দিয়াজ হত্যার ৪ বছর: মৃত্যুর আগে বিচার দেখে যেতে চান মা
২০ নভেম্বর ২০২০ ১০:১০
চট্টগ্রাম ব্যুরো: চার বছর পেরিয়ে গেলেও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ নেতা দিয়াজ ইরফান চৌধুরী হত্যা মামলার তদন্তে কোনো অগ্রগতি নেই। গ্রেফতারি পরোয়ানা থাকলেও এ মামলার কয়েকজন আসামিকে প্রকাশ্যে মিছিল-সমাবেশে এবং আওয়ামী লীগ-যুবলীগের নেতাদের পাশে দেখা যাচ্ছে। কিন্তু পুলিশ গ্রেফতার করছে না বলে অভিযোগ দিয়াজের পরিবারের। তার মা জাহেদা আমিন চৌধুরী মৃত্যুর আগে ছেলে হত্যার বিচার দেখে যাওয়ার আকুতি জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর কাছে।
২০১৬ সালের ২০ নভেম্বর রাতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ ক্যাম্পাসে নিজ বাসা থেকে দিয়াজ ইরফান চৌধুরীর ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করে হাটহাজারী থানা পুলিশ। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র দিয়াজ কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সহসম্পাদক ছিলেন। একইসঙ্গে ছিলেন চবি ছাত্রলীগের যুগ্ম সম্পাদক। তিনি চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাবেক মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনের অনুসারী হিসেবে পরিচিত ছিলেন।
শুরু থেকেই দিয়াজের পরিবার ও চবি ছাত্রলীগের একাংশ দাবি করে আসছিলেন, তাকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। লাশ উদ্ধারের পরদিন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগে প্রথম ময়নাতদন্ত হয়। প্রতিবেদনে তাকে হত্যার আলামত মেলেনি বলে উল্লেখ করা হয়। ওই প্রতিবেদন প্রত্যাখান করে দিয়াজের পরিবার।
দিয়াজের মা জাহেদা আমিন চৌধুরী ২০১৬ সালের ২৪ নভেম্বর ১০ জনকে আসামি করে আদালতে মামলা দায়ের করেন। আসামিরা হলেন— বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন সহকারী প্রক্টর আনোয়ার হোসেন, চবি ছাত্রলীগের সে সময়ের সভাপতি আলমগীর টিপু, ছাত্রলীগ নেতা আবুল মনসুর জামশেদ, তাদের অনুসারী রাশেদুল আলম জিশান, আবু তোরাব পরশ, মনসুর আলম, আবদুল মালেক, মিজানুর রহমান, আরিফুল হক অপু ও মোহাম্মদ আরমান। অভিযুক্ত ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরাও আ জ ম নাছির উদ্দীনের অনুসারী হিসেবে পরিচিত।
জাহেদা আমিনের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আদালত দিয়াজের লাশ কবর থেকে তুলে পুনরায় ময়নাতদন্তের আদেশ দেন। ২০১৬ সালের ১০ ডিসেম্বর লাশ তুলে দ্বিতীয় দফা ময়নাতদন্ত করেন ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগ। ২০১৭ সালের ৩০ জুলাই দ্বিতীয় দফা ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, দিয়াজের শরীরে আঘাতজনিত জখমের মাধ্যমে হত্যার আলামত আছে।
আদালতের নির্দেশে হাটহাজারী থানায় হত্যা মামলা রেকর্ড হয়। ওই সময়কার ওসি বেলাল উদ্দিন মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর নিজেই তদন্ত শুরু করেন। পরে মামলার তদন্তভার যায় সিআইডির কাছে। সিআইডির প্রথম তদন্তকারী কর্মকর্তা সহকারী পুলিশ সুপার অহিদুর রহমান তদন্ত শুরুর পর বদলি হন। এরপর থেকে আরও দু’জন তদন্তকারী কর্মকর্তা পরিবর্তন হয়েছে।
দিয়াজের বড় বোন অ্যাডভোকেট জুবাইদা সরওয়ার চৌধুরী নীপা সারাবাংলাকে বলেন, ‘সিআইডিতে বারবার তদন্তকারী কর্মকর্তা পরিবর্তন ছাড়া মামলার আর কোনো অগ্রগতি হয়নি। উনারা তদন্তও করছেন না। আসামিদের মধ্যে চার জন— আনোয়ার, টিপু, জামশেদ ও জিসান হাইকোর্ট থেকে জামিন নিয়েছিলেন। পরে আনোয়ার নিম্ন আদালতে আত্মসমর্পণ করলে তাকে কারাগারে পাঠানো হয়। বাকি তিন জন নিম্ন আদালতে আত্মসমর্পণ না করায় তাদের বিরুদ্ধে আদালত গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে। বাকি আসামিদের বিরুদ্ধে আগেই গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়। অথচ পুলিশ তাদের গ্রেফতার করছে না। বরং তাদের যুবলীগের বড় বড় নেতাদের পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তুলে ফেসবুকে দিতে দেখা যাচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘যুবলীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর মিছিল-সমাবেশে তাদের সবাইকে দেখা যাচ্ছে। আমাদের সাবেক মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন সাহেবের সঙ্গে তো তাদের সবসময় দেখা যায়। অথচ পুলিশ বলছে, আত্মগোপনে থাকায় তাদের নাকি গ্রেফতার করা যাচ্ছে না!’
পরোয়ানাভুক্ত আসামিদের গ্রেফতার না করার বিষয়ে জানতে চাইলে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা সিআইডির চট্টগ্রাম জোনের সহকারী পুলিশ সুপার আবদুস সালাম সারাবাংলাকে বলেন, ‘গ্রেফতারি পরোয়ানা সাধারণত থানায় যায়। থানাকেই মূলত তাদের গ্রেফতারের উদ্যোগ নিতে হয়। তদন্তকারী সংস্থা হিসেবে আমরাও গ্রেফতার করতে পারি। কিন্তু আমরা তো তাদের কোথাও খুঁজে পাচ্ছি না। বাদী যদি তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেন আমরা অবশ্যই গ্রেফতার করব।’
মামলার আসামি চবি’র সাবেক সহকারী প্রক্টর আনোয়ার হোসেন ২০১৭ সালের ১৮ ডিসেম্বর চট্টগ্রামের একটি আদালতে আত্মসমর্পণ করেন। আদালত তাকে কারাগারে পাঠান। পরে জামিনে বেরিয়ে তিনি আবার চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা পেশায় ফিরেছেন। সম্প্রতি তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগেও একটি মামলা হয়েছে।
মামলার তদন্ত শুরুর পর থেকে সিআইডি শুধু ২০১৯ সালের ২০ মার্চ মোহাম্মদ আরমান নামে এক আসামিকে গ্রেফতার করেছিল। পরে আরমানও জামিনে বেরিয়ে আসেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের ছাত্র আরমান মামলার আরেক আসামি আলমগীর টিপুর ছোট ভাই।
২০১৯ সালের ৩১ অক্টোবর গ্রেফতার হওয়া আলোচিত সাবেক যুবলীগ নেতা ও ঠিকাদার জি কে শামীমকে দিয়াজ হত্যা মামলায় আসামি করার জন্য আদালতে আবেদন করেন বাদি জাহেদা আমিন চৌধুরী। আদালত সেটা নথিভুক্ত করে তদন্তকারী কর্মকর্তা বরাবর পাঠান বলে জানান বাদির আইনজীবী জুবাইদা সরওয়ার চৌধুরী নীপা।
জি কে শামীমকে ২০১৯ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর গ্রেফতার করে র্যাব। গ্রেফতারের পর বিভিন্ন গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ হয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন কলাভবন নির্মাণের ৭৫ কোটি টাকার কাজ জি কে শামীমের প্রতিষ্ঠান সার্স দ্য বিল্ডার্স ইঞ্জিনিয়ার্স-জি কে বিল্ডার্স লিমিটেডকে (জেভি) পাইয়ে দিতে ‘বাধা অপসারণের অংশ হিসেবে’ দিয়াজকে খুন করা হয়। গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যকে ভিত্তি হিসেবে উল্লেখ করে মামলায় তাকে আসামি করার আবেদন করেন দিয়াজের মা।
এ অবস্থায় জীবদ্দশায় ছেলে হত্যার বিচার দেখে যেতে পারবেন কি না, তা নিয়ে চরম হতাশা প্রকাশ করে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ চেয়েছেন জাহেদা আমিন চৌধুরী। কান্নায় ভেঙে পড়ে তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘সিআইডিকে বারবার বলেছি, ভালোভাবে তদন্ত করেন, আসামিদের গ্রেফতার করেন। কিন্তু তারা চুপ। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাক্ষাৎ চেয়েছি। কিন্তু চার বছরেও আমার সেই সুযোগ হয়নি। আমি সন্তানহারা মা। কত খুন হওয়া সন্তানের পরিবার প্রধানমন্ত্রীর কাছে গিয়ে সান্ত্বনা পাচ্ছে। আমার পুরো পরিবার আওয়ামী লীগ করে, আমার কী অপরাধ, আমি জানি না। কেন প্রধানমন্ত্রী ছাত্রলীগের নেতা দিয়াজের হত্যার ঘটনায় হস্তক্ষেপ করছেন না, আমি জানি না। দেখা হলে প্রধানমন্ত্রীকে বলতাম, আমি মরে যাব, মরার আগে আমি ছেলে হত্যার বিচারটা দেখে যেতে চাই।’
‘বিচারের দাবি নিয়ে আমি চার বছর ধরে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছি। কতবার শহিদ মিনারে দাঁড়িয়েছি! আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সাহেব আমাকে বলেছেন, বিচার হবে, তবে সময় লাগবে। কত সময় লাগবে আমি জানি না। আমার শক্তি শেষ হয়ে আসছে। কিছু বলার শক্তি এখন আমার নেই। হয়তো খুব তাড়াতাড়ি আমিও আমার ছেলের কাছে চলে যাব। শুধু মরার আগে ছেলে হত্যার বিচারটা দেখে যেতে পারলে ভালো লাগত। আল্লাহর ওপর ভরসা করে আছি, যদি আল্লাহ শক্তি দেন, মানুষের আদালতে বিচার না পেলেও জীবদ্দশায় আমি খুনীদের মুখোশ খুলে দিয়ে যাব,’— বলেন জাহেদা আমিন চৌধুরী।
৪ বছর গ্রেফতারি পরোয়ানা দিয়াজ ইরফান চৌধুরী দিয়াজ হত্যা দিয়াজ হত্যা মামলা বিচার মামলার তদন্ত