ধর্ষণের সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ড— সংসদে বিল পাস
১৭ নভেম্বর ২০২০ ২২:১৫
ঢাকা: ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান রেখে জাতীয় সংসদে ‘নারী ও শিশু নির্যাতন দমন (সংশোধন) বিল-২০২০’ পাস হয়েছে। এর ফলে ধর্ষণের সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ডের বিধানটি আইনে পরিণত হলো।
মঙ্গলবার (১৬ নভেম্বর) মহিলা ও শিশু বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী বেগম ফজিলাতুন নেসা সংসদীয় কমিটির সুপারিশ আকারে বিলটি পাসের প্রস্তাব করলে তা কণ্ঠভোটে পাস হয়। বিলে বলা হয়েছে, বিদ্যমান আইনে ‘যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে’ শব্দগুলোর পরিবর্তে ‘মৃত্যুদণ্ডে বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে’ শব্দগুলো প্রতিস্থাপিত হবে।
স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বেবিলটি পাসের সময় জনমত যাচাই ও বাছাই কমিটিতে পাঠানোর প্রস্তাব দিয়ে বিএনপির মো. হারুনুর রশিদ ওব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা এবং জাতীয় পার্টির মো. ফখরুল ইমাম ও শামীম হায়দার পাটোয়ারী বলেন, শুধু কঠোর আইন করলেই ধর্ষণ বন্ধ হবে না, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। একইসঙ্গে আইনের কঠোর প্রয়োগ করতে হবে। তারা বলেন, আইনটি অধ্যাদেশের মাধ্যমে এরই মধ্যে কার্যকর হলেও ধর্ষণ ও নারী নির্যাতন এখনো বন্ধ হয়নি।
বিলটি পাসের আগে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন অনুযায়ী ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি ছিল যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। এর মধ্যে দেশব্যাপী ধর্ষণসহ যৌন সহিংসতার ঘটনা আশঙ্কাজনকভাবে বাড়তে থাকলে দেশব্যাপী এসব অপরাধের বিরুদ্ধে কঠোরতম শাস্তি নিশ্চিত করার দাবি ওঠে। বিশেষ করে সিলেটের মুরারী চাঁদ (এমসি) কলেজ ক্যাম্পাসে স্বামীকে আটকে রেখে এক গৃহবধূকে দলবেঁধে ধর্ষণ এবং নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে এক গৃহবধূকে বিবস্ত্র করে বর্বরোচিত নির্যাতন চালিয়ে তার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়ার পর সেই দাবি আরও জোরালো হয়ে ওঠে।
এর পরিপ্রেক্ষিতে গত ১২ অক্টোবর মন্ত্রিসভার এক বৈঠকে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান রেখে আনা সংশোধনীর খসড়ায় অনুমোদন দেয় মন্ত্রিসভা। পরে এই সংশোধনী অবিলম্বে কার্যকর করতে ১৩ অক্টোবর রাষ্ট্রপতি অধ্যাদেশ জারি করেন। বিধি অনুযায়ী, অধ্যাদেশ জারির পরবর্তী সংসদ অধিবেশনেই একে আইনে পরিণত করতে হয়। সে প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে গত ৮ নভেম্বর বিলটি সংসদে উত্থাপন করা হয়।
বিলটি পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের সংশোধনীতে ‘ধর্ষিতা’ শব্দটির বদলে ‘ধর্ষণের শিকার’ শব্দ বসানোর সুপারিশ করে। সোমবার (১৬ নভেম্বর) সংসদে এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়। প্রতিবেদনে ‘ধর্ষিতা’ শব্দটি লিঙ্গ বৈষম্যের পরিচায়ক বলে বিভিন্ন সময় মত আসার প্রেক্ষাপটে মূল আইনের ৯ (২) ধারাসহ কয়েক জায়গায় ‘ধর্ষিতা’ শব্দটি বাদ দিয়ে ‘ধর্ষণের শিকার’ শব্দটি বসানোর সুপারিশ করা হয়।
২০০০ সালের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ৯(১) উপধারায় বলা হয়, যদি কোনো পুরুষ কোনো নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করেন, তাহলে তিনি যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হবেন এবং এর অতিরিক্ত অর্থদণ্ডেও দণ্ডনীয় হবেন। সংশোধিত আইনের খসড়ায় ৯(১) উপধারায় ‘যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড’ শব্দগুলো ‘মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড শব্দগুলো দিয়ে প্রতিস্থাপন করা হয়েছে।
আইনের ৯(৪) (ক) উপধারায় ছিল— যদি কোনো ব্যক্তি কোনো নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করে মৃত্যু ঘটানোর বা আহত করার চেষ্টা করেন, তাইলে ওই ব্যক্তি যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হবেন এবং এর অতিরিক্ত অর্থদণ্ডেও দণ্ডনীয় হবেন। এই উপধারা সংশোধন করে খসড়ায় ‘যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড’-এর পরিবর্তে ‘মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড’ শব্দগুলো যোগ করা হয়েছে। অধ্যাদেশ অনুযায়ী, ধর্ষণ ছাড়া সাধারণ জখমের ক্ষেত্রে অপরাধ আপসযোগ্য হবে। এছাড়া আগের আইনে ১৯৭৪ সালের শিশু আইনের রেফারেন্স ছিল। এখন সেখানে হবে ‘শিশু আইন ২০১৩’।
২০০০ সালের আইনের ৩২ ধারায় বলা ছিল, এই আইনের অধীন সংঘটিত অপরাধের শিকার ব্যক্তির সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে মেডিকেল পরীক্ষা সরকারি হাসপাতালে কিংবা সরকার কর্তৃক এ উদ্দেশ্যে স্বীকৃত কোনো বেসরকারি হাসপাতালে সম্পন্ন করা যাবে। বিলে অপরাধের শিকার ব্যক্তির পাশাপাশি ‘অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তির’ মেডিকেল পরীক্ষা করার বিষয়টি যুক্ত করা হয়েছে।
এছাড়া ৩২ ধারার সঙ্গে ৩২(ক) শিরোনামে নতুন একটি ধারা যুক্ত করা হয়েছে বিলে। সেখানে বলা হয়েছে, এই আইনের অধীন সংঘটিত অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তি এবং অপরাধের শিকার ব্যক্তির ধারা ৩২-এর অধীন মেডিকেল পরীক্ষা ছাড়াও, ওই ব্যক্তির সম্মতি থাকুক বা না থাকুক, ২০১৪ সালের ডিঅক্সিরাইবোনিউক্লিক এসিড (ডিএনএ) আইনের বিধান অনুযায়ী তার ডিএনএ পরীক্ষা করতে হবে।
বিলের উদ্দেশ্য ও কারণ বিষয়ক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, নারী ও শিশু ধর্ষণ একটি জঘন্য অপরাধ। নারী ও শিশু নির্যাতনমূলক অপরাধ কঠোরভাবে দমনের উদ্দেশ্যে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন-২০০০ প্রণয়ন করা হয়। বর্তমান আর্থসামাজিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়নের মধ্যে দেশে নারী ও শিশু ধর্ষণের মতো জঘন্য অপরাধ সংঘটন সামাজিক গতিশীলতায় নেতিবাচক প্রভাব ও সার্বিক সামাজিক উন্নয়নের ধারাকে বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। তাই এমন অপরাধ দমনে অপরাধীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে আইনে সর্বোচ্চ দণ্ডের বিধান যুক্ত করতে এই বিলটি আনা হয়েছে।
আইনের সংশোধনী ধর্ষণের সর্বোচ্চ সাজা বিল পাস মৃত্যুদণ্ড সংসদ অধিবেশন সংসদে বিল