মৌলভীবাজার: বীরশ্রেষ্ঠ শহিদ সিপাহী হামিদুর রহমানের ৪৯তম শাহাদতবার্ষিকী আজ। ১৯৭১ সালের ২৮ অক্টোবর মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার ধলাই সীমান্তে পাক সেনাদের একটি বাংকারে গ্রেনেড হামলা চালিয়ে ফেরার পথে গুলিবিদ্ধ হয়ে শহিদ হন তিনি।
একাত্তরে মা, মাটি ও মানুষের মুক্তির জন্য রণাঙ্গনে সম্মুখ সমরে অংশ নিয়েছেন সিপাহী হামিদুর রহমান। ঝিনাইদহ জেলার মহেশপুর উপজেলার খোরদা খালিশপুর গ্রামের কৃতি সন্তান হামিদুরের বয়স তখন মাত্র ১৮ বছর। তবে বীরত্বে সবাইকে ছাপিয়ে গিয়েছেন তিনি। আর তাই স্বাধীন বাংলাদেশ তার এই বীর সন্তানের অবদানকে স্বীকৃতি দিয়েছে বীরশ্রেষ্ঠ উপাধি দিয়ে। বীরশ্রেষ্ঠ পদকপ্রাপ্ত সাত শহিদের মধ্যে হামিদুরেই সর্বকনিষ্ঠ।
ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, একাত্তরের অক্টোবরের শেষ দিকে কমলগঞ্জের ধলাই সীমান্ত এলাকায় প্রচণ্ড যুদ্ধ চলছিল। চারদিকে চা বাগান, মাঝখানে ধলাই সীমান্ত চৌকি। সিপাহী হামিদুর প্রথম ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের সি কোম্পানির হয়ে ধলই সীমান্তের ফাঁড়ি দখল করার অভিযানে অংশ নেন। সব প্রস্তুতি নিয়ে ২৮ অক্টোবর ভোরে লেফটেন্যান্ট কাইয়ুমের নেতৃত্বে একটি চৌকস দল পাক সেনাদের ওপর চতুর্দিক থেকে সাঁড়াশি আক্রমণ চালায়।
ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ১২৫ জন মুক্তিযোদ্ধা সেই সম্মুখ সমরে অংশ নেন। ব্যাপক গোলাবর্ষণে পাক সেনাদের ক্যাম্পে আগুন ধরে যায়। সামনে দুই প্লাটুন ও পেছনে এক প্লাটুন সৈন্য অবস্থান নিয়ে অগ্রসর হতে থাকে শক্র অভিমুখে। মুক্তিবাহিনী সীমান্ত ফাঁড়ির খুব কাছে পৌঁছে গেলেও ফাঁড়ির দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্ত থেকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অব্যাহত গুলিবর্ষণে অগ্রসর হওয়াযাচ্ছিল না। ওই সময় পাকিস্তান বাহিনীর পোস্টে গ্রেনেড হামলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। হামলার দায়িত্ব পান বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর।
পাহাড়ি খালের মধ্য দিয়ে পাকিস্তানি পোস্টের কাছাকাছি গিয়ে গ্রেনেড ছুঁড়তে শুরু করেন। দু’টি গ্রেনেড সফলভাবে আঘাতও হানে। এর মধ্যেই পাল্টা গুলিবর্ষণে গুলিবিদ্ধ হন হামিদুর। সে অবস্থাতেও মেশিনগান পোস্টে গিয়ে দু’জন পাকিস্তানি সৈন্যের সঙ্গে অস্ত্র ছাড়াই হাতাহাতি যুদ্ধ শুরু করেন। একপর্যায়ে মেশিনগান পোস্টকে অকার্যকর করে দিতে সক্ষম হন। এই সুযোগে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টও সামনে এগিয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে পরাস্ত করে সীমানা ফাঁড়িটি দখল করে নেয়।
ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ওই যুদ্ধে জয় পেলেও সেই স্বাদ নিতে পারেননি হামিদুর। ফাঁড়ি দখলের পরে মুক্তিযোদ্ধারা শহীদ হামিদুর রহমানের মরদেহ উদ্ধার করে। সীমান্তবর্তী ভারতীয় ভূখণ্ডে ত্রিপুরা রাজ্যের হাতিমেরছড়া গ্রামের স্থানীয় এক পরিবারের পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয় তার মরদেহ।
মুক্তিযুদ্ধের পর ধলই সীমান্ত ফাঁড়ির বিজিবির (তৎকালীন বিডিআর) পক্ষে স্থানীয়ভাবে একটি নামফলক স্মৃতিস্তম্ভ স্থাপন করা হয় বিজিবির সীমান্ত ফাঁড়ির সামনে। ২০০৫ সালে ওই সময়কার অর্থমন্ত্রী প্রয়াত এম সাইফুর রহমান ধলই চা বাগানের জমি অধিগ্রহণ করে বীরশ্রেষ্ঠ সিপাহী হামিদুর রহমানের স্মৃতিসৌধের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। পরে সাংবাদিকদের তৎপরতা ও স্থানীয়দের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০০৭ সালের ২৭ অক্টোবর বাংলাদেশের তত্ত্বাবধায়ক সরকার হামিদুর রহমানের মরদেহ বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নেয়। ওই বছরের ১০ ডিসেম্বর সীমান্তরক্ষী বাহিনীর একটি দল ত্রিপুরা সীমান্তে হামিদুর রহমানের দেহাবশেষ গ্রহণ করেন। ১১ ডিসেম্বর রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তাকে ঢাকার বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে সমাহিত করা হয়।