজশাহী প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যামিকেল ও ফুড প্রসেসিং ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের চতুর্থ সেমিস্টারের শিক্ষার্থী। আর মেয়ে উম্মে কুলসুম মলি বিএ তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। করোনাভাইরাস পরিস্থিতির কারণে তারা সবাই বাসায় অবস্থান করছে। সন্ত্রাসীদের হুমকি-ধমকি ও ভাঙচুরের তাণ্ডবে তারা চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। পরিবার-পরিজন নিয়ে উদ্বিগ্ন আব্দুল আলিম মিঠু ও তার স্ত্রী প্রশাসনের কাছে নিরাপত্তা চেয়ে আকুতি জানান।
জানতে চাইলে আব্দুল আলিম মিঠু সারাবাংলাকে বলেন, আজ সাত দিন ধরে পরিবার নিয়ে ঘরছাড়া। বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া আমার তিন ছেলেমেয়ে করোনাকালে বাড়িতে থাকার জায়গা না পেয়ে অন্য মানুষের বাড়িতে রয়েছে। আমরা স্বামী-স্ত্রী দুজনেও আরেক বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছি। এভাবে কত দিন কাটাব? চায়ের দোকান করে খাই। ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া করাচ্ছি। অনেক কষ্টে শেষ সম্বল হিসেবে বাড়ি কিনেছি। সেটিও আজ হাতছাড়া হওয়ার পথে।
তিনি বলেন, আদালতে মামলা চলমান। রায় বিপক্ষে যাবে ভেবে লিমন ও সাজ্জাদ তাদের দলবল নিয়ে হামলা চালাচ্ছে বারবার। পুলিশ মামলা নিলেও কাউকে গ্রেফতার করছে না। এমনকি বাড়িতে থাকারও ব্যবস্থা করছে না। এ অবস্থায় আমরা অসহায় হয়ে পড়েছি। প্রশাসনের সব দফতরে ঘুরেও কাজ হচ্ছে না।
প্রধান অভিযুক্ত আনোয়ার সাদাত লিমন অবশ্য আব্দুল আলিম মিঠুর অভিযোগ সম্পূর্ণ অস্বীকার করেছেন। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, হামলার বিষয়টি সম্পূর্ণ মিথ্যা। মিঠু একজন ভাড়াটিয়া। আমার চাচাত ভাইয়ের বাড়িতে ভাড়া থাকে। একসময় দাবি করে, ওই বাড়ি নাকি সে কিনে নিয়েছে। এক বোন নাকি তার কাছে বিক্রি করেছে। ওই চাচাত ভাই বাড়ি উদ্ধার করেছে। এর বেশি কিছু বলতে পারব না।
জানতে চাইলে মিঠাপুকুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আমিরুজ্জামান সারাবাংলাকে বলেন, মিঠু ভাড়াটিয়া থাকা অবস্থায় হঠাৎ বাড়ি কেনার দাবি করলে দুই পক্ষের মধ্যে ঝামেলা হয়। মিঠু যার কাছে (লিমনের চাচাত বোন) জমি কিনেছেন, তিনি কোনো দলিল দেখাতে পারেননি। লিমন হামলা চালিয়েছে— এমন একটি অভিযোগ দিলে সে বিষয়ে একটি মামলা দায়ের হয়েছে। মামলার তদন্ত চলছে।
আব্দুল আলিমকে বাড়িতে উঠতে সহযোগিতা না করার বিষয়ে জানতে চাইলে ওসি বলেন, ম্যাজিস্ট্রেটের নির্দেশ ছাড়া তো পুলিশ ওই বাড়ির তালা খুলে দিতে পারে না। তদন্ত শেষ হলে আমি আদালতে প্রতিবেদন দেবো। এর আগে কিছু বলতে পারছি না।
মিঠু যার কাছে জমি কিনেছেন বলে জানিয়েছেন, সেই নাসিম আরা বেগমের সঙ্গেও কথা হয় সারাবাংলার। তিনি বলেন, আনোয়ার সাদাত লিমন আমার বাপ-দাদাদের অত্যাচার করেছে, এখন আমাদের ওপর অত্যাচার করছে। আমি ছোট ভাইয়ের কাছ থেকে জমি কিনেছি। সেই জমি বিক্রি করেছি। ওসি বললে তো হবে না। রেজিস্ট্রি অফিসে দলিল ছাড়া কি জমি বিক্রি হয়? সব দলিল তো মিঠুর কাছে। এখন তার ওপর অত্যাচার করছে। বাড়ি থেকে বের করে দখল করে নিয়েছে। লিমন ক্ষমতার জোর দেখাচ্ছে। পুলিশও পুলিশও অত্যাচারীদের পক্ষে কথা বলছে— অভিযোগ নাসিম আরা বেগমের।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মিঠাপুকুর আওয়ামী লীগের সভাপতি মিন্টু মিয়া সারাবাংলাকে বলেন, আগস্টে একবার গন্ডগোল হয়েছিল— সেটি আমি শুনেছিলাম। তবে সম্প্রতি কিছু ঘটেছে কি না, তা জানি না। শুনেছিলাম লিমনের চাচাত বোনের কাছ থেকে মিঠু জমি কিনে বাড়ি করেছিল। সেটি দখল করতে গিয়েছিল লিমন। থানার সামনেই এরকম ঘটনা কিভাবে ঘটে? পুলিশ কেন ব্যবস্থা নেয় না? আমার মনে হয়, আইন অনুযায়ী যার যেটুকু পাপ্য, তাকে সেটুকু বুঝিয়ে দেওয়াই উত্তম।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, লিমন দলের লোক। তবে অন্যায়কে প্রশ্রয় দেওয়া ঠিক না। আমাকে কোনো পক্ষ বিষয়টি জানায়নি। না জানালে কিভাবে কী সমাধান করব?