Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

২ কাঠার কম প্লটে ঝুঁকিপূর্ণভাবে গড়ে উঠছে ৮ তলা ভবন, নীরব রাজউক


১৬ নভেম্বর ২০২০ ১৪:৩৫

ঢাকা: রাজধানীর মোহাম্মদপুরে দুই কাঠার কম আকারের জমিতে ঝুঁকিপূর্ণভাবে গড়ে উঠছে আট তলা ভবন। এরইমধ্যে ভবনটির সাত তলার কাজ শেষ করেছে নির্মাতা প্রতিষ্ঠান এইচ আই টেকনোলজি অ্যান্ড প্রপার্টিজ। তবে ভবনটি নির্মাণকাজে ইমারত বিধি অনুসরণের বালাই নেই। চারপাশেও ছাড়া হয়নি জায়গা। এভাবে নিয়মনীতি না মেনে বহুতল ভবন হওয়ায় তৈরি হচ্ছে অগ্নিদুর্ঘটনার ঝুঁকি।

স্থানীয় প্রতিবেশীদের অভিযোগ, নির্মাণকাজ তদারকির জন্য রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক)  জোনাল অফিস-৩ এর দায়িত্ব থাকলে তারা ঠিকমতো তদারকি করছে না। রাজউকের মাঠ পরিদর্শকরা নামকাওয়াস্তে প্লট পরিদর্শন করেছে। ফলে অবৈধভাবে ভবন নির্মাণের বিষয়ে তারা শুরু থেকেই কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। রাজউকের জোনাল অফিসের গাফিলতির সুযোগ নিয়ে এইচ আই প্রপার্টিজের চেয়ারম্যান হাজী মো. ইমাম হোসেন অবৈধভাবে ভবনটি গড়ে তুলছেন বলে অভিযোগ স্থানীয়দের।

বিজ্ঞাপন

নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় একজন ব্যবসায়ী বলেন, ‘কোনো ভবনের নির্মাণকাজ শুরু হলে তা রাজউকের মনিটরিং করার কথা। অনেক সময় রাজউকের পরিদর্শক এলেও তারা নির্মাণ সংশ্লিষ্টদের মাধ্যমে কনভিন্সড হয়ে ফিরে যান। ফলে বিধি না মেনে ভবন নির্মাণ করলেও নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ভেবে নেন তাদের কিছুই হবে না।’ তবে রাজউক বলছে, কারও কনভিন্সড হওয়ার সুযোগ নেই। নির্মাণ বিধিমালার বাইরে কারও যাওয়ার সুযোগ নেই।

সরেজমিনে পাওয়া তথ্য সংবলিত সাইনবোর্ড অনুসারে রাজিয়া সুলতানা রোডের ডি ব্লকের ওয়াই-২৩ প্লটে আট তলা ভবনের নির্মাণ কাজ চলছে। প্লটটিতে জমির পরিমাণ ১ দশমিক ৮ কাঠা। যা পৌনে ২ কাঠার একটু বেশি। এটির নির্মাণ অনুমোদন স্মারক: ২৫.৩৯.০০০০.০৯৮.৩৩.৬৬৪.১৯ তারিখ: ২০ নভেম্বর ২০১৯। মোহাম্মদপুর হাউজিং এস্টেট মৌজার ভূমি জোত নং ৮২/৫৬

বিজ্ঞাপন

ইমারত নির্মাণ বিধিমালা অনুযায়ী ভবন নির্মাণের বেলায় ভবনের সামনে এবং চারপাশে অবশ্যই পর্যাপ্ত জায়গা ছেড়ে ভবন নির্মাণ করতে হবে। এ ছাড়া ফ্লোর এরিয়া রেশিও (ফার) অনুসরণ করতে হবে।

বাংলাদেশ ইমারত নির্মাণ বিধিমালা ৯৬ এর ১২ নং ধারার (১) উপধারা অনুযায়ী ৮ তলা উচ্চতার বিল্ডিং নির্মাণের ক্ষেত্রে ইমারতের সামনে কমপক্ষে ২৫ ফুট এবং ৬ তলা উচ্চতার বিল্ডিং নিমার্ণের ক্ষেত্রে কমপক্ষে ১৫ ফুট প্রশস্ত রাস্তা থাকা বাধ্যতামূলক। কিন্তু নির্মাণাধীন ওই ভবনের সামনে রাস্তার প্রশস্ততা ২০ ফুট।

এ ছাড়া নির্মাণ বিধিমালার ৮ নং বিধির ৫ উপবিধি অনুযায়ী উল্লেখিত ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে নিকটবর্তী সড়কের সেন্টার বা কেন্দ্র হতে কমপক্ষে ৪.৫ মিটার অথবা সড়ক সংলগ্ন ইটের সীমানা থেকে ১.৫ মিটার দূরে ইমারত নির্মাণ করতে হবে। বিধিমালা অনুযায়ী ভবনের পেছনে জায়গা ছাড়তে হবে ১ মিটার ও ভবনের পাশে জায়গা ছাড়তে হবে ০.৮ মিটার।

সরেজমিনে দেখা যায় ওই ভবনে পেছনে জায়গা ছাড়া হয়েছে মাত্র ১ ফুট। নির্মাণাধীন ভবনের দুই পাশে কোনো জায়গায়ই ছাড়া হয়নি। ভবনের কাঠামো পাশের দুই ভবনের সঙ্গে জোড়া লাগিয়ে তৈরি করা হয়েছে। এতে সৃষ্টি হয়েছে অগ্নিদুর্ঘটনার ঝুঁকিও। কেননা এক ভবনে আগুন লাগলে বা বৈদ্যুতিক দুর্ঘটনা ঘটলে তাতে পাশের ভবনও ঝুঁকিতে পড়বে।

নির্মাণ বিধিমালার সংশোধনী অনুযায়ী নতুন বাড়ি নির্মাণের ক্ষেত্রে বিশেষ করে ২ কাঠা বা এর নিচের পরিমাণ জমিতে বাড়ি বা আবাসিক হোটেল নির্মাণে চারপাশের জমি ছাড়তে হবে সাড়ে ৩০ ভাগ। আর বাকি সাড়ে ৬৯ ভাগে ভবন নির্মাণ করা যাবে। এইচ আই টেকনোলজিস অ্যান্ড প্রপার্টিজ ভবনটি নির্মাণ করার ক্ষেত্রে জায়গা ছাড়ার এই নিয়মটিও মানেনি।

বাংলাদেশ ইমারত নির্মাণ বিধিমালায় সর্বোচ্চ ৭ তলা ভবন নির্মাণের সময় ফায়ার সার্ভিস, পরিবেশ অধিদপ্তর, গ্যাস, ওয়াসা ও বিদ্যুৎ বিভাগের ছাড়পত্র নেওয়া বাধ্যতামূলক। পাশাপশি বহুতল ভবনে ফায়ার ডিটেক্টের, স্মোক ডিটেক্টের, উচ্চগতির পানি স্প্রে সিস্টেম ও কার্বনডাইঅক্সাইড নির্গমণ সিস্টেম থাকাও বাধ্যতামূলক হিসেবে উল্লেখ আছে। কিন্তু এ সব নিয়মের কোনো বালাই রাখা হয়নি ওই ভবনে। ভবনটির নির্মাণ তদারকির জন্য একজন সাইট ইঞ্জিনিয়ার সার্বক্ষণিক দায়িত্ব পালন করে। রাজউকের শর্ত অনুযায়ী প্রজেক্টে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র এক সেট রাখার কথা থাকলে সেখানে নির্মাণ সংক্রান্ত কোনো রাখা হয়নি বলে দাবি করেন ভবনের সাইট ইঞ্জিনিয়ার।

কেন পদে পদে নিয়ম লঙ্ঘন জানতে চাইলে নির্মাণাধীন ওই প্রজেক্টের সাইট ইঞ্জিনিয়ার নাহিদ বলেন, ‘আমি এখানে নতুন এসেছি। এ বিষয়ে কিছু জানি না। ভবনটির বেজমেন্ট ও ফাউন্ডেশন অন্য একজন ইঞ্জিনিয়ারের তত্ত্বাবধানে করা হয়েছে। আমি ছিলাম না’

‘দুই কাঠার কম জমিতে কতটুকু ভবন করতে হয় সেটি জানেন তো’ উল্লেখ করলে সাইট ইঞ্জিনিয়ার বলেন, ‘আমি জানি। তবে এখানে আট তলা কীভাবে হচ্ছে তা বলতে পারব না। আমার একটি ফোন কল এসেছে’ এই বলে কল সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন নাহিদ।

তবে নির্মাতা প্রতিষ্ঠানটির ভূমি ও বিক্রয় বিভাগের ম্যানেজার মো. সুমন বলেন, ‘দুই কাঠার প্লটে ৮ তলা ভবন করা যায় না, এটি রাজউকের নিয়মে ঠিক আছে। কিন্তু সবাই তো নিয়ম পুরোপুরি মানে না। তবে রাজউকের আগের চেয়ারম্যান বিশেষ বিবেচনায় এটির অনুমোদন দিয়েছেন।’

ইমারত বিধিমালা না মেনে কেউ বিশেষ অনুমোদন দিতে পারে কি না- উল্লেখ করলে সুমন বলেন, ‘আমি বেশি কিছু জানি না।’ এ সময় প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান হাজী মো. ইমাম হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগ করার মোবাইল নম্বর চাইলে ভূমি ও বিক্রয় বিভাগের ম্যানেজার সুমন বলেন, ‘আপনারা আমাদের বিরুদ্ধে নিউজ করবেন। নম্বর তো এখন দেওয়া যাবে না। এটি কোম্পানির কেউই দেবে না। ’

অবৈধভাবে ভবন নির্মাণ করা হলেও কিছুই জানেন না বলে দাবি করেন প্রতিষ্ঠানটির জেনারেল ম্যানেজার আবদুল গনিও। তিনি এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘আমি নতুন এসেছি। এই বিষয়টি আমার জানা নেই।’

এ সময় এই প্রতিবেদকের ‘উদ্দেশ্য’ সম্পর্কেও কৈফিয়ত চান প্রতিষ্ঠানটির জি এম আবদুল গণি। এ বিষয়ে সংবাদ করতে চাই উল্লেখ করলে তিনি বলেন ‘আমি বিষয়টি জেনে আপনাকে পরে জানাতে পারব।’ এরপর একাধিকবার কল করা হলেও প্রতিষ্ঠানটির জি এম আর ফোন কল ধরেননি।

দুই কাঠার কম জায়গায় ৮ তলা ভবন করা বিধি অনুযায়ী সম্ভব কি না জানতে চাইলে রাজউকের জোনাল-৩ এর সহকারী অথরাইজড অফিসার রঙ্গন মণ্ডল বলেন, ‘কোনো ভবনের নির্মাণ অনুমোদন দেওয়ার সময় আমরা ফ্লোর এরিয়া রেশিও (ফার) বিবেচনায় নিই। কোনো প্লটের সামনে যদি ৬০ ফুটের বেশি প্রশস্ত রাস্তা থাকে তাহলে দুই কাঠার কম জমিতে আট তলা হতে পারে।’

নির্মাণাধীন ভবনের সামনে রাস্তার প্রশস্ততা ২০ ফুট উল্লেখ করলে অথরাইজড অফিসার রঙ্গন মণ্ডল বলেন, ‘তাহলে দুই কাঠার কম প্লটে ৮ তলা ভবন নির্মাণটি বিধিসম্মত হচ্ছে না। এটা ডিফিকাল্ট এবং টাফ। আমরা বিষয়টির খোঁজ নেব।’

বিধিমালা না মেনে ভবন নির্মাণ করার বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা-১ শফিউল হক বলেন, ‘কেউ অভিযোগ দিলে আমরা বিষয়টি বিবেচনায় নেব। অথরাইজড অফিসারকে আমি বলব, তিনি সরেজমিনে পরিদর্শন করবেন।’

অবৈধ ভবন এইচ আই প্রপার্টিজ ভবন নির্মাণ রাজউক রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর