বান্ধবীর খোঁজে ঢাকায় আসা রোহিঙ্গা তরুণী নুর জাহানের কথা
১২ নভেম্বর ২০২০ ১২:৫১
ঢাকা: মিয়ানমারের রাখাইনে সেনাবাহিনী ও সরকারি বাহিনীর নৃশংসতা থেকে প্রাণে বাঁচতে পালিয়ে আসেন বাংলাদেশে। এরপর কক্সবাজারের বালুখালী ক্যাম্পে আশ্রয় মেলে রোহিঙ্গা তরুণী নুর জাহানের। গত তিন বছরে তিনি বাংলা ভাষা রপ্ত করেছেন অনেকটা। ১৮ বছর বয়সী এই তরুণী এখন কাজ করছেন একটি বেসরকারি সংস্থায়। বলা চলে, গত তিন বছরে অনেকটাই বদলে গিয়েছিল রোহিঙ্গা তরুণী নুর জাহানের জীবন।
এর মধ্যে হঠাৎ করেই গোল বাঁধে। তারই আরেক বান্ধবী রোজিনার সঙ্গে সম্পর্ক হয় বাংলাদেশি এক তরুণের। তাকে বিয়ে করে ঢাকায় থিতু হন রোজিনা। একদিন বান্ধবী রোজিনার সঙ্গে দেখা করতে ছাড়েন ক্যাম্প। চলে আসেন ঢাকা। কিন্তু রোজিনার দেওয়া ঠিকানায় গিয়ে তাকে পাননি নুর জাহান। ওই সময় আর ফোনও ধরেননি রোজিনা। পরে কক্সবাজারে ফিরে যেতে চাইলেও নুর জাহানের স্থান হয় মোহাম্মদপুর থানায়। সেখানে অবর্ণনীয় কষ্টে একদিন কাটানোর পর তেজগাঁও উইমেন সাপোর্ট এন্ড ইনভেস্টিগেশন ডিভিশনে নেওয়া হয় তাকে। খবর পেয়ে শেষ পর্যন্ত তার দায়িত্ব নেয় বেসরকারি সংস্থা ‘প্রেরনা’। গত কয়েকদিন নুর জাহানকে যে মানসিক চাপ সামলাতে হয়েছে, তা কাটিয়ে উঠতে সহায়তা করছে প্রতিষ্ঠানটি। শিগগিরই নুর জাহানকে কক্সবাজারে ফেরত পাঠানো হবে বলেও জানিয়েছে।
মানসিক স্বাস্থ্যসেবা এবং মানবাধিকার ও আইনি সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান ‘প্রেরনা’তেই সারাবাংলার সঙ্গে কথা হয় নুর জাহানের। তুলে ধরেন গত ক’দিনের অভিজ্ঞতা। জানালেন, ‘প্রেরনা’র সহায়তায় এখন তিনি অনেকটাই স্বাভাবিক।
নুর জাহান জানালেন, বাংলাদেশে তার আগমনের গল্প আর দশ জন রোহিঙ্গা নাগরিকের মতোই। ২০১৭ সালের আগস্টে মিয়ানমারের রাখাইনে দেশটির সরকারি বাহিনী ও সেনাবাহিনীর অকথ্য, বর্বরোচিত নির্যাতন চলছিল। হত্যা, ধর্ষণ, খুন, লুটপাট, ঘরবাড়ি আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া— কিছুই বাদ রাখেনি তারা। প্রাণে বাঁচতে সীমান্ত পেরিয়ে তখন রাখাইনের লাখ লাখ রোহিঙ্গা অধিবাসী চলে আসেন বাংলাদেশে। তাদের সঙ্গে বাংলাদেশে চলে আসেন রোহিঙ্গা তরুণী নুর জাহানও। তখন তার বয়স মাত্র ১৫ বছর। কক্সবাজারের উখিয়ায় বালুখালী-২ ক্যাম্পে আশ্রয় হয় তার।
নুর জাহান বলেন, ‘ছোটবেলাতেই মা’কে হারিয়েছি। বাবা আরেকটি বিয়ে করেছিলেন। সেই থেকে খালার সঙ্গে থাকতাম। ২০১৭ সালে নির্যাতন শুরু হলে খালার সঙ্গেই বাংলাদেশে আসি। গত তিন বছর কক্সবাজারের ক্যাম্পে আছি।’ কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শিবিরে বাংলা ভাষাভাষী অনেকের সংস্পর্শে আসতে হয়েছে নুর জাহানকে। সেই সুবাদে এখন ভালো বাংলা বলতে পারেন তিনি।
নুর জাহান জানান, রাখাইনে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করেছিলেন। এখানে এসে বাংলা ভাষা শিখে নেওয়ায় সবার সঙ্গে যোগাযোগও তৈরি হয়। বর্তমানে বালুখালী ক্যাম্পে তিনি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান (এনজিও) বিডিএসসিএস-এ চাকরি করছেন। নিরাপদ পানি নিয়ে কর্মরত এনজিও’টিতে সপ্তাহে পাঁচ দিন কাজ করতে হয় নুর জাহানকে। মাসে বেতন পান ১২ হাজার টাকা।
ঢাকায় কিভাবে এসেছেন— এমন প্রশ্নের জবাবে নুর জাহান সারাবাংলাকে বলেন, ‘রোজিনা নামে আমার একজন রোহিঙ্গা বান্ধবী আছেন। রোজিনাও ২০১৭ সালে বাংলাদেশে আসেন। একজন বাঙালি ছেলেকে বিয়ে করে রোজিনা ঢাকার বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় থাকেন। এর আগেও আমি রোজিনার বাড়িতে বেড়াতে ঢাকায় এসেছিলাম। গত ১ অক্টোবরও আমি আবার তার বাসায় যাওয়ার জন্য ঢাকায় আসি। কিন্তু যে বাসায় রোজিনা থাকত, ঢাকায় এসে ওই বাসায় খোঁজ করলে বাড়িওয়ালা জানান, রোজিনা এখন এই ঠিকানায় থাকেন না। তখন আমি রোজিনার মোবাইলে ফোন করলেও রিসিভ হয়নি। অথচ রোজিনার সঙ্গে ফোনে কথা বলেই আমি ঢাকায় আসি।’
বান্ধবীকে না পেয়ে কক্সবাজার ক্যাম্পে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন নুর জাহান। কক্সবাজারের বাস ধরতে বাস স্ট্যান্ডে যাওয়ার জন্য সিএনজি অটোরিকশায় চড়েন তিনি। কিন্তু সিএনজিচালক কোনোভাবে বুঝতে পারেন, নুর জাহান একজন রোহিঙ্গা তরুণী। সে কারণে তিনি বাস স্ট্যান্ডে নেওয়ার বদলে তাকে নিয়ে যান মোহাম্মদপুর থানায়।
নুর জাহান বলেন, ‘মোহাম্মদপুর থানায় অনেক কষ্ট হয়েছে। একদিন আমাকে ওই থানায় অনেক ছেলে মানুষের সঙ্গে রাখা হয়। ওই একদিন আমাকে কোনো খাবারও দেয়া হয়নি। আমি বাথরুমের পানি খেয়ে দিন কাটিয়েছি। তারপর আমাকে তেজগাঁওয়ে পুলিশের উইমেন সাপোর্ট অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন ডিভিশনে পাঠানো হয়। সেখানে ছিলাম আট দিন। সেখান থেকে প্রেরনা’র রেজিনা পারভীন আমাকে নিয়ে আসেন। আমি এখন তার তত্ত্বাবধানে আছি। কিন্তু আমি ক্যাম্পে ফিরতে চাই।’
ক্যাম্প থেকে কিভাবে বের হলেন, কেউ বাধা দেয়নি?— এমন প্রশ্নের জবাবে নুর জাহান বলেন, ‘না, কেউ বাধা দেয়নি। চেকপোস্টে কেউ ছিল না।’
ঢাকা এসে কোনো অপরাধ করেননি বলেই মনে করেন নুর জাহান। তিনি বলেন, ‘আমি তো কোনো অপরাধ করিনি। আমি বান্ধবীর সঙ্গে দেখা করতে এসেছি। কিন্তু সবাই এমন আচরণ করছে যেন আমি অনেক অপরাধ করেছি। আমি ক্যাম্পে ফিরতে চাই।’
রোহিঙ্গা তরুণী নুর জাহানের বিষয়ে প্রেরনা’র সাধারণ সম্পাদক রেজিনা পারভীন সারাবাংলাকে বলেন, ‘রোহিঙ্গা তরুণী নুর জাহানকে তেজগাঁওয়ে পুলিশের উইমেন সাপোর্ট অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন ডিভিশন থেকে আমরা বুঝে নিয়েছি। ঢাকায় আসার পর গত কিছুদিনে এই তরুণীর ওপর অনেক মানসিক চাপ গেছে। তাই তাকে কিছু প্রয়োজনীয় মানসিক চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। চিকিৎসা শেষে প্রেরনা’র পক্ষ থেকেই কয়েকদিনের মধ্যেই নুর জাহানকে বালুখালী ক্যাম্পের যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে দিয়ে আসা হবে।’
জানতে চাইলে রোহিঙ্গা সংকটের সমধান জরুরি উল্লেখ করে নিরাপত্তা বিশ্লেষক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের দেশের ভেতরে যে জায়গাটি সবচেয়ে বেশি স্পর্শকাতর, সেই জায়গাতেই কিন্তু রোহিঙ্গা সংকট শুরু হয়েছে। এই সংকটের সমাধান না হলে সেটা বাংলাদেশের ইন্টার্নাল ও এক্সটার্নাল নিরাপত্তা তো বটেই, এই অঞ্চলের জন্যই সুখকর হবে না। কাজেই আমাদের অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে এই সমাধান বের করতে হবে। আমাদের বিকল্প ভাবতে হবে।’
উইমেন সাপোর্ট অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন বিভাগ নুর জাহান প্রেরনা বালুখালী ক্যাম্প রোহিঙ্গা তরুণী নুর জাহান রোহিঙ্গা বান্ধবী