রায়পুর মিল্কভিটায় কোটি টাকা লোপাট— অভিযুক্ত তত্ত্বাবধায়ক
২৮ অক্টোবর ২০২০ ০৮:২৬
লক্ষ্মীপুর: লক্ষ্মীপুরের রায়পুরে মিল্কভিটার দুগ্ধ শীতলীকরণ কেন্দ্র কারখানা ও মহিষের কৃত্রিম প্রজননকেন্দ্রে দুগ্ধ উৎপাদন ও বিপণন এবং গো-খাদ্য, ওষুধ ও উপকরণ কেনাকাটায় ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া গেছে। খামারিদের অভিযোগ, এই কেন্দ্রে সব ধরনের কেনাকাটাতেই বাড়তি অর্থ ব্যয় করা হয়েছে। আর এর মাধ্যমে গত কয়েক বছরে লোপাট করা হয়েছে কোটি টাকা। এ ক্ষেত্রে অভিযোগের তীর রয়েছে মিল্কভিটা তত্ত্বাবধায়কের দিকে। জানা গেছে, তার বিরুদ্ধে এসব অভিযোগের তদন্তও চলছে প্রধান কার্যালয়ের পক্ষ থেকে।
লক্ষ্মীপুরের রায়পুরে মিল্কভিটার দুগ্ধ শীতলীকরণ ও মহিষের কৃত্রিম প্রজননকেন্দ্র স্থাপনের কাজ শুরু হয় ২০১৩ সালের জুলাইয়ে। ১৯ কোটি টাকার প্রকল্পের পুরো কাজ শেষ হয় ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে। এর মধ্যে ২০১৫ সালে যাত্রা শুরু করে দুগ্ধ শীতলীকরণ কারখানাটি। বর্তমানে এই কারখানা ছাড়াও ২০৬টি মহিষ রয়েছে কৃত্রিম প্রজননকেন্দ্রে। ৭০টি দুগ্ধ সমিতির মধ্যে চলমান রয়েছে ৩৩টি। প্রতিদিন এখন প্রায় দেড়শ লিটার দুধ উৎপাদন হয়। প্রতিদিন প্রায় ছয়শ কেজি দানাদার খাদ্য ও প্রায় ১২শ কেজি খড় প্রয়োজন হয়।
রায়পুরের খামার সমিতির অভিযোগে, মিল্কভিটার এই কেন্দ্রটিতে তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে ডা. ফরহাদুল আলম যোগ দেওয়ার পর থেকেই বিভিন্ন অনিয়ম চালিয়ে আসছেন। মহিষের দুধ নিয়ম বহির্ভূতভাবে বাইরে বিক্রি করে দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। মহিষ প্রজননকেন্দ্রের জন্য বিভিন্ন ধরনের ওষুধ কেনার নাম করে নামে-বেনামে ভাউচারের মাধ্যমে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগও রয়েছে। এছাড়া দুগ্ধ কারখানার জেনারেটরের তেলের কথা বলেও প্রতি মাসেই ভুয়া ভাউচারের মাধ্যমে দুই হাজার টাকা করে সরিয়ে ফেলা হয়।
এসব অভিযোগসহ আরও বিভিন্ন অনিয়মের কথা তুলে ধরে ডা. ফরহাদুলের অপসারণ দাবি করে পাঁচ খামারের সভাপতি। তারা কারখানার দুধ সংগ্রহের প্রক্রিয়া চালুর দাবিতে মন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্ট দফতরে লিখিত অভিযোগও করেন।
স্থানীয় খামারীদের অভিযোগ, একেকবার ১১ টাকা দরে সাড়ে ৪ হাজার কেজি করে খড় কেনা হলেও ১৪ টাকা দরে সাড়ে ৭ হাজার কেজি খড় কেনার ভাউচার জমা দেওয়া হয়। এছাড়া গবাদি পশুর জন্য যে পরিমাণ ওষুধ কেনা হয়, স্থানীয় মিতালি বাজারের একজন চিকিৎসকের সই করা খালি ভাউচারের মাধ্যমে এর চেয়ে অনেক বেশি টাকা তুলে নেন তত্ত্বাবধায়ক। উৎপাদন খরচের চেয়ে কম দামে পণ্য বিক্রি এবং সেই টাকা ফান্ডে জমা না করে আত্মসাতের অভিযোগও রয়েছে। সব মিলিয়ে গত চার বছরে মিল্কভিটার এই কেন্দ্রটি থেকে ডা. ফরহাদুল কয়েক কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন বলে অভিযোগ খামারিদের।
এর মধ্যে ২০১৮ সালের ১৪ ডিসেম্বর দুইশ লিটার মহিষের দুধ বাইরে ব্যক্তি পর্যায়ে বিক্রি করে টাকা পকেটে ভরার সুনির্দিষ্ট একটি অভিযোগ উঠেছিল ডা. ফরহাদুলের বিরুদ্দে। প্রায় একবছর পর ২০১৯ সালের ২৫ ডিসেম্বর কেন্দ্রীয় ব্যবস্থাপনা কমিটির চেয়ারম্যান সরেজমিন তদন্ত করলে বিষয়টি ধরা পড়ে। পরে এ বছরের জানুয়ারিতে আত্মসাৎ করা ওই টাকা ফেরত দিতে হয়েছিল তত্ত্বাবধায়ককে।
জানা গেছে, খামারিদের এসব আমলে নিয়ে এরই মধ্যে তদন্ত কমিটি গঠন করেছে বাংলাদেশ দুগ্ধ উৎপাদনকারী সমবায় ইউনিয়ন (মিল্কভিটা)। অতিরিক্ত মহাব্যবস্থাপক (প্রশাসন) তোফায়েল আহাম্মদের নেতৃত্বে দুই সদস্যের তদন্ত কমিটি পূর্ণোদ্যমে কাজ করছে।
পরিচয় গোপন রাখার শর্তে ওই কেন্দ্রের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, এরই মধ্যে তদন্ত কর্মকর্তারা গোখাদ্য কেনার কয়েকশ খালি ভাউচার, ওষুধ কেনার দুইশ ভাউচার, স্থানীয় এক পশু চিকিৎসকের সই করা ৩০টি খালি ভাউচারের সন্ধান পেয়েছে। জেনারেটরের ডিজেল বাবদ প্রতি মাসে ২ হাজার টাকা লোপাটের খালি ভাউচারও পেয়েছে তদন্ত কমিটি।
তবে এসব অভিযোগ সম্পূর্ণ অস্বীকার করছেন অভিযুক্ত তত্ত্বাবধায়ক (ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা) ডা. ফরহাদুল আলম। তার দাবি, তার বিরুদ্ধে মিথ্যা অপবাদ দেওয়া হচ্ছে। খড় ক্রেতাদের ভাউচার না থাকায় তাকে ভাউচার বানিয়ে নিতে হয়। তবে তাতে কোনো অনিয়ম নেই।
ডা. ফরহাদুল বলেন, ২০১৭ সালের ১২ ডিসেম্বর আমি এই কেন্দ্রে যোগ দিয়েছি। এরপর থেকে নিয়ম মেনে কাজ করে যাচ্ছি। আমার বিরুদ্ধে কিছু অভিযোগ উঠেছে বলে জানতে পেরেছি। এসব অভিযোগ নিয়ে কর্তৃপক্ষ তদন্ত করছে। আমার বিশ্বাস, তদন্তে খামারিদের অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণিত হবে।
জানতে চাইলে মিল্কভিটা’র এজিএম (প্রশাসন) ও ডা. ফরহাদুলের বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্তে গঠিত কমিটির প্রধান তোফায়েল আহাম্মদ সারাবাংলাকে বলেন, স্থানীয় খামারিদের কাছ থেকে বেশকিছু অভিযোগ এসেছে তত্ত্বাবধায়কের নামে। আমিসহ দুই সদস্যের তদন্ত কমিটি এসব অভিযোগ নিয়ে সরেজমিনে তদন্ত করছি।
তদন্তে অভিযোগের সত্যতা মিলছে কি না— এমন প্রশ্নের জবাবে তোফায়েল আহাম্মদ বলেন, তদন্তাধীন বিষয় মন্তব্য করা উচিত হবে না। তাছাড়া তদন্তের স্বার্থেও আসলে উঠে আসা তথ্যগুলো সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু বলা যাচ্ছে না। তবে আমরা নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছভাবে তদন্ত করে যাচ্ছি। তদন্ত অনেকটা শেষের দিকেও রয়েছে। খুব শিগগিরই আমরা চেয়ারম্যান বরাবর প্রতিবেদন দাখিল করব। তিনি (চেয়ারম্যান) হয়তো এ বিষয়ে গণমাধ্যমকে বিস্তারিত জানাবেন।