যেভাবে চলছে বিএনপি
১৩ নভেম্বর ২০২০ ২২:৫৫
ঢাকা: টানা ১৪ বছর রাষ্ট্র ক্ষমতার বাইরে, পাঁচ বছর সংসদের বাইরে এবং টানা সাত বছর বিরোধী দলের বাইরা থাকা দেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপি এই মুহূর্তে কী করছে?— এমন প্রশ্ন ও কৌতূহল সর্বত্র। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মাঠের রাজনীতিতে পিছিয়ে থাকলেও দলের অভ্যন্তরীণ কর্মকাণ্ড স্বাভাবিক গতিতেই এগিয়ে নিচ্ছে বিএনপি। বৈশ্বিক মহামারির প্রতিকুল পরিস্থিতির মধ্যেও সংগঠনকে গতিশীল রাখতে সক্ষম হয়েছে দলটি।
দলীয় গঠনতন্ত্র অনুযায়ী বিএনপির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম হচ্ছে জাতীয় স্থায়ী কমিটি। যে কোনো ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত এখান থেকেই হয়। কিন্তু অতীতে কখনো স্থায়ী কমিটির ‘নিয়মিত’ বৈঠক কল্পনা করা যায়নি। ছয় মাসেও একবার বৈঠক হতো না। দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া যেদিন চাইতেন, সেদিন অনুষ্ঠিত হতো স্থায়ী কমিটির বৈঠক। কিন্তু এখন প্রতি শনিবার বিকেল পাঁচটায় স্থায়ী কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, স্থায়ী কমিটির নিয়মিত বৈঠকের ফলে বিএনপি গতিশীল হয়েছে। যে কোনো গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে পারছে দলটি এবং সে সিদ্ধান্তগুলো নীতিনির্ধারণী ফোরাম থেকেই আসছে। অতীতের মতো নির্দিষ্ট একটি জায়গা থেকে আসছে না। ফলে দলের অভ্যন্তরে ‘গণতন্ত্র’ চর্চার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে, দলীয় রাজনীতিতে এসেছে গুণগত পরিবর্তন।
বিএনপির গঠনতন্ত্রের ৭-এর (খ) ধারা অনুযায়ী দলের চেয়ারম্যান সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। সব কমিটির ওপর তার কর্তৃত্ব রয়েছে এবং দল পরিচালনায় তার সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। চেয়ারম্যানের অনুপস্থিতিতে বা চেয়ারম্যান কর্তৃক অর্পিত যেকোনো দায়িত্ব সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যানকে দেওয়া হলে তিনি ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন। গঠনতন্ত্রের ওই ধারা অনুযায়ী ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ঘোষণা করে বিএনপি।
এরপর থেকে তারেক রহমানের সভাপতিত্বে দলের স্থায়ী কমিটির বৈঠক হচ্ছে নিয়মিত। এসব বৈঠক থেকেই দলের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত আসছে। ২০১৮ সালের নির্বাচনে অংশ গ্রহণ, ফলাফল প্রত্যাখান, শপথ গ্রহণ থেকে বিরত থাকা, ভবিষ্যতে নির্বাচনে না যাওয়ার ঘোষণা, পরবর্তী সময় শপথ গ্রহণ ও নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সিদ্ধান্ত এসব বৈঠক থেকেই হয়েছে। শুধু তাই নয়, স্থায়ী কমিটির নিয়মিত বৈঠকের ফলে প্রায় প্রতিটি ইস্যুতে দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং ইস্যুভিত্তিক দলীয় বক্তব্য প্রদান ও কর্মসূচি পালন করছে বিএনপি, যেটা অতীতে খুব একটা দেখা যায়নি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের বৃহৎ রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপির বিপুল জনপ্রিয়তা ও জনভিত্তি থাকা সত্ত্বেও জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে দলীয় অবস্থান ও সিদ্ধান্ত নিতে বরাবরই কালক্ষেপণ করেছে দলটি। কিন্তু এখন আর তেমনটি হচ্ছে না। গত দুই বছরে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক যতগুলো ইস্যু সামনে এসেছে, যেমন— রোহিঙ্গা সংকট, কোটাবিরোধী আন্দোলন, কোমলমতী ছাত্রদের নিরাপদ সড়ক আন্দোলন, ডেঙ্গু পরিস্থিতি, করোনাভাইরাস মহামারি, বন্যা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ, অতি সম্প্রতি ফ্রান্স সরকার কর্তৃক রাষ্ট্রীয়ভাবে হযরত মোহাম্মদ (স.)-কে অবমাননার ব্যাপারে দ্রুততার সঙ্গে দলীয় অবস্থান তুলে ধরেছে বিএনপি।
দলটির শীর্ষ নেতারা বলছেন, বিএনপির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির নিয়মিত বৈঠকের ফলেই এই পরিবর্তনগুলো সাধিত হয়েছে। খালেদা জিয়ার অবর্তমানে দলের অখণ্ডতা রক্ষা, দলকে গতিশীল ও ক্রিয়াশীল রাখার যে চ্যালেঞ্জ তারা নিয়েছিলেন, সেই চ্যালেঞ্জই বিএনপির অভ্যন্তরে গুণগত পরিবর্তন এনেছে।
জানা গেছে, সংকটের মধ্যে থাকা বিএনপির অভ্যন্তরে কেবল গুণগত পরিবর্তন নয় সাংগঠনিক কার্যক্রমও গতি পেয়েছে। স্থায়ী কমিটির নিয়মিত বৈঠকের ফলে বিএনপির সব কটি বিভাগীয় কমিটি পর্যালোচনার পাশাপাশি নতুন কমিটি গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এরই মধ্যে ময়মনসিংহ, সিলেট ও চট্টগ্রাম বিভাগের সাংগঠনিক প্রতিবেদন স্থায়ী কমিটিতে উপস্থাপিত হয়েছে। অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের আংশিক কমিটিগুলোকে পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে রূপ দেওয়া হয়েছে।
স্থায়ী কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, স্থানীয় সরকার নির্বাচনে প্রার্থী মনোনয়নে সুপারিশ করার জন্য জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন ও পৌর কমিটির সমন্বয়ে একটি কাঠামো নির্ধারণ করে দিয়েছে বিএনপি। ওই কাঠামোর সুপারিশ অনুযায়ী এখন স্থানীয় নির্বাচনগুলোতে বিএনপি প্রার্থী মনোনয়ন দিচ্ছে।
সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি জাতীয় দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়ানো, ত্রাণ তৎপরতা চালানো এবং এ ব্যাপারে সরকারকে নানা পরামর্শ ও প্রস্তাবনা আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিকভাবে দিয়ে আসছে বিএনপি। দলের ক্ষতিগ্রস্ত নেতাকর্মীকেও নানাভাবে সাহায্য-সহযোগিতা অব্যাহত রয়েছে। সদ্য প্রয়াত জাতীয়তাবাদী স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি শফিউল বারী বাবুর স্ত্রী-সন্তানদের জন্য ঢাকায় ফ্ল্যাটের ব্যবস্থা করে দিয়েছে বিএনপি।
বিএনপির চলমান কর্মকাণ্ডের সার্বিক পরিস্থি সম্পর্কে জানতে চাইলে দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সারাবাংলাকে বলেন, ‘বিএনপির অন্তর্নিহিত শক্তি হলো জনগণ। ফলে শত সংকটেও দল গতিশীল রয়েছে। দলের কর্মকাণ্ড গতিশীল রয়েছে। কোনো কিছুতেই দল পথ হারাচ্ছে না।’
দলের চেয়ারপারসন ‘বস্তুত’ কারাবন্দি, দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান দেশের বাইরে। এ বিষয়টি দলের ওপর প্রভাব ফেলছে না?— এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘বিএনপি চলে যৌথ নেতৃত্বে। আমরা নিয়মিত স্থায়ী কমিটির বৈঠক করছি। সেসব বৈঠকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান যুক্ত থাকছেন। ফলে তাদের (চেয়ারপারসন-ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান) অনুপস্থিতি কোনো প্রভাব ফেলছে না।’