সরগরম ‘কম্বল গ্রাম’, ঝুটের জোড়াতালিতে হচ্ছে কর্মসংস্থান
১৮ নভেম্বর ২০২০ ০৮:৪০
সিরাজগঞ্জ: প্রকৃতিতে শীতের আগমনী বার্তায় সিরাজগঞ্জের কাজীপুর উপজেলার ‘কম্বল গ্রাম’ হিসেবে পরিচিত এলাকাগুলো সরগরম হয়ে উঠেছে। এসব গ্রামের নানা বয়সী মানুষ নতুন-পুরোনো কম্বল তৈরি করতে ব্যস্ত সময় পার করছেন। শীত যত এগিয়ে আসছে, তাদের কাজের চাপও তত বাড়ছে।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, প্রায় দুই দশক আগে উপজেলার ছালাভরা কুনকুনিয়া গ্রামের আব্দুল খালেক প্রথমে ঝুট কাপড় দিয়ে কম্বল তৈরির কারখানা শুরু করেন। পরে বর্শীভাঙ্গা গ্রামের ছাইদুল হকও শুরু করেন এই ঝুট কাপড় দিয়ে কম্বল তৈরির ব্যবসা। তারা ঢাকা থেকে গার্মেন্টসের পরিত্যক্ত ঝুট কাপড় নিয়ে এসে জোড়াতালি দিয়ে তৈরি করেন কম্বল। সাইকেলে করে সেই কম্বল বিক্রি শুরু হয় গ্রামে গ্রামে। ধীরে ধীরে এ ব্যবসা অন্য এলাকাতেও ছড়িয়ে পড়ে।
বর্তমানে উপজেলার শিমুলদাইড়, বর্শীভাঙ্গা, সাতকয়া, শ্যামপুর, ছালাভরা, কুনকুনিয়া, পাইকরতলী, ঢেকুরিয়া, বরইতলা, মুসলিমপাড়া, মানিকপটল, গাড়াবেড়, রশিকপুর, হরিনাথপুর, ভবানীপুর, মাথাইলচাপড়, রৌহাবাড়ী, পলাশপুর, বিলচতল, লক্ষ্মীপুর, বেলতৈল, চকপাড়া, চালিতাডাঙ্গা, কবিহার ও হাটশিরা গ্রামের ২৫ হাজার মানুষ এখন কম্বল তৈরির সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত।
তাদেরই একজন রহিমা বেগম (৪৫)। স্বামীর একার আয়ে সংসার চলে না। তাই উপজেলা গভর্ন্যান্স প্রজেক্টের (ইউজেডজিপি) আওতায় প্রশিক্ষণ নিয়ে গার্মেন্টসের ঝুট কাপড় জোড়াতালি দিয়ে তৈরি করছেন কম্বল। রহিমার মতো, ছকিনা, জরিমন, তাহেরা, কদবানু, রোমেলারাও জড়িয়েছেন এই বিকল্প কর্মসংস্থানে।
মাইজবাড়ী ইউনিয়নের ছালাভরা গ্রামের কম্বল তৈরির কারিগর আমিনুল ইসলাম জানান, গার্মেন্টসের ফেলে দেওয়া ঝুট কাপড় বিশেষ কায়দায় সেলাই করে তৈরি করা হয় কম্বল। অনেকে ঢাকা থেকে ঝুট কিনে আনেন। সেলাইয়ের কাজে পরিবারের সবাই সাহায্য করে। তবে কয়েক বছর ধরে নতুন কাপড় কেটেও চলছে কম্বল তৈরির কাজ। নতুন সেলাই মেশিনও ব্যবহার করা হচ্ছে।
বর্তমানে একটি লেপ তৈরি করতে ৮০০ থেকে ১ হাজার টাকা লাগে। অথচ একটি ঝুট কম্বল ১৫০ থেকে ৩০০ টাকার মধ্যে পাওয়া যায়। ব্লেজার তৈরির পরিত্যক্ত ঝুট জোড়া দিয়ে বানানো কম্বল একদিকে যেমন হালকা, অন্যদিকে প্রচণ্ড শীতেও এসব কম্বল বেশ গরম ও আরামদায়ক। গতবছর এই ঝুট প্রতি কেজি ১০-১২ টাকায় কেনা যেত। বর্তমানে ১৫ থেকে ২০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। গরমের সময় প্রতি কম্বলের মজুরি ২০ টাকা এবং শীতের সময় ৪০ টাকা। অনেক নারী গৃহস্থালির কাজের ফাঁকে ফাঁকে এই কম্বল সেলাই করেন। তারা প্রতিদিন কম্বল সেলাই করে ১০০ থেকে ২০০ টাকা পর্যন্ত আয় করেন তারা।
ঝুট ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘ঝুট কম্বলের চাহিদা দিন দিন বেড়েই চলেছে। এর চাহিদা বর্তমানে দেশব্যাপী। এখানকার কাপড় সঠিকভাবে বিক্রি ও অর্ডার পেলে নারীরা দিনে যা আয় করতে পারে তা দিয়ে তাদের সংসার ভালোই চলার কথা। কিন্তু ঝুট কাপড় ভারতে যাচ্ছে। এখন বেশি টাকা দিয়েও চাহিদা অনুযায়ী ঝুট পাওয়া যাচ্ছে না।’
মাইজবাড়ি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান তালুকদার জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘এই শিল্পকে আমি আর্শীবাদ হিসেবে নিয়েছি। ঝুটের কম্বল তৈরির শিল্পটি কাজিপুরের মানুষের ভাগ্য বদলে বড় ভূমিকা রাখছে। শিল্প হিসেবে স্বীকৃতি পেলে ব্যাংক থেকেও ব্যবসায়ীরা অনেক ধরনের সুযোগ পাবে। এতে ব্যবসার প্রসার ও আরও বেশি মানুষের কর্মসংস্থান হবে।’
কাজীপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) জাহিদ হাসান সিদ্দিকী জানান, এলাকাবাসীর দাবি অনুযায়ী শিমুলদাইড় বাজারে কর্মসংস্থান ব্যাংকের একটি শাখা অল্পদিনের মধ্যে কাজ শুরু করবে। এই শিল্পের প্রসারে বর্তমানে সরকারিভাবে কেনা বেশির ভাগ কম্বল এখান থেকে সরবরাহ করা হয়। কম্বল ব্যবসায়ীদের সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতেও ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। কাজীপুরের কম্বলের বহুল প্রসারের জন্য দেশের বিভিন্ন উপজেলার ইউএনওকে চিঠি দেওয়া হচ্ছে বলেও জানান তিনি।
কম্বল গ্রাম কর্মসংস্থান ঝুটের জোড়াতালি শীত সিরাজগঞ্জের কাজীপুর