Sunday 08 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

পুলিশের চোখে পলাতক, অথচ জামিন নিতে হাইকোর্টে ধর্ষণ মামলার আসামি


২ নভেম্বর ২০২০ ২৩:৩৭

ঢাকা: গত ১৫ দিন ধরে পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন পূর্বাশা টেক্সট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ইঞ্জিনিয়ার আলী হোসেন। পুলিশের দাবি, ধর্ষণ ও ভ্রূণ হত্যার অভিযোগে মামলা হওয়ার পর ওই আসামি ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়েছে। তাকে ধরতে সম্ভাব্য বিভিন্ন জায়গায় অভিযান চালানো হয়েছে। পুলিশের ‘শক্ত অভিযানের’ পরও আসামিকে ধরা যায়নি।

পুলিশের চোখে নিখোঁজ থাকলেও এই আসামি দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছেন রাজধানী ঢাকা শহরে। এমনকি আত্মগোপনে থাকা এই আসামি রোববার (১ নভেম্বর) স্বশরীরে গেছেন হাইকোর্টে। সেখানে হাইকোর্টের আইনজীবী শাহিনুর আলম শহীদের চেম্বারে গিয়ে আগাম জামিন আবেদনের ফাইলে সই করেছেন। আগাম জামিন নিশ্চিত করতে ওই আসামি উচ্চহারে টাকাও বিনিয়োগ করেছেন উকিলের দরবারে।

আসামির ঘনিষ্ঠ সূত্র সারাবাংলাকে জানিয়েছে, ১ নভেম্বর হাইকোর্টে সারাদিনই ছিলেন আসামি আলী হোসেন। ওইদিন তার হাতে মোবাইল ফোনও ছিল হাইকোর্টের ৬ নম্বর বেঞ্চে বিচারপতি হাসান আরিফ ও বিচারপতি খন্দকার দিলুরুজ্জাসানের আদালতে জামিন আবেদন জমা দিয়েছেন আইনজীবীর মাধ্যমে। দুই একদিনের মধ্যে ওই আবেদনের শুনানি অনুষ্ঠিত হতে পারে।

আরও পড়ুন: ধর্ষণ মামলার পর পলাতক পূর্বাশা’র এমডি, পাশে আছেন ‘গুণধর’ ২ ছেলে

সূত্র আরও জানিয়েছে, পুলিশের চোখ ফাঁকি দিতে আগের তিনটি মোবাইল নম্বরই বন্ধ রেখেছেন আলী হোসেন। তবে মামলা ও ব্যবসা সংক্রান্ত যোগাযোগের জন্য নতুন নম্বর ব্যবহার করছেন তিনি। পলাতক থাকা অবস্থায়ই ব্যবসা দেখভাল করছেন। এমনকি তার পরিবার সদস্যদের সঙ্গেও সুযোগ বুঝে যোগাযোগ করছেন তিনি। এ ছাড়া দুই ছেলে নাসির আল হোসেন সুজন ও নায়েমুল আলী হোসেন শোভনের সঙ্গেও যোগাযোগ রয়েছে আলী হোসেনের।

আলী হোসেনের পারিবারিক সূত্র জানিয়েছে, আলী হোসেনকে মামলার ঝামেলা থেকে বাঁচাতে দায়িত্ব নিয়েছেন তার দুই ছেলে নাসির আল হোসেন সুজন ও নায়েমুল আলী হোসেন শোভন। এ ছাড়া ভালুকার স্থানীয় কয়েকজন রাজনৈতিক নেতাকেও হাতে রেখেছেন আলী হোসেন। তারা আলী হোসেনের পক্ষে ঢাকার লবিং জোরালো করছেন। এ ছাড়া আলী হোসেনের পক্ষে রয়েছে ভালুকার কয়েকজন ধনাঢ্য ব্যবসায়ীও।

যেভাবে পলাতক আলী হোসেন: মামলার বিষয়টি টের পেয়ে পুলিশের চোখ এড়াতে আত্মগোপনে যান আলী হোসেন। তাকে আত্মগোপনে যেতে সহযোগিতা করেন আলী হোসেনের স্বজনরা। আলী হোসেনকে এলাকায় দেখেছেন এমন কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শী জানান, ১৯ অক্টোবর উত্তরা পশ্চিম থানায় মামলা হওয়ার পর ওইদিনই ঢাকা থেকে গ্রামের বাড়ি ভালুকার জামিরদিয়া (মাস্টারবাড়ি) যান আলী হোসেন। সেখানে পূর্বাশা সিএনজি স্টেশন নামে একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানও আছে তার। এলাকায় গিয়ে আলী হোসেন সিএনজি ফিলিং স্টেশনের ব্যবসাও তদারকি করেন। এমনকি ওই ফিলিং স্টেশনে বসে সময়ও কাটান তিনি।

জানা যায়, পরে বড় ছেলে সুজনের পরামর্শে ভালুকা থেকে চলে যান তিনি। তাকে ধরতে ভালুকায় অভিযানও চালিয়েছে পুলিশ। তবে তার আগেই তিনি সটকে পড়েন। ভালুকা থেকে এরপর আবার ঢাকায় চলে আসেন আলী হোসেন। তার চিন্তা পুলিশের কাছে ধরা না দিয়ে আগাম জামিনের মাধ্যমে জেলহাজতে যাওয়া থেকে বিরত থাকা। এ জন্য মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে আইনজীবীকে হাত করেছেন ওই ব্যবসায়ী।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আলী হোসেন আত্মগোপনে যাওয়ার পর ঢাকায় ব্যবসা দেখাশোনার দায়িত্ব নিয়েছেন তার ছোট ছেলে শোভন ও ময়মনসিংহে ব্যবসা দেখাশোনা করছেন তার বড় ছেলে সুজন। এর মধ্যে আলী হোসেনের বড় ছেলে সুজন দায়িত্ব নিয়েছেন ঢাকার ঝামেলা মোকাবিলার জন্য। পাশাপাশি স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের মাধ্যমে বাদীর পরিবারকে হুমকি-ধমকি দিচ্ছেন তিনি। এ জন্য বিভিন্ন লোক ধরাধরি শুরু করেছেন সুজন। এদের মধ্যে কয়েকজন শিল্পপতি-ব্যবসায়ীও রয়েছেন, যারা মামলার বাদী ও হুমকি-ধমকির পাশাপাশি তাদের প্রভাবিত করার চেষ্টা করছেন।

আলী হোসেনের ঘনিষ্ঠ সূত্র আরও জানিয়েছে, হাইকোর্টে জামিন আবেদন ফাইল করার পর ঢাকাতেই পরিচিতজনদের বাসাতেই রয়েছেন তিনি। উত্তরার বাসায় অভিযান চালাতে পুলিশ এমন ভয়ে ওই বাসাতে থাকছেন না তিনি। আলী হোসেন আত্মগোপনে থেকে প্রকাশ্যে আসবেন কী না তা নির্ভর করছে আগাম জামিনের ওপর।

ধর্ষণ ও ভ্রূণ হত্যার অভিযোগ আলী হোসেনের বিরুদ্ধে: ব্ল্যাকমেইলিং ও ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে ভিকটিমকে আড়াই বছর ধরে জিম্মি করে রাখেন আলী হোসেন। সংসার ও সন্তানের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে ওই নারী মুখ খুলতে পারেননি। যখনই আলী হোসেনকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করেছেন তখন হুমকি দিতেন ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়ার। হুমকি দিতেন মাদকের মিথ্যা মামলায় মেয়েকে ফাঁসানোর।

আরও পড়ুন: ভিডিও ছড়ানোর ভয় দেখিয়ে ধর্ষণ, আত্মগোপনে পূর্বাশা’র এমডি

এক পর্যায়ে নিপীড়নের মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় আলী হোসেনের বিরুদ্ধে ওই নারী উত্তরা পশ্চিম থানায় মামলা করেন। মামলা নম্বর: ২৫। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন (সংশোধন) অধ্যাদেশ ২০২০ এর ৯(১) সহ ৩১৩/৫০৬ পেনাল কোড ধারায় মামলাটি দায়ের করা হয়।

মামলার এজাহারে ওই নারী উল্লেখ করেছেন, তিনি একটি প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি করতেন। গার্মেন্টস পণ্য প্রতিষ্ঠান পূর্বাশা গ্রুপের এমডি আলী হোসেন ওই কোম্পানির করপোরেট গ্রাহকদের মধ্যে একজন। সেই সূত্রে তার সঙ্গে পরিচয় হয়। এরপর ২০১৮ সালের ১৯ জুন প্রথম ৭ নম্বর সেক্টরের লেক ড্রাইভ রোডের ৬৮ নম্বর বাসার ষষ্ঠ তলায় বিকেল ৫টায় সাক্ষাৎ হয়। ওইদিন তার সঙ্গে ব্যবসা সংক্রান্ত কথা হয়। কথা বলার একপর্যায়ে আলী হোসেন তাকে জাপটে ধরেন। নিজেকে বাঁচাতে ওই নারী চেষ্টা করেন। ওই সময় চেয়ারে ব্যথা পেয়ে ওই নারী পড়ে যান। পায়ে আঘাত পেলেও আলী হোসেন তাকে প্রথম দফায় ধর্ষণ করেন।

এরপর ২০১৮ সালের ৫ জুলাই ওই নারীকে ফোন করে জানায়, ১৯ জুনের ঘটনার ছবি ও ভিডিও করা হয়েছে। কথামতো না চললে তার কাছে থাকা ছবি ও ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া হবে। পাশাপাশি তার স্বামীকেও বিষয়টি জানিয়ে দেওয়া হবে। এরপর ২০১৮ সালের ২১ জুলাই তার অফিসে ওই নারী জানান, তার শারীরিক অবস্থা খারাপ। এরপর ওই নারীকে হাসপাতালে নিয়ে প্রেগনেন্সি টেস্ট করান আলী হোসেন। এরপর চাপ দিয়ে নারীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে ভ্রূণ নষ্ট করেন আলী হোসেন। এর পাঁচ মাস পর একই বছরের ১৬ ডিসেম্বর বিকেল ৫টায় পুনরায় ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে নারীকে ফের ধর্ষণ করেন আলী হোসেন। এরপর ২০১৯ সালের ১ জুলাই বিকেল ৪টার দিকে ছবি ও ভিডিও স্বামীর কাছে পাঠানোর ভয় দেখিয়ে আবারও ধর্ষণ করেন। ২০১৯ সালের ৬ আগস্ট প্রেগনেন্সি পজেটিভ ধরা পড়লে আবারও মানসিক চাপ দিয়ে গর্ভপাত করায় আলী হোসেন।

এরপর চলতি বছরের ২ ফেব্রুয়ারি দুপুর সাড়ে ১২টায়, ৬ মার্চ ও ১৩ মার্চ বিকেল সাড়ে ৪টায় ভয়ভীতি দেখিয়ে ওই নারীকে ধর্ষণ করে। তার কথামতো না চলায় প্রায় সময়ই বিভিন্ন মোবাইল নম্বর থেকে হুমকি-ধমকি দিচ্ছেন আলী হোসেন। তার কাছে থাকা ছবি ও ভিডিও স্বামীর কাছে পাঠিয়ে দেওয়ার জন্য হুমকি দিচ্ছেন।

মামলার পর হুমকিও দেওয়া হচ্ছে বাদীকে: এ দিকে মামলা হওয়ার পর গত ১৫ দিন ধরে মামলার বাদীকে হুমকি-ধমকি দেওয়া হচ্ছে বলে সারাবাংলাকে জানিয়েছেন ভিকটিম। তিনি বলেন, ‘ওই লম্পট আলী হোসেন আমাকে জিম্মি করে দফায় দফায় ধর্ষণ করেছে। তার কারণে আমি মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছি। আমি তার সর্বোচ্চ শাস্তি চাই। সে আমার সংসার নষ্ট করেছে। আমার সন্তানের ভবিষ্যত নষ্ট করেছে। তার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া দরকার।’

আরও পড়ুন: ৩ বছর ধরে ধর্ষণ, পূর্বাশা গ্রুপের এমডির বিরুদ্ধে মামলা

তবে সামাজিকভাবে তাকে আলী হোসেনের লোকজন তাকে মানসিক চাপে রেখেছে। পাশাপাশি পুলিশের তদন্তকে প্রভাবিত করতে সব ধরনের চেষ্টা করছেন বলে অভিযোগ মামলার বাদী।

ভিকটিম নারী বলেন, ‘আমার সন্তানকে অপহরণ করার হুমকি দেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি আলী হোসেনের লোকজন আমাকে নানা ভয়-ভীতি দেখাচ্ছে। একজন বিচার প্রত্যাশী নারীর জন্য এই লড়াইয়ের পথটি অনেক কঠিন।’

যা বলছে পুলিশ: এদিকে পুলিশের দাবি আলী হোসেনকে ধরতে শক্ত অভিযান চালানো হয়েছে। তাকে ধরতে সব ধরনের প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।

আসামি স্বশরীরে জামিন নিতে হাইকোর্টে গেছেন উল্লেখ করলে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা বলেন, ‘আমরা অনেক জায়গায় অভিযান চালিয়েছি। ওই আসামিকে পাইনি।’ এ বিষয়ে বিস্তারিত জানার জন্য ওসিকে ফোন দিতে বলেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা। তিনি বলেন, ‘সবচেয়ে বড় কথা হলো আমার মা অসুস্থ। আমি এখন হাসপাতালে আছি।’

এদিকে উত্তরা পশ্চিম থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) তপন চন্দ্র সাহা বলেন, ‘আসামি তার মোবাইল ফোনগুলো বন্ধ রেখেছেন। ঢাকা শহরে দুই কোটি মানুষ। কেউ আত্মগোপনে থাকলে তো তাকে খুঁজে পাওয়া কঠিন।’

তবে আসামিকে ধরতে সব ধরনের চেষ্টা চালানো হচ্ছে বলে থানার ওসি জানান।

ধর্ষণ মামলায় আগাম জামিন নয়, আপিল বিভাগের রায়: হত্যা, ডাকাতি, ধর্ষণের মতো গুরুতর ও সুনির্দিষ্ট অপরাধের মামলার আসামিদের আগাম জামিন দেওয়া যাবে না বলে গত বছর নির্দেশনা দিয়ে রায় দেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ।  সর্বোচ্চ আদালত বলেছে, হাইকোর্ট কেবল ‘ব্যতিক্রমী মামলায়’ কোনো ব্যক্তিকে জামিন দিতে পারবে, তবে তা আট সপ্তাহের বেশি নয়, যা আগে ছিল চার সপ্তাহ। তবে মামলার অভিযোগপত্র দাখিল হলে এ জামিন আর চলবে না।

প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের সাত বিচারপতির বেঞ্চ ১৬টি নির্দেশনা দিয়ে এ রায় দেন।

রায়ে বলা হয়, হত্যা, ডাকাতি, ধর্ষণের মতো গুরুতর অপরাধের মামলায় সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকলে কখনোই আগাম জামিন দেওয়া যাবে না। কারণ আগাম জামিন দেওয়ার বিষয়টি একটি ব্যতিক্রমী ক্ষমতা। এ ক্ষমতা ব্যবহারের ক্ষেত্রে হাই কোর্টকে সতর্ক থাকতে হবে।

আলী হোসেন জামিন টপ নিউজ পলাতক আসামি পূর্বাশা এমডি হাইকোর্ট


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর