এক নজরে ডোনাল্ড ট্রাম্পের শাসনামল
২৭ অক্টোবর ২০২০ ১৫:০২
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট শুধুমাত্র তার দেশের নেতা নন। পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তি হিসেবে বিবেচনা করা হয় মার্কিন প্রেসিডেন্টকে। কারণ, তার সিদ্ধান্তের প্রভাবে বিশ্বের সকল মানুষ প্রভাবিত হয়। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শাসনামলেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে প্রথম মেয়াদে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে বিশ্বকে কীভাবে, কতটা বদলে দিয়েছেন ট্রাম্প?
বিবিসির এক প্রতিবেদনে তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে সেই চিত্রই তুলে ধরে হয়েছে। সারাবাংলার পাঠকদের জন্য সেই আলোচনা হাজির করা হলো –
বিশ্বের চোখে যুক্তরাষ্ট্র
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বরাবরই যুক্তরাষ্ট্রকে বিশ্বের শ্রেষ্ঠতম দেশ হিসেবে দাবি করে এসেছেন। কিন্তু, বিশ্বের মানুষ এ ব্যাপারে কী ভাবছেন –
সম্প্রতি ১৩ দেশে পিউ রিসার্চ সেন্টারের চালানো এক জরিপ থেকে দেখা যাচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে দেশটির ভাবমূর্তি খুব বেশি উজ্জ্বল করতে পারেননি ডোনাল্ড ট্রাম্প।
ইউরোপে ২০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম মানুষ এখন যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাপারে ইতিবাচক ধারণা পোষণ করেন।
জরিপে অংশ নেওয়া যুক্তরাজ্যের ৪১ শতাংশ অধিবাসী যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাপারে ইতিবাচক ধারণা পোষণ করার কথা বলেছেন। ফ্রান্সে এই হার ৩১ শতাংশ আর জার্মানিতে এই হার মাত্র ২৬ শতাংশ।
বিবিসি জানিয়েছে, করোনাভাইরাস মহামারি মোকাবিলায় ট্রাম্প প্রশাসনের ভূমিকা এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে। জুলাই-আগস্ট মাসে পরিচালিত ওই জরিপের উত্তরদাতাদের মাত্র ১৫ শতাংশ বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র করোনা পরিস্থিতি যথাযথভাবে মোকাবিলা করতে পেরেছে।
জলবায়ু বিভ্রাট
জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব নিয়ে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের অবস্থান কী – তা সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করা যায় না। কখনও তিনি বিষয়টিকে গুজব বলে উড়িয়ে দিয়েছেন। কখনও আবার বলেছেন জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টি সিরিয়াস।
তবে, দায়িত্ব নেওয়ার ছয় মাসের মধ্যেই প্যারিস জলবায়ু চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে সরিয়ে নেওয়ার ঘোষণা দিয়ে তিনি বিশেষজ্ঞদের হতাশ করেছেন।
চীনের পর যুক্তরাষ্ট্রই বিশ্বে সবচেয়ে বেশি গ্রিন হাউস গ্যাস নিঃসরণ করে। গবেষকদের আশঙ্কা, ট্রাম্প পুনর্নির্বাচিত হলে বৈশ্বিক উষ্ণতা নিয়ন্ত্রণে রাখা অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে।
ট্রাম্পের যুক্তি, প্যারিস চুক্তি মানতে গেলে যেসব বিধিনিষেধ আসবে, তাতে যুক্তরাষ্ট্রের বহু কারখানা বন্ধ হয়ে যাবে।
তিনি কেবল প্যারিস চুক্তি থেকেই যুক্তরাষ্ট্রকে সরিয়ে আনেননি, কয়লা, তেল ও গ্যাসের মত জীবাশ্ম জ্বালানি উৎপাদনের খরচ কমাতে বেশ কিছু নিয়ম শিথিলও করেছেন।
অবশ্য প্রাকৃতিক গ্যাসের খরচ তুলনামূলকভাবে কম হওয়ায় এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বাড়ানোর ব্যাপারে বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যের সমর্থনের ফলে যুক্তরাষ্ট্রের বেশ কয়েকটি কয়লা খনি এখনও বন্ধ রাখা হয়েছ।
দেশটির সরকারি পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, ১৩০ বছরের মধ্যে প্রথমবারের মত ২০১৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রে কয়লার চেয়ে নবায়নযোগ্য উৎস থেকে জ্বালানি উৎপাদন বেড়েছে।
মজার বিষয় এই যে, প্যারিস চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রের আনুষ্ঠানিকভাবে সরে যাওয়ার বিষয়টি কার্যকর হবে ৪ নভেম্বর। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ঠিক পরের দিন।
অনেকের আশঙ্কা, প্যারিস চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সরে যাওয়ার প্রভাব পড়বে আরও অনেক দেশের ওপর। ব্রাজিল ও সৌদি আরবের মত দেশে কার্বন নিঃসরণ কমিয়ে আনার যে পদক্ষেপ শুরু হয়েছিল, তা হয়তো বন্ধ হয়ে যাবে।
নির্বাচনে ট্রাম্পের প্রতিদ্বন্দ্বী ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রার্থী জো বাইডেন প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, নির্বাচিত হলে তিনি যুক্তরাষ্ট্রকে প্যারিস চুক্তিতে ফিরিয়ে আনবেন।
সীমান্ত সমাচার
প্রেসিডেন্ট হিসেবে অভিষিক্ত হওয়ার কয়েক সপ্তাহের মধ্যে অভিবাসন নীতি বদলাতে তৎপর হন ট্রাম্প। সে সময় সাত মুসলিম প্রধান দেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে ঢোকার পথ বন্ধ হয়ে যায়। বর্তমানে মোট ১৩ দেশের নাগরিকদের যুক্তরাষ্ট্র সফরে কড়াকড়ি আরোপিত হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারীদের মধ্যে বিদেশে জন্মগ্রহণকারীর সংখ্যা ২০১৬ সালের তুলনায় ২০১৯ সালে মাত্র তিন শতাংশ বেড়েছে। তবে পরিবর্তন এসেছে তাদের পরিচয়ে।
যুক্তরাষ্ট্রের বাসিন্দাদের মধ্যে মেক্সিকো থেকে আসা মানুষের সংখ্যা ট্রাম্পের সময়ে ধারাবাহিকভাবে কমে গেছে। তবে, লাতিন আমেরিকার অন্যান্য দেশ এবং ক্যারিবিয়ান অঞ্চল থেকে আসা মানুষের সংখ্যা বেড়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে স্থায়ীভাবে বসবাসের অনুমতি দেওয়ার হারও ট্রাম্পের শাসনামলে কমে এসেছে। বিশেষ করে যাদের পরিবারের কেউ ইতোমধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রে আছেন, তাদের ক্ষেত্রে কড়াকড়ি আরও বেড়েছে।
ট্রাম্পের অভিবাসন নীতিকে যদি কোনো সিলমোহর দিয়ে চিত্রায়িত করতে হয়, তাহলে তা হবে একটি দেয়ালের ছবি, যা তিনি নির্মাণ করছেন মেক্সিকো সীমান্তে।
সরকারি তথ্য অনুযায়ী, গত ১৯ অক্টোবর পর্যন্ত ৩৭১ মাইল দেয়াল নির্মাণের কাজ শেষ হয়েছে। অবশ্য, অভিবাসীদের আমেরিকামুখী যাত্রা তাতে কমেনি।
২০১৯ সালে যুক্তরাষ্ট্র-মেক্সিকো সীমান্তে যত অভিবাসীকে আটক করা হয়, তা ছিল ১২ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।
এদের অর্ধেকই এসেছিলেন গুয়াতেমালা, হন্ডুরাস, এল সালভাদরের মত দেশ থেকে। যেখানে সহিংসতা আর দারিদ্র্য তাদের ভিটেছাড়া করেছে।
২০১৬ সালে যুক্তরাষ্ট্র যেখানে ৮৫ হাজার শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছিল, পরের বছর তা ৫৪ হাজারে নেমে আসে।
২০২১ সালে সেই সংখ্যা ১৫ হাজারের বেশি হবে না। যা ১৯৮০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের শরণার্থী প্রকল্প শুরু করার পর থেকে সর্বনিম্ন হিসেবে রেকর্ড করা হয়েছে।
ফেক নিউজ
প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যেসব শব্দকে অন্যরকম উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছেন, তার মধ্যে সবার আগে কোনটির কথা আসবে?
২০১৭ সালে এক সাক্ষাৎকারে ট্রাম্প নিজেই বলেছেন – সেটি হবে ‘ফেক নিউজ’।
Reports by @CNN that I will be working on The Apprentice during my Presidency, even part time, are ridiculous & untrue – FAKE NEWS!
— Donald J. Trump (@realDonaldTrump) December 10, 2016
ট্রাম্প নিজে ফেক নিউজ শব্দবন্ধটি উদ্ভাবন করেননি। তবে তিনিই যে একে সবচেয়ে বেশি পরিচিতি দিতে পেরেছেন, তাতে কারও সন্দেহ নেই।
সোশাল মিডিয়া পোস্ট এবং অডিও ট্রান্সক্রিপ্ট পর্যবেক্ষণ করে ফ্যাক্টবিএ ডট এসই বলছে, ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে প্রথম বার ফেক নিউজ লিখে টুইট করার পর এ পর্যন্ত অন্তত দুই হাজার বার ওই শব্দবন্ধটি ব্যবহার করেছেন ট্রাম্প।
কেউ যদি ফেক নিউজ লিখে গুগলে সার্চ করেন – তাহলে তিনি পুরো বিশ্বে ১.১ বিলিয়নের বেশি অন্তর্ভুক্তি পাবেন। গুগল সার্চ ট্রেন্ড দেখলে বোঝা যাবে, ২০১৬-১৭ সালের শীতে ওই শব্দবন্ধটি নিয়ে মানুষের আগ্রহ কীভাবে বেড়ে গিয়েছিল। আর আলোচনা তুঙ্গে উঠেছিল যখন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ফেক নিউজ অ্যাওয়ার্ড দেওয়ার কথা বলেছিলেন।
২০১৬ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে ফেক নিউজ বলতে বোঝানো হতো সেই সব খবর, যেগুলো সঠিক নয়। যেমনঃ পোপ ফ্রান্সিস নির্বাচনে ট্রাম্পকে সমর্থন দিয়েছেন।
কিন্তু, যতই এর ব্যবহার বাড়তে থাকলো ওই শব্দবন্ধের অর্থ দাঁড়াল ভুল তথ্যের চেয়েও বেশি কিছু।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প খুব ঘন ঘন সেইসব সংবাদ প্রতিবেদনকে ফেক নিউজ হিসেবে আখ্যা দিতে শুরু করলেন, যেগুলো তার বিরুদ্ধে যায়। এমনকি আরও এক ধাপ এগিয়ে ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে তিনি কিছু সংবাদমাধ্যমকে আমেরিকার গণশত্রু হিসেবে আখ্যা দিয়ে ছিলেন।
ট্রাম্পের ফেক নিউজ তত্ত্ব মুহুর্তেই থাইল্যান্ড, ফিলিপিন্স, সৌদি আরব, বাহরাইন এবং আরও অনেক দেশে ছড়িয়ে পড়লো। ‘ভুয়া খবর’ ছড়ানোর অভিযোগ হয়ে উঠল ভিন্ন মতাবলম্বী ও সাংবাদিকদের গ্রেফতার হয়রানির হাতিয়ার।
যুদ্ধ আর যুদ্ধ
২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে স্টেট অব দ্য ইউনিয়ন ভাষণে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ঘোষণা দিলেন, সিরিয়া থেকে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সৈন্য প্রত্যাহার করে নেবেন। কারণ কোনো মহৎ রাষ্ট্র অন্তঃহীন যুদ্ধকে সমর্থন করে না।
তবে কয়েক মাস বাদে তিনি সিদ্ধান্ত দিলেন, ৫০০ মার্কিন সৈন্য সিরিয়ায় থাকবে, কারণ তেলকূপগুলোতে নিরাপত্তা দেওয়ার মতো আর কেউ নেই।
তিনি দায়িত্ব নেওয়ার সময় আফগানিস্তানে যত মার্কিন সেনা ছিল, সেই সংখ্যাও তিনি কমিয়ে আনার ঘোষণা দেন। একই সিদ্ধান্ত হয় ইরাকের ক্ষেত্রেও। কিন্তু সব জায়গাতেই এখনও মার্কিন সেনারা বহাল তবিয়তেই আছে।
২০১৮ সালে ট্রাম্প যখন জর্ডান নদীর পশ্চিম তীরসহ জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানীর স্বীকৃতি দিলেন এবং তেল আবিব থেকে যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস জেরুজালেমে স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত নিলেন – সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্টরা তাতে আপত্তি করেছিলেন। তবে ট্রাম্প তা কানে তোলেননি।
যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় সুদান, বাহরাইন ও সংযুক্ত আরব আমিরাত সম্প্রতি যখন ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে চুক্তি করল – ট্রাম্প তাকে বর্ণনা করলেন এক নতুন মধ্যপ্রাচ্যের সূচনালগ্ন হিসেবে।
যুক্তিতর্ক বাদ দিলে বলা যায়, সম্ভবত এটাই ছিল ট্রাম্প প্রশাসনের সবচেয়ে বড় কূটনৈতিক সাফল্য। যদিও এক্ষেত্রে ট্রাম্পের জামাতা এবং হোয়াইটহাউজের উপদেষ্টার একক প্রচেষ্টা ছিল লক্ষ্যনীয়।
চুক্তি থেকে মুক্তি
ওভাল অফিসে বসার প্রথম দিনই ট্রাম্প ১২ দেশের ট্রান্স প্যাসিফিক পার্টনারশিপ চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসার ঘোষণা দেন। যা অনুমোদন করে গিয়েছিলেন তার পূর্বসূরি প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। ট্রাম্পের ভাষায় ওই চুক্তি ছিল জঘন্য।
যুক্তরাষ্ট্র ওই চুক্তি থেকে সরে যাওয়ায় সবচেয়ে বেশি লাভ হয়েছে চীনের। কারণ ওই চুক্তি করাই হয়েছিল এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চীনের প্রভাব খর্ব করার লক্ষ্য নিয়ে।
কানাডা আর মেক্সিকোর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের যে মুক্তবাণিজ্য চুক্তি ছিল, ট্রাম্পের আমলে তা নতুন করে লেখা হলো। ট্রাম্পের ভাষায় আগের করা চুক্তিগুলো ছিল ইতিহাসের সবচেয়ে বাজে চুক্তি। নতুন চুক্তিতে শ্রমিক নিয়োগ আর গাড়ির যন্ত্রাংশ আমদানির নিয়মে কিছু কড়াকড়ি বাড়লেও বাকি নিয়মকানুন মোটামুটি আগের মতই থাকল।
অন্য দেশের সঙ্গে বাণিজ্যে যুক্তরাষ্ট্র কতটা লাভবান হচ্ছে, তা নিশ্চিত করাই ছিল ট্রাম্পের লক্ষ্য। আর তার ফলে চীনের সঙ্গে তিক্ত এক বাণিজ্য যুদ্ধের সূচনা হলো। বিশ্বের সবচেয়ে বড় অর্থনীতির এ দুই দেশ পরস্পরের পণ্যের ওপর বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের করের বোঝা চাপিয়ে দিতে লাগল।
তাতে যুক্তরাষ্ট্রের সয়াবিন চাষিদের পাশাপাশি মোটর গাড়ি ও প্রযুক্তি খাতের উদ্যোক্তাদের মাথায় হাত পড়ল। ক্ষতি গুণতে হল চীনকেও, কারণ বহু কোম্পানি করের খরচ থেকে বাঁচতে সেখান থেকে সরে যেতে লাগল ভিয়েতনাম আর কম্বোডিয়ার মত দেশে।
সবকিছুর পর ২০১৯ সালে চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য ঘাটতির যে অংক দাঁড়াল, তা ২০১৬ সালের তুলনায় সামান্যই কম।
ট্রাম্পের ট্যারিফ এড়াতে যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানিগুলো চীন থেকে আমদানি করার প্রবণতা কিছুটা কমিয়েছে। কিন্তু, এখনও চীন থেকে যুক্তরাষ্ট্রের আমদানির পরিমাণ রফতানির চেয়ে বেশি।
চীনের সঙ্গে লড়াই
২০১৬ সালের ৩ ডিসেম্বর একটি টুইট করলেন যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। সেই টুইটের বিষয়বস্তু যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র নীতির এতটাই বিপরীতে ছিল যে উইকিপিডিয়াকে ওই ঘটনা নিয়ে নতুন একটি পৃষ্ঠা খুলতে হয়েছে।
২ ডিসেম্বর ট্রাম্প টেলিফোনে সরাসরি কথা বলেন তাইওয়ানের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে, যে কাজটি ১৯৭৯ সালের পর যুক্তরাষ্ট্রের আর কোনো প্রেসিডেন্ট কখনো করেননি। ওই বছরই তাইওয়ানের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করেছিল যুক্তরাষ্ট্র।
The President of Taiwan CALLED ME today to wish me congratulations on winning the Presidency. Thank you!
— Donald J. Trump (@realDonaldTrump) December 3, 2016
পরদিন নিজেই টুইট করে সেই ফোনালাপের কথা বিশ্বকে জানালেন ট্রাম্প। বললেন – তাইওয়ানের প্রেসিডেন্ট তাকে অভিনন্দন জানিয়েছেন।
অনেকেই ধারণা করেছিলেন, চীন বিষয়টি ভালোভাবে নেবে না। কারণ তাইওয়ানকে নিজেদের একটি প্রদেশ বলেই দাবি করে বেইজিং।
বর্তমান বিশ্বের ভূ-রাজনীতিতে যুক্তরাষ্ট্রের বড় প্রতিদ্বন্দ্বী চীনের সঙ্গে বহুমুখী প্রতিযোগিতার সেটা ছিল ট্রাম্পীয় সূচনা। এর জেরে পরের দিনগুলোতে দুই দেশের সম্পর্ক নামল তলানিতে।
বেইজিংকে খেপিয়ে তুলতে ট্রাম্পের যুক্তরাষ্ট্র ঘোষণা দিল, দক্ষিণ চীন সাগরের সীমানার অধিকার নিয়ে চীনের দাবি অবৈধ। চীনা পণ্যের ওপর দফায় দফায় শুল্ক আরোপ করা হল। টিকটক আর উইচ্যাটের মত জনপ্রিয় চীনা অ্যাপ যুক্তরাষ্ট্রে নিষিদ্ধ করা হল। টেলিকম জায়ান্ট হুয়াওয়েকে কালোতালিকাভুক্ত করা হলো।
কারণ, ট্রাম্পের ভাষায় ওই চীনা কোম্পানি যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি।
বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়া কোভিড-১৯ কে ট্রাম্প নাম দিলেন চায়না ভাইরাস। কারণ চীনেই এর প্রাদুর্ভাবের সূচনা হয়েছিল।
তিনি হয়তো যুক্তরাষ্ট্রে মহামারির প্রকোপ সামলানোর ব্যর্থতা থেকে জনগণের দৃষ্টি সরাতে চেয়েছিলেন। তবে, আগামী নির্বাচনে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্ব বদলালেই যে চীনের সঙ্গে দ্বন্দ্বের অবসান ঘটবে – তা নাও হতে পারে।
কারণ, ডেমোক্রেট পার্টির প্রার্থী বাইডেনও চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংকে ঠগ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। তার ভাষায় চীনা নেতার শরীরে গণতন্ত্র বলে কিছু নেই।
যুদ্ধ-যুদ্ধ ভাব
আমাদের কোনো স্থাপনা যদি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, কোনো প্রাণহানি যদি ঘটে, ইরান তার জন্য পুরোপুরিভাবে দায়ী থাকবে, আর সেজন্য তাদের অনেক বড় খেসারত দিতে হবে! এটা কোনো সতর্কবার্তা নয়, এটা সরাসরি হুমকি – এটা ছিল ২০১৯ সালের শেষ মুহূর্তে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের হ্যাপি নিউ ইয়ার টুইট।
কয়েক দিন বাদে পুরো বিশ্ব বিস্ময়ের সঙ্গে জানলো, ইরানের সবচেয়ে ক্ষমতাধর জেনারেল কাশেম সোলাইমানিকে ইরাকে ড্রোন হামলা চালিয়ে হত্যা করেছে যুক্তরাষ্ট্র।
মধ্যপ্রাচের দেশগুলোতে ইরানের গোপন সামরিক কর্মকাণ্ডের নেতৃত্ব দিয়ে আসছিলেন সোলাইমানি। স্বাভাবিকভাবেই প্রতিশোধ নেওয়ার শপথ নিল ইরান। ইরাকে যুক্তরাষ্ট্রের দুটি সামরিক ঘাঁটিতে এক ডজনের বেশি ব্যালিস্টিক মিসাইল ছোড়া হল। তাতে শতাধিক মার্কিন সেনার আহত হওয়ার খবর পাওয়া গেল। সবাই ভাবলেন, যুদ্ধ বুঝি লেগেই গেল।
সে দফা আর যুদ্ধ হয়নি, কিন্তু নিরীহ মানুষের প্রাণ ঠিকই গেছে। ওই ক্ষেপণাস্ত্র হামলার কয়েক ঘণ্টা বাদে উত্তেজনার মধ্যে ইরানি সামরিক বাহিনী ভুল করে ইউক্রেনের একটি যাত্রীবাহী বিমানকে মিসাইল ছুড়ে ভূপাতিত করে, মারা যান ১৭৬ আরোহীর সবাই।
বারাক ওবামা প্রশাসন যেখানে ইরানকে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি থেকে সরিয়ে আনতে চুক্তি করেছিল, উত্তেজনা প্রশমনে তেহরানের ওপর থেকে দীর্ঘদিনের অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়েছিল।
সেই চুক্তি বাতিল করে ২০১৮ সালের মে মাসে নতুন করে উত্তেজনা ফিরিয়ে আনেন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ইরানের ওপর আরোপ করা হয় হোয়াইট হাউজের ভাষায় কঠোরতম নিষেধাজ্ঞা।
এর লক্ষ্য ছিল, ইরানকে ট্রাম্পের মর্জিমাফিক নতুন একটি চুক্তিতে আনতে বাধ্য করা।
কিন্তু, তেহরান তাতে নত হতে রাজি হল না। তার ফলে ভয়ঙ্কর মন্দায় ডুবতে হল ইরানকে। ২০১৯ সালের অক্টোবরে খাবারের দাম আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৬১ শতাংশ বেড়ে গেল। পরের মাসে দেখা দিল বিক্ষোভ।
এরপর এল করোনাভাইরাস মহামারি। তাতে যুক্তরাষ্ট্র আর ইরান- দুই দেশই ক্ষতিগ্রস্ত হল দারুণভাবে। রাজনীতির টানাপড়েন তাতে আপাতত চাপা পড়লেও শত্রুতার পুরনো কারণগুলো অক্ষতই থেকে গেল।
ইরান এল সালভাদর কাশেম সোলাইমানি চীন জার্মানি জো বাইডেন ডোনাল্ড ট্রাম্প ফ্রান্স মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন-২০২০ মেক্সিকো যুক্তরাজ্য