প্রশ্নের মুখে পরিসংখ্যানের নির্ভরযোগ্যতা
১৯ নভেম্বর ২০২০ ০৯:০১
ঢাকা: দেশের পরিসংখ্যানের মান, বিশ্বাসযোগ্যতা ও কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এর আগেও বিভিন্ন সময়ে নানা আলোচনা-সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএসক)-কে। তবে এবার দেশের দরিদ্র্যতম এলাকার বিষয়ে দুটি সংস্থার করা ভিন্ন জরিপের তথ্যের বিপরীত চিত্র উঠে আসায় নতুন করে আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়েছে।
তাছাড়া সম্প্রতিকালে প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের স্ট্যাটিসটিক্যাল ক্যাপাসিটি স্কোরে সরকারি সংস্থাগুলোর পরিসংখ্যানগত দুর্বলতার চিত্র উঠে এসেছে। এক্ষেত্রে সংস্থাটি বলছে, গত পাঁচ বছরে বাংলাদেশে পরিসংখ্যানগত দুর্বলতা আরও তীব্র হয়েছে। দেশের তথ্যের নির্ভরযোগ্যতা সর্বোচ্চ পর্যায়ে উঠেছিল ২০১৪ সালে। সে বছরে বাংলাদেশ ১০০-এর মধ্যে প্রায় ৮০ পয়েন্ট পেয়েছিল বাংলাদেশ। কিন্তু ২০১৯ সালে বাংলাদেশের স্কোর পয়েন্ট কমে ৬২ দশমিক দুইয়ে দাঁড়িয়েছে।
পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য (সিনিয়র সচিব) ড. শামসুল আলম সারাবাংলাকে বলেন, ‘সবসময় বিবিএসের সঙ্গে অন্য সংস্থার জরিপের ফল নাও মিলতে পারে। কেন না বিবিএস এর নমুনা এবং তথ্যভাণ্ডার ব্যাপক। পক্ষান্তরে অন্যান্য সংস্থাগুলোর নমুনা ও পদ্ধতি আলাদা। তবে অনেক সময় যেহেতু প্রশ্ন উঠে তাই পরিসংখ্যান ব্যুরোকে আরও সতর্ক হতে হবে। তাছাড়া পরিকল্পনা যতই ভালোভাবে লিখি না কেন, পরিসংখ্যান বা তথ্য-উপাত্ত যদি ঠিক না হয় তাহলে কোনো লাভ হবে না।’
সূত্র জানায়, বিবিএসের হিসাব অনুযায়ী দেশের সবচেয়ে দরিদ্র্যতম এলাকা উত্তরাঞ্চল। রংপুর বিভাগে সবচেয়ে বেশি দরিদ্র্য মানুষের বাস। জেলার মধ্যে সবচেয়ে গরীব জেলা কুড়িগ্রাম। কিন্তু বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পপুলেশর রিসার্স অ্যান্ড ট্রেইনিং এবং আইসিডিডিআরবির যৌথ এক জরিপে উঠে এসেছে ভিন্ন চিত্র। এ জরিপে দেখা গেছে, কুড়িগ্রাম নয়, সবচেয়ে দরিদ্র্যতম জেলা পটুয়াখালী। সবচেয়ে গরীব উত্তরাঞ্চল নয়, দক্ষিণাঞ্চল। তবে এই জরিপটি পরিচালনা করা হয়েছে আর্থ-সামাজিক অবস্থা এবং পারিবারিক আয় ধরে। অন্যদিকে বিবিএস এর তথ্য খানা আয় ও ব্যয়ভিত্তিক। এদিকে বিবিএস সম্প্রতিকালে প্রকাশিত মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি সংক্রান্ত তথ্য নিয়েও ব্যাপক প্রশ্ন উঠেছিল । কেন না সংস্থাটির হিসাব মতে গত অর্থবছরের (২০১৯-২০) শেষ তিন মাস করোনার কারণে সব কিছুই স্থবির থাকলেও প্রবৃদ্ধি দাঁড়িয়েছে ৫ দশমিক ২৪ শতাংশ। এছাড়া লেবার ফোর্স সার্ভের (এলএফএস) জন্য ২০১৩ সালে যে জরিপ করা হয় তার ফল প্রকাশ পায় ২০১৫ সালে। সর্বশেষ এলএফএস প্রকাশিত হয়েছে ২০১৮ সালে। এতে মূলত ২০১৬-১৭ সালের তথ্য নিয়ে বিশ্লেষণ করা হয়েছে। আর গত তিন বছরে কোনো শ্রম শক্তি জরিপ প্রতিবেদনই প্রকাশ পায়নি। অনিয়মিত প্রকাশের কারণে সূচকের মানদণ্ডেও পিছিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। ২০১১ সালে অর্থনৈতিক শুমারি অনুষ্ঠিত হলেও পূর্ণাঙ্গ ফল প্রকাশিত হয় ২০১৫ সালে। ফলে দেরিতে প্রকাশের কারণে উপাত্তের গুরুত্ব অনেকটাই ম্লান হয়ে পড়ে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান সমিতির সভাপতি প্রফেসর ড. পি কে মতিউর রহমান বলেন, ‘একদিকে জনগণ তথ্য দেওয়ার ক্ষেত্রে সচেতন নয়। অপরদিকে যেকোনো জরিপে দেখা যায় মনিটরিং-এর অভাব। সার্ভেগুলোতে প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়লেও সঠিক সময় সঠিক তথ্য আসছে না। অনেক সময় জটিল ও ব্যাপক প্রশ্নপত্রের কারণে মানুষ উত্তরও দিতে চায় না। কোনো শুমারির রিপোর্ট দিতে যদি দীর্ঘ সময় লেগে যায়, তাহলে তথ্যের ব্যবহার উপযোগিতা কমে যায়। পরিসংখ্যান ব্যুরোর সক্ষমতা বাড়লেও গাফিলতির কারণে এমনটা হচ্ছে। এটা তাদের ব্যার্থতা।
বিবিএসের মহাপরিচালক মো. তাজুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, ‘বিশ্বব্যাংক যে তথ্য দিয়েছে সেটি আন্তর্জাতিক অবস্থার প্রেক্ষিতে। আমরা এখন অনেকদূর এগিয়েছি। কিন্তু উন্নত দেশের সমপর্যায়ে যেতে পারিনি। জিডিপি প্রবৃদ্ধির হিসাবে আমাদের নিজস্ব ডাটার চেয়ে অন্য সংস্থার ডাটাই বেশি ব্যবহার হয়। কাজেই সেটি মানুষ বিশ্বাস না করলে আমরা কি করতে পারি। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘কোন জরিপের ফল পেতে এখন দুই-তিন বছর লাগে না। আমি ধাক্কা দেওয়া মানুষ। তাই ধাক্কা দিয়েই দ্রুত কাজ করাচ্ছি। অপর এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘একই মানুষের কাছে আজ যে তথ্য নেবেন, কয়েকদিন পরে আবার গেলে তার তথ্যের ভিন্নতা হবে। তাই কোন সংস্থা কি তথ্য দিলো সেটি আমার জানানেই।’
বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন সারাবাংলাক বলেন, ‘বিবিএসের জরিপের ফলাফলের তথ্য নিয়ে খুব বেশি প্রশ্নের সৃষ্টি হয় না। তবে সবচেয়ে বেশি প্রশ্নের মুখে পড়ে জিডিপি প্রবৃদ্ধির তথ্য। গুরুত্বপূর্ণ যেসব জরিপ (শ্রম শক্তি, দারিদ্র্যতা এবং জাতীয় আয়ের হিসাব) এসব নিয়মিতভাবেই করা দরকার। এই হিসাবগুলো যদি নিয়মিত তারা দিতে না পারে তাহলে এত বড় প্রতিষ্ঠান রেখে লাভ কি?। কেন না অনিয়মিত হওয়ায় হালনাগাদ তথ্য পাওয়া যায় না। তাছাড়া সময়মতো জরিপের ফল প্রকাশ না হওয়ায় অনেক সময় সেগুলোর কার্যকারিতা প্রশ্নের মুখে পড়ে যায়।’
সূত্র জানায়, তথ্যসূত্র ও উৎস, মেথডোলজি এবং সময়কাল এ তিনটি বিষয়কে প্রাধান্য দিয়ে স্ট্যাটিসটিক্যাল ক্যাপাসিটি স্কোর তৈরি করে বিশ্বব্যাংক। সংস্থাটির বিবেচনায় মূলত তথ্যের উৎসের দুর্বলতা, মেথডোলজিক্যাল বা মান নির্ধারণে দুর্বলতা, নির্ভুলতা ও নির্দিষ্ট সময়ে প্রকাশ করতে না পারার কারণেই ধারাবাহিকভাবে বাংলাদেশের তথ্যের মান দুর্বল হচ্ছে।’
বিবিএসের সাবেক এক উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করেই সারাবাংলাকে বলেন, ‘আগের তুলনায় সুযোগ-সুবিধা অনেক বেড়েছে। বলতে গেলে সক্ষমতা বেড়েছে। কিন্তু কাজের গতি বাড়েনি। ২০১৩ সালে করা হয়েছে পরিসংখ্যান আইন। ফলে এক ভিন্ন মর্যাদা পেয়েছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো। এছাড়া ব্যুরোর ননক্যাডার পদে এতদিন নিয়োগ বিধি ছিল না। সেটি করা হয়েছে। জেলা পর্যায়ের কর্মকর্তাতের গাড়ি দেওয়া হয়েছে। জনবল সংকট কাটাতে নতুন নতুন কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। পরিসংখ্যান ইনস্টিটিউট করা হচ্ছে। যা ইতোমধ্যেই অনুমোদন দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু মূল কাজের গতি রয়েছে আগের জায়গায়।’