Friday 27 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

‘নির্যাতনে পেশাদার কেউ, উদ্দেশ্য সাংবাদিকদের থ্রেট দেওয়া’


২ নভেম্বর ২০২০ ১৭:৪৭

চট্টগ্রাম ব্যুরো: চট্টগ্রামে সাংবাদিক গোলাম সারোয়ারকে তুলে নেওয়ার পর একটি ঘরে আটকে রেখে মারধর করা হয়। যেভাবে মারধর করা হয়েছে তাতে এই সাংবাদিকের মনে হয়েছে, নির্যাতনকারীরা ‘পেশাদার কেউ’। তবে তাকে প্রাণে মেরে ফেলা তাদের উদ্দেশ্য ছিল না। তাকে নির্যাতনের মধ্য দিয়ে সব সাংবাদিককে ‘মেসেজ’ দেওয়াই ছিল তাদের উদ্দেশ্য— এমনটাই বলছেন গোলাম সারোয়ার।

সোমবার (২ নভেম্বর) চট্টগ্রাম মেডিকেলে কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন গোলাম সারোয়ার সারাবাংলা’র সঙ্গে কথা বলেন। এ সময় তিনি তাকে তুলে নেওয়ার পর থেকে ফেলে যাওয়া পর্যন্ত বিভিন্ন তথ্য দেন।

বিজ্ঞাপন

গোলাম সারোয়ার সাপ্তাহিক আজকের সূর্যোদয় পত্রিকার চট্টগ্রাম ব্যুরোর স্টাফ রিপোর্টার। চট্টগ্রামের চন্দনাইশ উপজেলায় তার বাড়ি। নগরীর ব্যাটারি গলিতে ভাড়া বাসায় তিনি একা থাকেন। স্ত্রী-সন্তানসহ পরিবারের সদস্যরা থাকেন গ্রামের বাড়িতে। গোলাম সারোয়ার চট্টগ্রাম সাংবাদিক ইউনিয়নের (সিইউজে) সদস্য। তিনি ‘সিটিনিউজবিডি’ নামে একটি অনলাইন পোর্টালেও কাজ করেন।

গত বৃহস্পতিবার (২৯ অক্টোবর) রাতে আজকের সূর্যোদয় পত্রিকার ব্যুরো প্রধান জুবায়ের সিদ্দিকী নগরীর কোতোয়ালি থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। এতে তিনি উল্লেখ করেন, বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে নয়টার দিকে নগরীর ব্যাটারি গলির বাসা থেকে বেরিয়ে আর ফেরেননি সারোয়ার।

এরপর রোববার (১ নভেম্বর) সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপজেলার বড় কুমিরা গরুর বাজার এলাকায় একটি খালপাড়ে তাকে অচেতন অবস্থায় পেয়ে স্থানীয়রা পুলিশকে খবর দেন। কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ মহসীন সাংবাদিক জুবায়ের সিদ্দিকীকে সঙ্গে নিয়ে ঘটনাস্থলে গিয়ে তাকে চমেক হাসপাতালে নিয়ে আসেন। বর্তমানে গোলাম সারওয়ার হাসপাতালের ১৪ নম্বর ওয়ার্ডে ভর্তি আছেন।

বিজ্ঞাপন

তবে জিডিতে বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে নয়টায় বাসা থেকে বেরিয়ে নিখোঁজের কথা বলা হলেও গোলাম সারোয়ার সারাবাংলাকে জানিয়েছেন, বুধবার রাতেই নগরীর ব্যাটারি গলির মুখ থেকে তাকে তুলে নেওয়া হয়েছিল।

‘আমি পাঠাও সার্ভিসের একটি মোটরসাইকেলে উঠেছিলাম। কিছুদূর যাওয়ার পর একজন মোটরসাইকেলের পিছনে উঠে আমাকে একটা কাপড় দিয়ে মুড়িয়ে দেয়। তারপর আমি আর কিছু জানি না। অনেকক্ষণ পর যখন জ্ঞান ফেরে তখন অনুভব করি, আমি একটা অ্যাম্বুলেন্সের মধ্যে আছি। অ্যাম্বুলেন্সের মতো কিছু একটায় করে আমাকে নিয়ে যায় একটি ঘরে। সেখানে ফ্লোরে রাখা হয়’— এভাবেই তুলে নেওয়ার বর্ণনা দেন সারোয়ার।

সীতাকুণ্ড থেকে গাড়িতে চমেক হাসপাতালে আসার পথে তার কাছ থেকে তথ্য নেন ওসি মোহাম্মদ মহসীন। পাশে ছিলেন জুবায়ের সিদ্দিকী।

জুবায়ের সিদ্দিকী সারাবাংলাকে বলেন, ‘সারোয়ারকে ওসি বলেছেন, সিসি ক্যামেরার ফুটেজে বুধবার (২৮ অক্টোবর) রাত ১১টায় তাকে জিইসি মোড়ে দেখা গেছে। জবাবে সারওয়ার বলেছে- সে জিইসি মোড় থেকে একটি প্যান্ট ও গেঞ্জি কেনেন। পরে স্ত্রীর জন্য আরও কিছু শপিং করে রাত ১২টার দিকে ব্যাটারি গলির মুখে আসেন। সেখান থেকে বাড়ি যাওয়ার জন্য শাহ আমানত ব্রিজ পর্যন্ত যেতে গাড়ি খুঁজছিলেন। তখন একটি মোটরসাইকেল এসে তাকে পেছনে বসার জন্য বললে তিনি উঠে পড়েন। মোটরসাইকেল চলতে শুরু করলে সে বলে, আপনি আমাকে নিয়ে যাচ্ছেন, কোথায় যাব সেটাও তো জিজ্ঞেস করলেন না? পরে ড্রাইভারকে সে শাহ আমানত ব্রিজে নিয়ে যেতে বলে এবং ১০০ টাকা ভাড়া নির্ধারণ হয়।’

‘কিছুদূর যাওয়ার পর মোটরসাইকেল স্লো করে ফেলে চালক, তখন কালো লম্বা একজন লোক পেছনে বসে পড়ে। মাঝখানে থাকা সারোয়ার কিছু বলার চেষ্টা করলে তাকে একটি কাপড় জড়িয়ে দেয় এবং সে অজ্ঞান হয়ে যায়। পরে তাকে একটি অ্যাম্বুলেন্সে করে অজ্ঞাতস্থানে নিয়ে যায়। সেটা সে জ্ঞান ফেরার পর বুঝতে পারে।’

সারোয়ার বুধবার নিখোঁজ হলেও জিডিতে বৃহস্পতিবার উল্লেখের বিষয়ে জুবায়ের সিদ্দিকী বলেন, ‘আমি শুনেছিলাম বৃহস্পতিবার সকাল থেকে তাকে পাওয়া যাচ্ছে না। উদ্ধারের পর এখন সারোয়ার বলছে, তাকে আগের রাতেই তুলে নেওয়া হয়েছিল।’

নিখোঁজের পর তদন্তে পাওয়া প্রাথমিক তথ্য উল্লেখ করে নগর পুলিশের এক কর্মকর্তা সারাবাংলাকে বলেন, ‘ব্যাটারি গলিতে গোলাম সারোয়ারের বাসার পাশের এক মহিলা আমাদের জানিয়েছিলেন, বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে নয়টার দিকে তাকে বাসা থেকে বেরিয়ে যেতে দেখেছেন তিনি। এই তথ্যের সত্যতা আমরা নিশ্চিত করতে পারিনি।’

গোলাম সারোয়ার সারাবাংলাকে জানিয়েছেন, তুলে নেওয়ার পর তাকে যেখানে রাখা হয়েছিল সেখান থেকে তিনি ট্রেনের হুইসেল শুনেছেন। ট্রেন চলাচলের আওয়াজ শুনেছেন। জিম্মি অবস্থায় তাকে সার্বক্ষণিকভাবে চোখ বেঁধে রাখা হয়েছে। এছাড়া তার কানে হেডফোন জাতীয় কিছু গুঁজে দেওয়া হয়। তবে এরপরও তাকে মারধরের সময় চারজনের উপস্থিতির বিষয়ে নিশ্চিত হওয়ার পাশাপাশি তাদের কিছু কথোপকথন শুনেছেন বলে জানিয়েছেন তিনি।

তিনি বলেন, ‘আমাকে দুইদিন ধরে মারধর করেছে। আর নিউজ করবি কি না বল?- এটা বলে মারধর করতো। শুধু একটাই কথা- আর নিউজ করবি কি না বল? চামড়ার বেল্ট, তক্তা জাতীয় কিছু দিয়ে মারধর করতো। আমার পুরো শরীর ব্যাথা। ভাত খেতে দেয়নি। হাতের মধ্যে একটা বনরুটি (পাউরুটি) ঢুকিয়ে দিত আর পানি দিত।’

কোন নিউজের জন্য মারধর করা হয়েছে সে বিষয়ে কোনো ধারণা করতে পারছেন কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সেটা তারা বলেনি। শুধু বলত- আর নিউজ করবি কি না বল? তোদের সাংবাদিকদের কোনো নিরাপত্তা নাই, তোরা কী করতে পারবি?’

নির্যাতনকারী এবং তাদের কথোপকথনের বিষয়েও তথ্য দেন সারোয়ার। তিনি বলেন, ‘তাদের কথাবার্তা ও মারধর দেখে মনে হয়েছে তারা প্রফেশনাল। অনেক বড় প্রফেশনাল। আমাকে দুইদিনে মাত্র দুবার মেরেছে। মারধর দেখে আমি বুঝে যাই, তারা অনেক বড় প্রফেশনাল। ওরা চারজন ছিল। চারজনের একজন চট্টগ্রামের ভাষায়, অন্যরা ঢাকাইয়া ভাষায় কথা বলতো। তারা টেলিফোনে কথা বলেছে- স্যার রাখব নাকি ফেলে দেবো?– ফেলতে হবে না, তারে দিয়ে অন্যদের থ্রেট (হুমকি) দেওয়া দরকার। সে ত্যানাফাডা (ছোটখাট) সাংবাদিক, তাকে কেন মারবি? তারে আনা হয়েছে কারণ, সে বেশি উড়ছে সেজন্য। তারা অনেক উচ্চস্বরে কথা বলতো।’

তিনি জানান, জিম্মি অবস্থা থেকে মুক্তি দেওয়ার আগে তাকে জোর করে ‍ঘুমের ওষুধ খাওয়ানো হয়।

সারোয়ার জানালেন, তিনি মানসিকভাবে খুবই বিপর্যস্ত। চারদিন ধরে ঘুমাননি। গত (রোববার) রাতেও ঘুম হয়নি। তিনি এই ঘটনা নিয়ে মামলা-মোকদ্দমা করতে চান না।

সারোয়ারের শারীরিক অবস্থা নিয়ে চিকিৎসকেরা গণমাধ্যমে কথা বলতে রাজি হননি। তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে চমেক হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের একজন চিকিৎসক বলেন, ‘উনার (গোলাম সারোয়ার) শারীরিক অবস্থা স্থিতিশীল আছে। রক্তচাপও একেবারে স্বাভাবিক। মানসিক অবস্থাও উন্নতির দিকে। তবে উনাকে মারধর করা হয়েছে। মারধরের কারণে বড় কোনো ইনজুরি দেখছি না। এরপরও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হচ্ছে।’

আজকের সূর্যোদয় পত্রিকার ব্যুরো প্রধান জুবায়ের সিদ্দিকী সারাবাংলাকে বলেন, ‘বড় কুমিরা এলাকায় স্থানীয় লোকজন যখন তাকে পায়, তখন সে (সারোয়ার) আমার নাম ও মোবাইল নম্বর সঠিকভাবে বলেছে। আমি এবং ওসি মহসীন সাহেবের কাঁধে ভর দিয়ে পায়ে হেঁটেই সে গাড়িতে উঠেছে। হাসপাতালে ঢোকার সময়ও হেঁটে ঢুকেছে। তাকে পেটানো হয়েছে। কিন্তু আঘাতের চিহ্ন শরীরে খুব বেশি আমি দেখিনি।’

সারোয়ারের বক্তব্যসহ সামগ্রিক বিষয়ে জানতে চাইলে নগর পুলিশের কোতোয়ালি জোনের সহকারী কমিশনার নোবেল চাকমা সারাবাংলাকে বলেন, ‘গোলাম সারোয়ার এখনও চিকিৎসাধীন আছেন। উনাকে আমরা ফরমালি জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারিনি। বিচ্ছিন্নভাবে ওসি কিছু কথা বলেছেন। তবে উনি (সারোয়ার) একেক সময় একেক বক্তব্য দিচ্ছেন। মিডিয়ায়ও আমরা নানা বক্তব্য দেখছি। সব বক্তব্য আমরা সংগ্রহ করছি। উনাকেও জিজ্ঞাসাবাদ করব। পরে সেগুলো আমরা অ্যানালাইসিস করব।’

তিনি বলেন, ‘গোলাম সারোয়ার তাকে অপহরণ করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন। নিশ্চয় এ বিষয়ে তিনি বা তার পরিবারের পক্ষ থেকে মামলা করা হবে। মামলা তদন্তে সবকিছুই পরিস্কারভাবে বেরিয়ে আসবে।’

গোলাম সারোয়ার টপ নিউজ থ্রেট পেশাদার সাপ্তাহিক আজকের সূর্যোদয় সাংবাদিক নির্যাতন সিটিনিউজবিডি

বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ

কানপুরে প্রথম দিনে বৃষ্টির দাপট
২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১৬:৩৫

সম্পর্কিত খবর