Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

চট্টগ্রামে নিউমার্কেট মোড় অবরোধ করে বিক্ষোভ, লংমার্চের হুঁশিয়ারি


৭ নভেম্বর ২০২০ ১৬:১৭

চট্টগ্রাম ব্যুরো: ধর্ম অবমাননার কল্পিত অভিযোগ তুলে সংখ্যালঘুদের বাড়িঘরে হামলাসহ সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস বন্ধের দাবিতে চট্টগ্রাম নগরীর প্রাণকেন্দ্র নিউমার্কেট মোড় অবরোধ করে বিক্ষোভ সমাবেশ করেছে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ। এসময় পরিষদের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্ত হামলা-সন্ত্রাস বন্ধ না হলে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় লংমার্চের কর্মসূচি দেওয়া হবে বলে হুঁশিয়ার করেন।

বিজ্ঞাপন

ঐক্য পরিষদের পূর্বঘোষিত কর্মসূচির অংশ হিসেবে শনিবার (০৭ নভেম্বর) সকাল ১০টার দিকে নিউমার্কেট মোড়ে জড়ো হন সংগঠনের নেতাকর্মীরা। নগরীর বিভিন্ন এলাকা থেকে খণ্ড খণ্ড মিছিল এসে যোগ দেয় নিউমার্কেট মোড়ের কর্মসূচিতে। সকাল ১১টা পর্যন্ত নিউমার্কেট মোড়ের পূর্বপ্রান্ত অবরোধ করে বিক্ষোভ কর্মসূচি চলে। তখন ওই মোড় থেকে কোতোয়ালী মোড়ের দিকে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।

সকাল ১১টার পর থেকে জনসমাগম বাড়তে থাকে। কয়েক হাজার লোকের উপস্থিতিতে নিউমার্কেট মোড়ের চারপাশ একপর্যায়ে অবরুদ্ধ হয়ে যায়। তখন নিউমার্কেট মোড় থেকে সদরঘাট, স্টেশন রোড, রিয়াজউদ্দিন বাজারের দিকের সড়কেও যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এসব সড়কের আশপাশের এলাকায় যানজট তৈরি হয়। ঘটনাস্থলে পুলিশ মোতায়েন থাকলেও সড়কে অবস্থান নেওয়া ঠেকাতে তাদের বাধা দিতে দেখা যায়নি।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে নগর পুলিশের সহকারি কমিশনার (কোতোয়ালী জোন) নোবেল চাকমা সারাবাংলাকে বলেন, ‘সড়কে অবস্থান নিলেও তারা কোনো বিশৃঙ্খলা করেনি। গাড়ি চলাচলে বাধা দেয়নি। তবে লোকজন বেশি হওয়ায় গাড়ি চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। প্রায় একঘন্টার মতো নিউমার্কেট মোড় দিয়ে যানবাহন চলাচল করতে পারেনি। শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখার স্বার্থে আমরা চেয়েছিলাম- তারা নির্বিঘ্নে সমাবেশ করে ফিরে যাক। সমাবেশ শেষে তারা বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের সামনে যান।’

সমাবেশে যুব ঐক্য পরিষদ, চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী বিজয়া সম্মিলন পরিষদ, বৌদ্ধ কৃষ্টি প্রচার সংঘ, জন্মাষ্টমী উদযাপন পরিষদ, মাইনোরিটি ওয়াচ, জলদাস ফেডারেশন, হিন্দু ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন, বাংলাদেশ বৌদ্ধ সমিতি, সনাতন বিদ্যার্থী সংসদ, শারদাঞ্জলী ফোরাম, হিন্দু মহাজোটসহ অর্ধশতাধিক সংগঠনের নেতাকর্মীরা উপস্থিত ছিলেন। তাদের অনেকের হাতে ‘সংখ্যালঘুর ওপর হামলা, সইবে না বাংলা’ ‘রক্তাক্ত বাংলা’ ‘বীর বাঙালি জেগে ওঠো’ ‘ধর্ম অবমাননার মিথ্যা অভিযোগে ছাত্রত্ব বাতিল করা যাবে না- জেলে নেওয়া যাবে না’ – এ ধরনের বিভিন্ন প্ল্যাকার্ড ছিল। কর্মসূচি চলাকালে বিভিন্ন স্লোগানে মুখর হয়ে ওঠে পুরো এলাকা।

বিজ্ঞাপন

সমাবেশে সংহতি জানিয়ে বক্তব্য রাখেন একুশে পদকপ্রাপ্ত কবি ও সাংবাদিক আবুল মোমেন। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ এ বছর স্বাধীনতার মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশত বর্ষ উদযাপন করছে। আগামীবছর বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী। সুবর্ণজয়ন্তীর প্রাক্কালে দাঁড়িয়ে আমরা কখনও ভাবিনি যে এরকম একটি সমাবেশে আমাদের দাঁড়াতে হবে। বঙ্গবন্ধুর দল আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আছে। অথচ আমরা সংবিধানে যেসব সাম্প্রদায়িক পরিবর্তন বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর আনা হয়েছিল, সেগুলো বাদ দিয়ে স্বাধীনতার চেতনায় আমরা ফেরত যেতে পারিনি। স্বাধীনতার আগে পাকিস্তান আমলে যে সাম্প্রদায়িক চেতনার উত্থান ঘটানোর চেষ্টা হয়েছিল, স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর যে চেষ্টা হয়েছিল, আজ দেশ আবারও সেই সাম্প্রদায়িক চেতনায় ফিরে গেছে, আমরা দেখতে পাচ্ছি।’

তিনি বলেন, ‘দেশের বিভিন্ন জায়গায় ধর্মের কথা বলে সংখ্যালঘুদের বাড়িঘরে আক্রমণ করা হচ্ছে। এমনকি মানুষকে পুড়িয়ে মারা হচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীন হওয়া বাংলাদেশে আমরা এটা কল্পনাও করতে পারি না। আজ ধর্মান্ধ গোষ্ঠী শুধু সংখ্যালঘুদের বাড়িঘরেই হামলা করছে না, এই হামলা যারা গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ চায়, যারা অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ চায়, যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাংলাদেশ চায় তাদের ওপরও হামলা।’

আবুল মোমেন দেশের শুভবোধসম্পন্ন সকল শক্তিকে এক হওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমরা একটি মানবিক বাংলাদেশ চেয়েছিলাম। আমরা একটি সম্প্রীতির বাংলাদেশ চেয়েছিলাম। কিন্তু আজ আমরা দেখছি সম্প্রীতির বদলে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা অতীতের চেয়ে আরও বেড়েছে। মানবিকতার বদলে নারীদের ওপর বরং নির্যাতন বেড়েছে। আমরা সামাজিক অবক্ষয়ের চূড়ান্ত অবস্থায় পৌঁছে গেছি। তাই হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, সকল ধর্মের-সকল জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে থাকা মানবিক চেতনার মানুষগুলোকে এক হয়ে আজ প্রতিবাদ করতে হবে।’

সমাবেশে রানা দাশ গুপ্ত বলেন, ‘দেশকে সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র বানানোর চক্রান্ত আমরা দেখছি। ধর্ম অবমাননার কথিত অভিযোগ তুলে ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বাড়িঘরে, মঠমন্দিরে হামলা করা হচ্ছে। শুধু সংখ্যালঘুদের ওপরই নয়, অতিসম্প্রতি আমরা দেখেছি, কথিত ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে লালমনিরহাটে একজন ধর্মপ্রাণ মুসলমানকেও হত্যা করে পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে। আমরা সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ২০১১ সাল থেকে রাজনৈতিক ও সামাজিক সাম্প্রদায়িতকতার শিকার হচ্ছি। ফেসবুক হ্যাক করে, ভূয়া স্ক্রিণশট তৈরি করে উদ্দেশ্যমূলকভাবে ধর্ম অবমাননার মিথ্যা গুজব রটিয়ে কক্সবাজার-রামু-উখিয়া-টেকনাফ থেকে পাবনার সাঁথিয়া, দিনাজপুরের চিরিবন্দর, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর, রংপুরের গঙ্গাচড়া, ভোলার বোরহানউদ্দিনে ধ্বংসলীলা চালানো হয়েছে।’

‘কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে বলতে বাধ্য হচ্ছি, বাংলাদেশের কোনো রাজনৈতিক দল ডান-বাম, মধ্যপন্থী কেউ আমাদের ওপর হামলার প্রতিবাদ করেনি। এই নির্যাতন প্রতিরোধে রাজনৈতিক দলগুলোর কোনো ভূমিকা আমরা প্রত্যক্ষ করিনি। সম্প্রতি হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় নায়েবে আমীর জমিয়াতুল উলামায়ে ইসলামের মহাসচিব মাওলানা নুর হোসাইন কাশেমী সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টের অপচেষ্টার বিরুদ্ধে সরকারকে কঠোর অবস্থান নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন- আমরা লক্ষ্য করছি নবীর সম্মান রক্ষার ঈমানী আন্দোলনকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে দেশে সাম্প্রদায়িক গোলযোগ সৃষ্টির চক্রান্ত চলছে। আমরা জনাব নুর হোসাইন কাশেমীকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি।’- বলেন রানা দাশগুপ্ত

মানবতা বিরোধী আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর রানা দাশগুপ্ত আরও বলেন, ‘বাংলাদেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায় বিদ্যমান বাস্তবতায় মাঠে নামতে বাধ্য হয়েছে। পাকিস্তান আমলে যা-ই হোক, স্বাধীন বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের অধিকারের জন্য, হামলা-মামলা থেকে বাঁচার জন্য লড়াই-সংগ্রাম করতে হবে, এটা কখনো কেউ ভাবেনি। আমরা নিজেদের ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, কিন্তু অপরের ধর্মের প্রতিও আমরা সমানভাবে শ্রদ্ধাশীল। এখনও আমাদের মা-বোনেরা যখন কোনো মসজিদের পাশ দিয়ে যায়, তখন মাথায় ঘোমটা দিয়ে যায়। আমাদের সংস্কৃতি সব মানুষকে, সব ধর্মকে শ্রদ্ধা করার সংস্কৃতি।’

সরকারের ভূমিকা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘সংখ্যালঘুদের প্রশ্নে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা খুবই আন্তরিক। কিন্তু তার দলের ভেতরেও দল আছে। সরকারকে বলব- অবিলম্বে এই হামলা, গুজব, মিথ্যা অভিযোগ প্রতিরোধ করুন। ইতোমধ্যে সংঘটিত হামলা-অগ্নিসংযোগের তদন্ত করুন, দায়ীদের বিচার করুন। মিথ্যা মামলায় যারা জেলে আছে তাদের মুক্তি দিন। না হলে, অস্তিত্ব রক্ষায় আমাদের আরও কঠোর কর্মসূচি দিতে হবে। প্রয়োজনে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা অভিমুখে লংমার্চ হবে।’

ঐক্য পরিষদের চট্টগ্রাম মহানগর শাখার সভাপতি পরিমল চৌধুরীর সভাপতিত্বে সমাবেশে আরও বক্তব্য রাখেন পরিষদের কেন্দ্রীয় প্রেসিডিয়াম সদস্য ড. জীনবোধি ভিক্ষু, চট্টগ্রাম উত্তরের সভাপতি রনজিৎ দে, কেন্দ্রীয় শিল্প ও বাণিজ্য সম্পাদক শ্যামল ‍কুমার পালিত, নগর কমিটির সাধারণ সম্পাদক নিতাই প্রসাদ ঘোষ, মহানগর পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি চন্দন তালুকদার, বাংলাদেশ গীতা শিক্ষা কমিটির প্রধান উপদেষ্টা তপন কান্তি দাশ, যুব ঐক্য পরিষদের নগর কমিটির সাধারণ সম্পাদক রুবেল পাল।

সমাবেশ শেষে বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে ঐক্য পরিষদের নেতারা চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের সামনে যান এবং সেখানে কর্মসূচির সমাপ্তি ঘোষণা করেন। গত ৩ নভেম্বর এক সংবাদ সম্মেলনে ঢাকা-চট্টগ্রামসহ সারাদেশে এই বিক্ষোভ কর্মসূচি ঘোষণা করেছিল ঐক্য পরিষদ।

বিক্ষোভ সাম্প্রদায়িকতা হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ

বিজ্ঞাপন

খেজুর আমদানিতে শুল্ক কমলো
২২ নভেম্বর ২০২৪ ২১:০৮

আরো

সম্পর্কিত খবর