করোনার দ্বিতীয় ঢেউ, পোশাক নিয়ে ফের শঙ্কা
৫ নভেম্বর ২০২০ ২০:২৯
ঢাকা: ইউরোপসহ বহির্বিশ্বে করোনা সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ চলছে। আর এর প্রভাব পড়তে শুরু করেছে বাংলাদেশের পোশাক খাতে। এরই মধ্যে কোনো কোনো ক্রেতা উৎপাদন শুরু না হওয়া ক্রয়াদেশ আপাতত স্থগিত রাখার পরামর্শ দিচ্ছে। আবার কিছু ক্রেতা তাদের আউটলেট বা দোকান বন্ধ হয়ে যাওয়ার তথ্য মেইলে জানিয়ে দিচ্ছেন। পোশাক মালিকরা বলছেন, খাতটিতে করোনা সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউয়ের প্রভাব মধ্য নভেম্বরে স্পষ্ট বোঝা যাবে। তবে অক্টোবরের মতো আগামী মার্চ পর্যন্ত পোশাক রফতানি আয়ে নেতিবাচক প্রবণতা থাকতে পারে বলে আশঙ্কা তাদের।
করোনার প্রভাবে গত মার্চ থেকে পোশাক খাতের রফতানি কমতে শুরু করে। এপ্রিলে যা ভয়াবহ রূপ ধারণ করে এবং মে মাসেও তা অব্যাহত ছিল। তবে জুন থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে পোশাক খাত। এর ধারাবাহিকতা জুলাই, আগস্ট এমনকি সেপ্টেম্বরেও অব্যাহত ছিল। তবে অক্টোবরে শেষে এ খাতের আয় হোঁচট খায়। ইপিবির তথ্য বলছে, ২০২০-২১ অর্থবছরের জুলাই-অক্টোবর সময়ে তৈরি পোশাক রফতানি করে বাংলোদেশ আয় করেছে এক হাজার ৪৫ কোটি ডলার। যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে দশমিক ৮৯ শতাংশ এবং আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে ১ দশমিক ২ শতাংশ কম। গত অর্থবছরের একই সময়ে এ খাতের আয় পরিমাণ ছিল ১ হাজার ৫৭ কোটি ৭৩ লাখ ডলার।
রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য মতে, চলতি বছরের মার্চে ২২৫ কোটি মার্কিন ডলারের পোশাক পণ্য রফতানি হয়, যা আগের বছরের তুলনায় ২০ শতাংশ কম। আর এপ্রিলে রফতানি আয় গিয়ে ঠেকে প্রায় তলানিতে। মাসটিতে ৩৭ কোটি মার্কিন ডলারের পোশাক রফতানি হয়, যা আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে ৮৫ শতাংশ কম। যদিও মে মাসে এই আয় বেড়ে দাঁড়ায় ১২৩ কোটি মার্কিন ডলারে। কিন্তু সেটাও আগের বছরের চেয়ে ৬২ শতাংশ কম। চলতি বছরের জুনে এই আয় বেড়ে ২২৪ কোটি মার্কিন ডলারে দাঁড়িয়েছে। তারপরও পোশাক রফতানি আগের বছরের চেয়ে ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধিতে রয়েছে। জুন মাসে এই ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি ছিল ৬ শতংশের মতো।
মন্তব্য জানতে চাইলে বাংলাদেশ তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রফতানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট ফয়সাল সামাদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘করোনার দ্বিতীয় ঢেউ নিয়ে আমরা শঙ্কায় আছি। কিছু শিপমেন্ট পিছিয়ে যাচ্ছে। কোনো কোনো শিপমেন্ট তিন মাস পর্যন্ত পিছিয়েছে। এতে ক্যাশফ্লোতে একটা প্রভাব পড়বে। এজন্য আমরা প্রণোদনার অর্থ পরিশোধে সময় বাড়ানোর আবেদন করেছি। কারণ রফতানি তো পিছিয়ে যাচ্ছে। রফতানি করেই তো আমরা আয় করি।’
এ বিষয়ে বিজিএমইএ’র পরিচালক (শ্রম) রেজওয়ান সেলিম সারাবাংলাকে বলেন, ‘পোশাক খাতের অবস্থান এখন অনেক ভালো। সব ফ্যাক্টরিতেই অনেক কাজ রয়েছে। সেপ্টেম্বর-অক্টোবরেও বেশ ভালোই রফতানি আয় এসেছে। নভেম্বরেও খারাপ হবে বলে মনে হয় না। তবে বহির্বিশ্বে ফের লকডাউনের কারণে ডিসেম্বর ও জানুয়ারিতে রফতানি আয় কমে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে। সবচেয়ে খারাপ অবস্থা হবে সোয়েটারের ক্ষেত্রে। এমনিতেই এখন কাজ ও অর্ডার না থাকার সময়। প্রতিবছরই নভেম্বর-ডিসেম্বরে সোয়েটারের মালিকরা বেতন-ভাতা দিতে পারেন না। এবার সোয়েটারের ক্ষেত্রে আরও খারাপ অবস্থা তৈরি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।’
নিট গার্মেন্টস ব্যবসায়ীদের সংগঠন বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফেকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) প্রথম সহসভাপতি মোহাম্মদ হাতেম সারাবাংলাকে বলেন, ‘সেকেন্ড ওয়েবের কারণে নতুন করে অর্ডার স্থগিত হচ্ছে। সামারকে কেন্দ্র করে যেসব অর্ডার আসছিল এখন আর সেগুলো প্লেস হচ্ছে না। ফলে নভেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত রফতানি আয়ে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। কিছু বায়ার এরই মধ্যে মেইল দিয়ে বলেছে, যেসব অর্ডারের ফেব্রিক এখনও কারখানায় যায়নি সেই কাজ বন্ধ রাখতে। আবার কোন কোন বায়ার জানিয়েছে, তাদের স্টোরগুলো বন্ধ হয়ে গেছে। এর মাধ্যমে তারা নতুন অর্ডার স্থগিত রাখার কথা কৌশলে জানাচ্ছে। অর্থাৎ করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়েও পোশাক রফতানিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।’
মন্তব্য জানতে চাইলে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সহসভাপতি ও বিজিএমইএ’র সাবেক সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান সারাবাংলাকে বলেন, ‘করোনা দ্বিতীয় ঢেউয়ের প্রভাব এরই মধ্যে পড়তে শুরু করেছে। এখন কিন্তু অনেকেই অর্ডার হোল্ড করা শুরু করেছে। হয়তো আমরা আবারও ধাক্কা পেতে পারি। নভেম্বরের মাঝমাঝি সময়ে বোঝা যাবে করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের প্রভাব কতটুকু পড়েছে। তবে রফতানি খাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।’
এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ইএবি) সভাপতি ও বিজিএমইএ’র সাবেক সভাপতি আব্দুস সালাম মুর্শেদী সারাবাংলাকে বলেন, ‘করোনার দ্বিতীয় ঢেউ এসে গেছে। সেটা কোনোভাবেই আমাদের জন্য সুখবর নয়। ফ্রান্স ও ইউরোপ আমাদের সবচেয়ে বড় মার্কেট। আমরা যে অর্ডার পেয়েছি সেগুলো মৌসুমি। সেকেন্ড ওয়েবের কারণে লকডাউন শুরু হলে অনেক স্টোর বা দোকান বন্ধ হয়ে যাবে। তখন ওই পণ্যের ক্রেতা কমে যাওয়াটাই স্বাভাবিক। এতে অনেক অর্ডার ডেফার্ড বা হোল্ড হয়ে যেতে পারে। অর্থাৎ আবার একটি চ্যালেঞ্জ বা দুঃসংবাদ আমরা দেখতে পাচ্ছি। তবে আমরা ক্রেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছি, ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছি। কিন্তু নিষ্ঠুর বাস্তবতাও আমাদের মেনে নিতে হবে।’
বাংলাদেশ গার্মেন্ট বায়িং হাউজ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি কাজী ইফতেখার হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, ‘প্রভাব তো পড়বেই। কারণ পোশাক খাতে বাংলাদেশ ইউরোপের ওপর নির্ভর করে। সেখানে লকডাউন শুরু হচ্ছে। তবে এখনও সেই জায়গায় আসেনি। ওর্ডার কোয়ানটিটি কমবে। বায়াররা নিজেরা শঙ্কিত, সেটা বড় বিষয়। তারা নিজেরা চিন্তিত। কারণ, তাদেরও তো ব্যবসা করতে হবে। তারাতো আর পোশাক কিনে বসিয়ে রাখবে না। তবে কতটুকু প্রভাব পড়ছে বা পড়বে তা এখনও বলার সময় আসেনি। কিছু একটা প্রভাব পড়বে, বড় হোক কিংবা ছোট।’