Friday 06 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ভাঙছে হেফাজত, কাউন্সিলের বিরোধিতায় শফীর অনুসারীরা


১৪ নভেম্বর ২০২০ ১৭:২৪

চট্টগ্রাম ব্যুরো: ঈমান-আকিদা সংরক্ষণ ও মহানবীর সম্মান রক্ষায় গড়ে তোলা হেফাজতে ইসলামের ভাঙন স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। সংগঠনটির মহাসচিব জুনায়েদ বাবুনগরীর সমর্থনপুষ্ট অংশের ডাকা কাউন্সিলের বিপক্ষে অবস্থান ঘোষণা করেছেন প্রতিষ্ঠাতা আমীর প্রয়াত শাহ আহমদ শফীর পরিবারের সদস্য ও অনুসারীরা। তাদের অভিযোগ, অরাজনৈতিক সংগঠন হেফাজতে ইসলামকে বিএনপি-জামায়াতের হাতে তুলে দিতে কাউন্সিল আহ্বান করা হয়েছে।

এছাড়া আহমদ শফীকে হত্যা করা হয়েছে দাবি করে তারা এর বিচার বিভাগীয় তদন্ত দাবি করেছেন। তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত শফীর হাতেগড়া সংগঠন হেফাজতে ইসলামের কোনো কাউন্সিল না করারও দাবি তাদের।

শনিবার (১৪ নভেম্বর) দুপুরে চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলনে আসেন শাহ আহমদ শফীর ছোট শ্যালক মো. মঈন উদ্দিন। ব্যানারে হেফাজতের ইসলামের আহ্বানে সংবাদ সম্মেলনের কথা লেখা ছিল। তবে তিনি জানিয়েছেন, শফীর পরিবারের পক্ষ থেকে এ সংবাদ সম্মেলন আহ্বান করা হয়েছে। এ সময় বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন হেফাজতের যুগ্ম-মহাসচিব মঈনুদ্দীন রুহী। উপস্থিত ছিলেন হেফাজতের কেন্দ্রীয় কমিটির ছয় সদস্য এবং আহমদ শফীর নাতি মাওলানা কায়সার।

গত ১৮ সেপ্টেম্বর শতবর্ষী ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব শাহ আহমদ শফীর জীবনাবসান হয়। চট্টগ্রামের হাটহাজারীর বড় মাদ্রাসা হিসেবে হিসেবে পরিচিত দারুল উলুম মইনুল ইসলাম মাদরাসার মহাপরিচালক ছিলেন তিনি। তিনদিন ধরে ওই মাদরাসায় আহমদ শফীকে অবরুদ্ধ করে ছাত্র বিক্ষোভ হয়। এর মধ্যেই গুরুতর অসুস্থ শফীর শারীরিক অবস্থার অবনতি হয় এবং ঢাকায় হাসপাতালে নেওয়ার পর তিনি মারা যান। মৃত্যুর পর থেকে শফীর অনুসারীরা তাকে হত্যা করা হয়েছে বলে দাবি করে আসছিলেন। এ অবস্থায় রোববার (১৫ নভেম্বর) হাটহাজারী মাদরাসায় হেফাজতে ইসলামের প্রতিনিধি সম্মেলন বা কাউন্সিলের ডাক দিয়েছেন মহাসচিব জুনায়েদ বাবুনগরীর অনুসারীরা।

এ প্রেক্ষাপটে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে শফীর ছোট শ্যালক মো. মঈন উদ্দিন দাবি করেন, সুপরিকল্পিতভাবে হায়েনারূপী পাকিস্তানের দোসর জামায়াত-শিবিরের প্রেতাত্মারা হাটহাজারী মাদরাসার ভেতরে আহম শফীকে হত্যা করেছে। লিখিত বক্তব্যে তিনি বলেন, ‘শাহ আহমদ শফী স্বাধীনতার পক্ষে থাকায় তার উপরে বহুবার আঘাত এসেছে। তিনি প্রকাশ্যে স্বাধীনতা বিরোধীদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে বক্তব্য ও বই লেখায় তার প্রতি জামায়াত-শিবিরের ক্ষোভ ছিল দীর্ঘদিনের। শাপলা চত্বরে জামায়াত-শিবির ও বিএনপির ফাঁদে পা না দেওয়ায় তখন থেকেই শফী হুজুরকে দুনিয়া থেকে বিদার করার জন্য ষড়যন্ত্রের ফাঁদ পাতে। ১৬ সেপ্টেম্বর কিছু ছাত্রকে উসকে দিয়ে মাদরাসায় জামায়াত-শিবিরের লেলিয়ে দেওয়া ক্যাডার বাহিনীকে ব্যবহার করে মাদরাসা অবরুদ্ধ করা হয়।’

‘হুজুরের ছাত্র ও অত্যন্ত পছন্দের জুনাইদ বাবুনগরী মাদরাসায় অবস্থান করে মীর ইদ্রিস, নাছির উদ্দিন মুনীর, মুফতি হারুন ইজাহার, ইনআমুল হাসান প্রমুখ দিয়ে একের পর এক মাদরাসার তহবিল লুটতরাজ ও ভাংচুর করে। এমনকি পবিত্র কোরআন শরীফ এবং হাদিস শরীফে প্রকাশ্যে অগ্নিসংযোগ করে। দুর্বৃত্তরা হযরতের খাস কামরায় প্রবেশ করে ভাংচুর, লুটতরাজ, গালিগালাজ, হুমকি ধমকি ও নির্যাতন চালায়। হযরতকে জোর পূর্বক পদত্যাগে বাধ্য করে। এতে তিনি ভীষণভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন। অসুস্থ অবস্থায় হযরতের অক্সিজেন লাইন বারবার খুলে দেওয়ায় তিনি মৃত্যুর দিকে ঝুঁকে পড়েন এবং কোমায় চলে যান। অনেক কষ্ট করে চিকিৎসার জন্য বের করা হলেও রাস্তায় পরিকল্পিতভাবে অ্যাম্বুলেন্স আটকে সময়ক্ষেপণ করে নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া হয়’— এভাবেই সংবাদ সম্মেলনে বলছিলেন মো. মঈন উদ্দিন।

তিনি বলেন, ‘আল্লামা শাহ আহমদ শফী হুজুর জামায়াত-শিবিরের পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ডের শিকার। প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন, শাহ আহমদ শফী আপনাকে মেয়ের মতো মহব্বত করতেন। জামায়াত-শিবিরের যেসব প্রেতাত্মারা হাটহাজারী মাদরাসায় অবস্থান করে হুজুরকে হত্যা করেছে বিচার বিভাগীয় তদন্ত করে তাদের অবিলম্বে বিচারের মুখোমুখি করার জোর দাবি জানাচ্ছি।’

শফীর পরিবারের পক্ষ থেকে এই ‘হত্যাকাণ্ডের’ প্রতিবাদ ও নিন্দা জানিয়ে এর বিচার বিভাগীয় তদন্ত এবং তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত কাউন্সিল না করার দাবি জানান মঈন উদ্দিন। লিখিত বক্তব্যে তিনি বলেন, ‘হযরতের (আহমদ শফী) অস্বাভাবিক মৃত্যুর বিষয়টি পরিবার থেকে একাধিকবার বলা হলেও সরকার, প্রশাসন বা হেফাজতের বর্তমান দায়িত্বশীলরা কোনো উদ্যোগ নেননি। ১৫ নভেম্বর হাটহাজারী মাদরাসায় হেফাজতে ইসলামের প্রতিনিধি সম্মেলন হতে যাচ্ছে। এমন অবস্থায় কাউন্সিলের মাধ্যমে হুজুরের হাতে গড়া অরাজনৈতিক কওমী সংগঠনকে পরিকল্পিতভাবে জামায়াত-শিবির, বিএনপির হাতে তুলে দেওয়ার ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে।’ আল্লামা শফীর ‘হত্যা’র বিচারের আগে কোনো কাউন্সিল না করার জন্য হেফাজতে ইসলামের সকল দায়িত্বশীলদের কাছে অনুরোধ জানান তিনি।

সংবাদ সম্মেলনে শাহ আহমদ শফীর ছেলে হেফাজতের কেন্দ্রীয় কমিটির প্রচার সম্পাদক আনাস মাদানী উপস্থিত থাকার কথা থাকলেও ‘হত্যার হুমকি’ থাকায় তিনি পালিয়ে বেড়াচ্ছেন বলে জানানো হয়।

সংবাদ সম্মেলনে হেফাজতের কাউন্সিলের বিরুদ্ধে উচ্চকণ্ঠ ছিলেন সংগঠনের কেন্দ্রীয় যুগ্ম-মহাসচিব মঈনুদ্দীন রুহী। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘পত্র-পত্রিকার রিপোর্ট এবং তাদের (কাউন্সিল আহ্বানকারী) চলাফেরা-গতিবিধি অনুসরণ করে এটা দিনের মতো পরিষ্কার যে, জামায়াত-শিবিরের এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্যই এই কাউন্সিল। কিছুসংখ্যক উচ্চাভিলাষী রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়ন করছে। আজ যারা কাউন্সিল করছে তাদের কারও কারও ছবি দেখা গেছে তাদের (জামায়াত) সাথে। অনুরোধ করছি, আপনারা মূলধারায় ফিরে আসুন। আমরা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছি। ১৫ নভেম্বরের পর সিনিয়রদের সঙ্গে আলোচনা করে ব্যবস্থা নেব।’

২০১৩ সালের ৫ মে শাপলা চত্বরে হেফাজতের সঙ্গে জামায়াত ছিল কি-না?- এমন প্রশ্নের জবাবে মঈনুদ্দীন রুহী বলেন, ‘জামায়াতকে নিয়ে আমরা মাঠে কখনও প্রোগ্রাম করিনি। শাপলা চত্বরে জামায়াত বা বিএনপিকে ডাকিনি। কওমী অঙ্গন এবং আহমদ শফী জামায়াত-শিবির ও মওদুদীবাদের বিরুদ্ধে। জামায়াত শিবিরের কর্মীরা যদি হেফাজতের অজ্ঞাতে কোনো কর্মসূচিতে ঢুকে পড়তে পারেন বা কারও কারও তাদের সঙ্গে যোগাযোগ থাকতে পারে। তবে কোনো রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়নে আমরা ছিলাম না। আমরা রাজনীতির সিঁড়ি নই। কাউকে ক্ষমতা থেকে নামাতে বা কাউকে বসাতে আমরা নই। জামায়াতের সঙ্গে আমাদের আদর্শিক সংঘাত দীর্ঘদিনের।’

লিখিত বক্তব্যে মঈনুদ্দীন বলেন, ‘হেফাজতের সকল সদস্য, কওমী আলেম, ছাত্র ও দেশে-বিদেশে অবস্থানরত ভক্তদের প্রতি পরিবারের পক্ষ থেকে আকুল আবেদন, হুজুরের হাতে গড়া অরাজনৈতিক সংগঠন হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশকে দেশদ্রোহী জামায়াত-শিবির ও তাদের প্রেতাত্মাদের হাতে যাতে না যায় তার জন্য স্ব স্ব অবস্থান থেকে প্রতিরোধ গড়ে তুলুন।

হেফাজতে ভাঙন হয়েছে কি না জানতে চাইলে রূহী বলেন, ‘আল্লামা আহমদ শফী হেফাজতের প্রতিষ্ঠাতা। যারা উনার মতাদর্শে থাকবে তারাই আসল হেফাজতে ইসলাম। হেফাজতে ইসলামের বর্তমানে কোনো শুরা কমিটি নেই। করা হয়নি। ২০১৪ সালে প্রস্তাব হয়েছিল। কিন্তু শফী হুজুর বলেছিলেন, শুরা করলে সারাদেশের আলেমদের নিয়ে করতে হবে। হেফাজতে ইসলাম এত বড় সংগঠন যে হাজার খানেক সদস্য হবে শুরার। তাই শুরা কমিটি হয়নি।’

‘নিজেরা আমীর হওয়ার জন্য এখন শুরা কমিটির কথা বলা হচ্ছে। আমাদের গঠনতন্ত্র অনুসারে আমীরের অবর্তমানে সিনিয়র নায়েবে আমীর ভারপ্রাপ্ত হবেন। কেন্দ্রীয় কমিটি ও নির্বাহী কমিটির মতামতের ভিত্তিতে আমীর নির্বাচন হবে। কেন্দ্রীয় ও নির্বাহী কমিটির এখন পর্যন্ত কোনো সভা হয়নি। মহাসচিব নিজেই কাউন্সিলের ডাক দিয়েছেন‘— বলেন মঈনুদ্দীন রুহী।

কাউন্সিলে আমন্ত্রণ পেলে যাবেন কি না?- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘কাউন্সিল যিনি আহ্বান করেছেন বলে জানা গেছে সেই মহিবুল্লাহ বাবুনগরী ২০১৬ সালে পদত্যাগ করেছেন। এর পর আর হেফাজতে ফিরে আসেননি। তাই উনার ডাকা এই কাউন্সিল অবৈধ। সাতজন যুগ্ম-মহাসচিবের মধ্যে পাঁচজন আমন্ত্রণ পাননি। ৩৫ জন নায়েবে আমীরের মধ্যে ২৩ জন এখনও দাওয়াত পাননি। তাদের বাদ রেখেই সম্মেলন করা হচ্ছে।’

সংবাদ সম্মেলনে হেফাজতের কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা সলিমউল্লাহ, কেন্দ্রীয় সদস্য মাওলানা সারওয়ার, আশরাফ উদ্দিন, আতিক মোহাম্মদ, মো. কাসেম, শামসুল হক ও ওসমান কাসেমী উপস্থিত ছিলেন।

কাউন্সিল টপ নিউজ ভাঙন সংবাদ সম্মেলন হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর