ঢাকা: রোগী না থাকার কারণে কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতাল বন্ধ করা হলেও সারাদেশে আইসিইউ ও ভেন্টিলেটরের সংকট রয়েছে বলে জানিয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)।
মঙ্গলবার (১০ নভেম্বর) এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে করোনাভাইরাস সংকট মোকাবিলায় সুশাসনের চ্যালেঞ্জ (দ্বিতীয় পর্ব) শীর্ষক জরিপ প্রতিবেদনের ফলাফল তুলে ধরে এ তথ্য জানায় টিআইবি।
টিআইবি আরও জানিয়েছে, সরকারি তথ্যমতে, সারাদেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তির চিকিৎসা ব্যবস্থাপনার জন্য আইসিইউ শয্যার সংখ্যা মাত্র ৫৫০টি, ভেন্টিলেটরের সংখ্যা ৪৮০। আর এই সুবিধার অধিকাংশ ঢাকা শহরকেন্দ্রিক। ফলে প্রযোজনের সময় আইসিইউ ও ভেন্টিলেটর সাপোর্ট না পাওয়ার কারণে অনেক রোগীর জীবন হুমকির মুখে পড়ছে।
এর আগে গত ১৫ জুন প্রথম প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়েছিল। তিন মাস পর ১০ নভেম্বর দ্বিতীয় গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করা হলো। গবেষণাটি পরিচালনা করেন মো. জুলকারনাইন, মোহাম্মদ নূরে আলম, মোরশেদা আক্তার, তাসলিমা আকতার, মনজুর-ই খোদা।
সংবাদ সম্মেলনে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান, উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. সুমাইয়া খায়ের উপস্থিত ছিলেন। সংবাদ সম্মেলনে গবেষণা প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করেন মো. জুলকারনাইন ও মোরশেদা আক্তার।
প্রতিবেদনে বলা হয়, সারাদেশে জটিল করোনা রোগীর চিকিৎসায় প্রয়োজনীয় আইসিইউ, ভেন্টিলেটর সেবা জেলা পর্যায়ে অত্যন্ত অপ্রতুল। বর্তমানে সারাদেশে মোট ৫৫০টি আইসিইউ-এর মধ্যে ঢাকায় ৩১০টি (৫৬.৩ শতাংশ, চট্রগ্রামে ৬৯টি, রাজশাহীতে ২৪টি, রংপুরে ২০টি, খুলনায় ১৮টি, সিলেটে ১৬টি এবং বরিশালে ১২টি ময়মনসিংহে ১৭টি আইসিইউ রয়েছে। ঢাকার বাইরে বিভাগীয় এলাকায় জনসংখ্যা অনুপাতে আইসিইউ ও ভেন্টিলেটর সংকট বিদ্যমান। তারপেরও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে সারাদেশে শয্যা ও আইসিইউ এর কোনো সংকট নেই দাবি করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, সারাদেশে করোনা পরীক্ষাগারের সংখ্যা বাড়লেও এখনো প্রতিবেদন পেতে এক থেকে পাঁচ দিনের বেশি সময় অপেক্ষা করতে হয়। এতে আরও বলা হয়, সেবাগ্রহীতার ৯.৯ শতাংশ ভুল প্রতিবেদন পেয়েছে। মাত্র ১৩টি জেলায় ১৩টি বুথ এবং ঢাকায় একটি প্রবাসীদের নমুনা পরীক্ষার জন্য নির্ধারণ করা হয়েছে। এছাড়া যথাসময়ে প্রতিবেদন না পাওয়ায় ব্যাপক দুর্ভোগ পরিলক্ষিত হচ্ছে।
টিআইবির প্রতিবেদন বলা হয়, গত ১৬ই জুন থেকে প্রতিদিন গড়ে ১১টি করে পরীক্ষাগারে কোনো পরীক্ষা করা হচ্ছে না। গত ২ আগস্ট সর্বোচ্চ ৩৮টি পরীক্ষাগারে কোনো পরীক্ষা হয়নি। এছাড়া যান্ত্রিক ত্রুটি, পরীক্ষাগার রক্ষণাবেক্ষণ, পরীক্ষাগারে ভাইরাসের সংক্রমণ ইত্যাদি কারণে পরীক্ষাগার বন্ধ থাকে। আবার কখনো কখনো নমুনা সংগ্রহ বেশি না হলে বেসরকারি ল্যাব পরীক্ষা বন্ধ রাখা হয়।
সংবাদ সম্মেলনে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজামান ১৫টি সুপারিশমালা তুলে ধরেন, সেগুলোর মধ্যে রয়েছে, স্বাস্থ্য খাতের সব ধরনের ক্রয়ে সরকারি ক্রয় আইন ও বিধি অনুসরণ করতে হবে। জরুরিসহ সকল ক্রয় ই-জিপিতে করতে হবে। বিনামূল্যে নমুনা পরীক্ষার সুবিধা সকল জেলায় সম্প্রসারণ করতে হবে, নমুনা পরীক্ষার সংখ্যা বাড়াতে হবে। সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার মাধ্যমে প্রয়োজনে বেসরকারি হাসপাতালের সেবাসমূহকে (আইসিইউ, ভেন্টিলেটর ইত্যাদি) করোনা চিকিৎসা ব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। সংসদীয় স্থায়ী কমিটিকে নিয়মিত সভা করতে হবে এবং করোনায় সংঘটিত অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে এবং করোনা সংক্রান্ত তথ্য প্রকাশে যে বিধি-নিষেধ দেওয়া হয়েছে তা বাতিল করতে হবে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল বা সংশোধন করতে হবে এবং হয়রানিমূলক সব মামলা তুলে নিতে হবে। সম্মুখসারির সব স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রাপ্য প্রণোদনা দ্রুত বিতরণের ব্যবস্থা করতে হবে।
সংবাদ সম্মেলনে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, করোনাভাইরাস মোকাবিলায় সরকারের গৃহীত কার্যক্রমে সুশাসনের প্রতিটি নির্দেশকের ক্ষেত্রে ব্যাপক ঘাটতি রয়েছে। স্বাস্থ্যখাতে গভীরভাবে বিস্তৃত দুর্নীতি করোনা সংকটে প্রকটভাবে উন্মোচিত হয়েছে এবং করোনা সংকটকালে কেন্দ্র করে দুর্নীতির নতুন সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।
তিনি বলেন, সরকারের ত্রাণসহ প্রণোদনা কর্মসূচি থেকেও অনিয়ম-দুর্নীতি ও সুবিধা লাভের প্রবণতা লক্ষ্য করা গেছে। মাঠ পর্যায়ের অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে বিতরণকৃত ত্রাণ হতে প্রকৃত উপকারভোগীরা বঞ্চিত হচ্ছে। অনিয়ম-দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্তদের মধ্যে উচ্চ পর্যায়ের ব্যক্তিদের রাজনৈতিক বিবেচনায় আড়াল করা হচ্ছে এবং এক্ষেত্রে কিছু ব্যক্তির বিরুদ্ধে লোক দেখানো ব্যবস্থা গ্রহণের প্রবণতা লক্ষ করা গেছে। এছাড়া তথ্য প্রকাশে বিধিনিষেধ আরোপের মাধ্যমেও অনিয়ম-দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনাকে আড়াল করার প্রবণতা লক্ষ্য করা গেছে বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে আরনও বলা হয়, শীত মৌসুমে করোনার সম্ভাব্য দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবিলায় কার্যকর প্রস্তুতির অভাব। শহরকেন্দ্রীক ও বেসরকারি পর্যায়ের বাণিজ্যিক সেবা সম্প্রসারণ, পরীক্ষায় ফি নির্ধারণ দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিত প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে এই সেবা থেকে বঞ্চিত করছে এবং হয়রানী ও অনিয়ম-দুর্নীতির শিকার হওয়ার ঝুঁকি সৃষ্টি করছে।
প্রতিবেদনে আরও নবলা হয়, নমুনা পরীক্ষা, চিকিৎসা এবং করোনার অর্থনৈতিক প্রভাব মোকাবিলায় গৃহীত প্রণোদনা কর্মসূচির ক্ষেত্রেও সমাজের সুবিধাপ্রাপ্ত অংশের অনুকূলে পক্ষপাত করা হচ্ছে। পাশাপাশি চিকিৎসা সেবা ও প্রণোদনার সুফল সাধারণ মানুষের কাছে এখনো পৌঁছেনি।