Thursday 05 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

‘সামনের কাতারে নামাজ পড়েন, তাবলীগে যান, করেন ইয়াবার কারবার’


১৩ নভেম্বর ২০২০ ১৯:৫৩

চট্টগ্রাম ব্যুরো: বেশভূষায় কঠিন ধর্মপ্রাণ মানুষ। তার অভিজাত ফ্ল্যাটজুড়ে ধর্মীয় বইয়ের সমাহার। ধর্ম অন্তঃপ্রাণ যুবক হিসেবে এলাকার মানুষও তাকে সমীহ করতো। কিন্তু সেই ফ্ল্যাটেই অভিযান চালিয়ে পুলিশ ২৩ হাজার ইয়াবার পাশাপাশি উদ্ধার করেছে নগদ প্রায় ৯ লাখ টাকা। পুলিশ জানিয়েছে, ধর্মীয় লেবাসের আড়ালে একটি ইয়াবা সিন্ডিকেটের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন ওই যুবক। তার সঙ্গে মায়ানমারের ইয়াবা সিন্ডিকেটের যোগসূত্র পেয়েছে পুলিশ।

শুক্রবার (১৩ নভেম্বর) বিকেলে নগরীর চান্দগাঁও থানার বহদ্দারহাট নিউ চান্দগাঁও আবাসিক এলাকার ৪ নম্বর সড়কে ৪০ নম্বর জনৈক হাজী সাহেবের ভবনের তৃতীয় তলায় ওই ফ্ল্যাটে অভিযান চালায় বাকলিয়া থানা পুলিশ। নগর পুলিশের উপ-কমিশনার (দক্ষিণ) এস এম মেহেদী হাসানের নেতৃত্বে অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (দক্ষিণ) পলাশ কান্তি নাথ, সহকারী কমিশনার মোহাম্মদ রাইসুল ইসলাম এবং বাকলিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ নেজাম উদ্দিনসহ প্রায় অর্ধশত পুলিশ সদস্য এ অভিযানে অংশ নেন।

গ্রেফতার চারজন হলেন ইয়াবা সিন্ডিকেটের মূল হোতা হিসেবে অভিযুক্ত মো. মাসুদ ফোরকান (৩০) ও তার স্ত্রী শামীম আরা শমী (২৮) এবং মাসুদের বন্ধু মোবারক হোসেন (৩৮) ও দোকান কর্মচারী মো. রাসেল (১৮)।

মাসুদের বাড়ি বাঁশখালী উপজেলার চানপুর গ্রামে। মোবারকের বাড়ি কক্সবাজার জেলার পেকুয়া উপজেলার দক্ষিণ গুলদী গ্রামে। রাসেলের বাসাও চান্দগাঁও আবাসিক এলাকায়।

বাকলিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ নেজাম উদ্দিন সারাবাংলাকে জানান, ইয়াবার বিনিময়ে রোহিঙ্গাদের অস্ত্র সরবরাহের অভিযোগে গত ৫ নভেম্বর রাতে নগরীর বাকলিয়া থানার শাহ আমানত সেতু এলাকায় অভিযান চালিয়ে আব্দুর রাজ্জাক (২১) নামে একজনকে আমেরিকায় তৈরি একটি পিস্তল ও ২টি ম্যাগজিনসহ গ্রেফতার করে পুলিশ।

তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে পরদিন কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলার হ্নীলা ইউনিয়নের লেদা রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অভিযান চালিয়ে মো. কামাল (৪০) নামে আরেকজনকে গ্রেফতার করা হয়। দুজনের বিরুদ্ধে বাকলিয়া থানায় অস্ত্র আইনে মামলা দায়ের হয়। ওই মামলায় তাদের পাঁচদিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।

ওসি নেজাম বলেন, ‘রাজ্জাক ও কামালকে জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে আমরা জানতে পারি, তাদের সিন্ডিকেটের আরেকটি আস্তানা নিউ চান্দগাঁও আবাসিক এলাকায় আছে। তখন আমার বিভিন্ন সূত্রে খবর নিয়ে এ আস্তানার সন্ধান পাই। আজ (শুক্রবার) সকালে বাকলিয়া এলাকায় অভিযান চালিয়ে এক হাজার পিস ইয়াবাসহ একজনকে আটক করি। পরে তাকে নিয়ে আমরা এই ফ্ল্যাটে অভিযান চালিয়ে ২৩ হাজার ২০০ পিস ইয়াবা, নগদ ৮ লাখ ৮৩ হাজার ৬২২ টাকা, ডাচ-বাংলা ব্যাংক, শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক ও পূবালী ব্যাংকের ১২টি চেকবই, দুটি পাসপোর্ট, বিপুল পরিমাণ ধর্মীই বইপত্র এবং বেশকিছু ধাতব চুম্বক উদ্ধার করি। এই চুম্বকের সঙ্গে প্যাকেটে মোড়ানো ইয়াবা বেঁধে গাড়ির নিচে লোহার সঙ্গে লগিয়ে কক্সবাজার থেকে চট্টগ্রামে এই মাদক নিয়ে আসা হত বলে তারা জানিয়েছে।’

গ্রেফতার মাসুদ ফোরকান সাংবাদিকদের কাছে দাবি করেন, নগরীর বাকলিয়া থানার কালামিয়া বাজার এলাকায় তার চা-পাতার দোকান আছে। তবে পুলিশ ও এলাকার লোকজন জানিয়েছেন, বহদ্দারহাট কাঁচাবাজারে তার মুদি দোকান আছে। মাসুদ জানিয়েছেন, গ্রেফতার মোবারক তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তাবলীগে গিয়ে মোবারকের সঙ্গে তার পরিচয় হয়।

বাসায় পাওয়া ইয়াবা ও টাকার বিষয়ে মাসুদ জানান, শুক্রবার সকালে হাবিবউল্লাহ নামে তার এক বন্ধু ইয়াবাগুলো তার বাসায় রেখে যায়। হাবিবউল্লাহর পরিচিত একজন এসে সেগুলো নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল। জব্দ টাকাগুলো তার দোকানের ব্যবসার টাকা বলে মাসুদ দাবি করেছেন। ছয় মাস আগে তিনি বাসাটি ভাড়া নেন বলে জানিয়েছেন।

মোবারকের দাবি, তিনি চট্টগ্রাম শহর থেকে সার্জিক্যাল আইটেম কিনে গ্রামে বিভিন্ন দোকানে সরবরাহ করেন। তিনি ইয়াবা ব্যবসার সঙ্গে সম্পৃক্ত নন বলে দাবি করেন। তবে মাসুদ ও মোবারকের ধর্মীয় বেশভূষা দেখা গেছে।

উপ-পুলিশ কমিশনার এস এম মেহেদী হাসান বলেন, ‘মাসুদ ও মোবারক উভয়ই ইয়াবা সিন্ডিকেটে সক্রিয়ভাবে জড়িত। তারা দীর্ঘদিন ধরে এই ব্যবসা করে আসছে। অস্ত্রসহ গ্রেফতার হওয়া দু’জন এবং এরা একই নেটওয়ার্কে আছে। গ্রেফতার চারজনের মধ্যে যিনি প্রধান (মাসুদ) তার সঙ্গে মায়ানমারের ইয়াবা ব্যবসায়ীদের সরাসরি যোগাযোগ আছে। গ্রেফতারের পর প্রমাণস্বরূপ আমাদের সামনে সে হোয়াটস অ্যাপের মাধ্যমে মায়ানমারে যোগাযোগ করেছে। আরেকজনের সঙ্গে কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সন্ত্রাসীদের সঙ্গে যোগাযোগ আছে।’

‘মাসুদ ও মোবারককে দেখে মনে হয় তারা কঠিন ধার্মিক। নিয়মিত পাঞ্জাবি পরেন, মাথায় টুপি দেন। এলাকার লোকজন জানিয়েছেন, মসজিদে গিয়ে সামনের কাতারে দাঁড়িয়ে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়েন মাসুদ। তার বাসায় আলমারি জুড়ে সব ধর্মীয় বইপত্র। মাঝে মাঝে তাবলীগে যেতেন। আসলে ধর্মের লেবাসে তারা ইয়াবার ব্যবসা করে। ধর্মের লেবাসটা নিয়েছে যাতে তাদের দেখে কারও সন্দেহ না হয়’ বলেন এস এম মেহেদী হাসান।

অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার পলাশ কান্তি নাথ জানান, মাসুদের স্ত্রী শামীম আরা ২০১৫ সালে পদার্থবিজ্ঞান বিষয়ে চট্টগ্রাম কলেজ থেকে মাস্টার্স সম্পন্ন করেন। তিনি ৩৮ তম বিসিএস পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিলেন। তিনি আবারও বিসিএস পরীক্ষা দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। এ সংক্রান্ত কাগজপত্রও ওই ফ্ল্যাটে পাওয়া গেছে। এ ছাড়া অভিযানের সময় শামীম আরা নিজেই আলমারি থেকে টাকাগুলো বের করে দেন। ইয়াবার ব্যবসা মাসুদ স্ত্রীর জ্ঞাতসারেই করছিলেন। তাদের ছয় মাস বয়সী এক ছেলে আছে।

সহকারী পুলিশ কমিশনার রাইসুল ইসলাম সারাবাংলাকে জানিয়েছেন, তিন-চার মাস পরপর বাসা পাল্টানো মাসুদের কৌশল। নিউ চান্দগাঁও আবাসিক এলাকায় বাসা ভাড়া নেওয়ার আগে তিনি কালা মিয়া বাজার এলাকায় একটি বাসায় থাকতেন। মূলত তিনি প্রতিটি বাসাকেই ইয়াবার আস্তানা হিসেবে ব্যবহার করতেন। এ ছাড়া গ্রেফতার রাসেলকে দোকান কর্মচারী বলা হলেও সে-ও এই সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িত। মিয়ানমার ও কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পভিত্তিক ইয়াবা নেটওয়ার্কের তথ্য জানতে গ্রেফতার হওয়া চারজনকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।

এদিকে মাসুদের বাসায় অভিযান এবং ইয়াবা-টাকা উদ্ধারের ঘটনা নিয়ে এলাকার মানুষের মধ্যে বিস্ময় ও কৌতুহল তৈরি হয়েছে। কেউই বিশ্বাস করতে পারছেন না, তিনি ইয়াবার ব্যবসায় জড়িত।

মাসুদের একই ভবনের দ্বিতীয় তলার ভাড়াটিয়া চট্টগ্রাম জেলা পরিষদের সদস্য শাহিদা আক্তার জাহান সারাবাংলাকে বলেন, ‘উনার (মাসুদ) মধ্যে কোনো অস্বাভাবিক আচরণ দেখিনি। শুধু প্রায়ই উনাকে দেখতাম আড়ালে গিয়ে একনাগাড়ে মোবাইলে কথা বলছেন। তবে সামনাসামনি দেখে খুবই ভালো মানুষ মনে হতো।’

‘হাজী সাহেবের ভবনের’ দারোয়ান মো. ইসরাফিল সারাবাংলাকে বলেন, ‘বাসায় ঢুকতে, বের হতে সালাম দিতেন মাসুদ সাহেব। মানুষকে সবসময় নামাজ ও দ্বীনের দাওয়াত দিতেন। তিনি যে এতবড় মাপের ইয়াবা ব্যবসায়ী এটা আমরা কেউ বুঝতে পারিনি।’

পাশের ভবনের বাসিন্দা মো. সেলিম সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমি নিয়মিত উনার (মাসুদ) মুদির দোকান থেকেই বাজার করতাম। দেখা হলেই সালাম দিতেন। মানুষের সঙ্গে খুবই মার্জিত ব্যবহার করতেন। মসজিদে গিয়ে সামনের কাতারে দাঁড়িয়ে নামাজ আদায় করতেন। পাঁচওয়াক্ত নামাজ পড়তেন। এমন মানুষের বাসায় ইয়াবা পেয়েছি শুনে অবাক হয়েছি। বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে তিনি এ কাজ করতে পারেন।’

ইয়াবা ইয়াবার কারবার টপ নিউজ


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর