আইনি জটিলতা ও প্রায়োগিক ব্যর্থতায় কমছে না ধর্ষণ
২০ নভেম্বর ২০২০ ১৪:৩৮
ঢাকা: ধর্ষণ অনেক প্রাচীন একটি অপরাধ। এই অপরাধ দমনে কঠোর আইন রয়েছে। কিন্তু সেই আইন প্রয়োগে যেমন জটিলতা রয়েছে, তেমনি রয়েছে প্রায়োগিক ব্যর্থতাও। এর সঙ্গে কর্তৃপক্ষের গাফিলতি ও মামলা নিষ্পত্তিতে দীর্ঘ সময় লেগে যাওয়ার কারণে ধর্ষণের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। এ কারণে ধর্ষণ প্রতিরোধে স্পষ্ট ও কঠোরতম আইন প্রয়োজন।
সারাবাংলা ডটনেটের নিয়মিত আয়োজন ‘সারাবাংলা ফোকাস’ অনুষ্ঠানে যুক্ত হয়ে বক্তারা এসব কথা বলেন। বুধবার (১৮ নভেম্বর) অনুষ্ঠিত ‘সারাবাংলা ফোকাসে’ আলোচনার বিষয় ছিল ‘কেন কমছে না ধর্ষণ?— আইন সংস্কার পরবর্তী অবস্থা ও একটি পর্যালোচনা’। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন সারাবাংলা ডটনেটের সিনিয়র নিউজরুম এডিটর রাজনীন ফারজান। ভার্চুয়াল এই আলোচনায় অতিথি ছিলেন আইআরসি’র সাইকোলজিক্যাল কনসালট্যান্ট রেজিনা পারভীন ও বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার ইফফাত গিয়াস আরেফিন।
আলোচনায় বক্তরা বলেন, ২০০০ সালের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে ধর্ষণের সর্বোচ্চ সাজা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড করা হয়। কিন্তু গত ২০ বছরেও ধর্ষণের সংখ্যা কমেনি। এর মধ্যে গত অক্টোর মাসে ধর্ষণের সর্বোচ্চ সাজা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড থেকে বাড়িয়ে মৃত্যুদণ্ড করা হয়েছে। তারপরও ধর্ষণ কমেনি।
আলোচনায় সাম্প্রতিক তথ্য-পরিসংখ্যান তুলে ধরে জানানো হয়, গত অক্টোবর মাসে দেশে ২১৬টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। শিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে ৪৩৬টি। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাব অনুযায়ী, ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ধর্ষণের শিকার হয়েছেন এক হাজার ৩৪৯ জন নারী ও শিশু। এর মধ্যে ধর্ষণ পরবর্তী হত্যার শিকার হন ৪৬ জন, ধর্ষণের শিকার হয়ে আত্মহত্যা করেছেন ১৪ জন। এর বাইরেও ধর্ষণচেষ্টার ঘটনা ঘটেছে ২৭১টি। ধর্ষণের সাজা বাড়িয়ে নতুন অধ্যাদেশ জারির পরও কমেনি ধর্ষণের সংখ্যা।
ধর্ষণ সংক্রান্ত আইনের বিভিন্ন দিক তুলে ধরে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার ইফফাত গিয়াস আরেফিন বলেন, ধর্ষণ অনেক প্রাচীন একটি অপরাধ। এটি নতুন করে জন্ম নিয়েছে, তা কিন্তু নয়। ধর্ষণের শাস্তি কঠোরভাবে দেওয়ার জন্য ২০০০ সালের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন পাস করা হয় এবং সুবিচারের জন্য তৈরি করা হয় বিশেষ ট্রাইব্যুনাল। কিন্তু গত ২০ বছরের নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা কমেনি, বরং ভয়াবহতা বহুগুণ বেড়ে গেছে এবং দিন দিন তা প্রকট হচ্ছে। এ সংক্রান্ত আইন প্রয়োগে পদ্ধতিগত জটিলতা রয়েছে। রয়েছে কর্তৃপক্ষের গাফেলতি ও মামলার দীর্ঘ জট। এমনকি আইনটির মধ্যেও রয়েছে কিছু অস্পষ্টতা।
তিনি বলেন, আমাদের দেশে ধর্ষণ অপরাধটি আগে থেকেই ছিল। তবে সম্প্রতি নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের একজন গৃহবধূকে বিবস্ত্র করে নির্যাতন এবং সিলেটের একটি কলেজে স্বামীকে বেঁধে রেখে তার স্ত্রীকে দলবেঁধে ধর্ষণের ঘটনাটি সাড়া ফেলেছে। বলা যায়, এই দুইটি ঘটনার পর মানুষের মধ্যে একধরনের ইমোশনাল ব্রেকডাউন হয়েছে। তার পরিপ্রেক্ষিতে ধর্ষণের সাজা আরও বাড়িয়ে মৃত্যুদণ্ড করেছে সরকার।
সুপ্রিম কোর্টের এই আইনজীবী সংশোধিত আইনের বিভিন্ন দিক তুলে ধরে বলেন, আগের আইনের ৩২ ধারায় একটি সংশোধনী এসেছে। আগে শুধু ধর্ষণের শিকার ব্যক্তির মেডিকেল করানোর কথা বলা ছিল। এখন বলা হয়েছে, অপরাধীরও ডিএনএ টেস্ট করাতে হবে। এ ক্ষেত্রে পর্যাপ্তসংখ্যক ডিএনএ ল্যাব প্রয়োজন। আবার নতুন বিলে বলা হয়েছে, ‘ধর্ষিতা’ শব্দটি ব্যবহার করা যাবে না, ‘ধর্ষণের শিকার’ বলতে হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও নির্যাতিত শব্দটি ব্যবহার করেছেন। এটি একটি ইতিবাচক দিক।
ধর্ষণের সামাজিক প্রেক্ষাপট ও বিচারিক প্রক্রিয়ায় দীর্ঘসূত্রিতার কথা তুলে ধরে ব্যারিস্টার ইফফাত বলেন, ধর্ষণের ঘটনায় ৯০ শতাংশ ক্ষেত্রেই থানায় অভিযোগ দেওয়া হয় না। কারণ এখানে ধর্ষণের শিকার ব্যক্তির মধ্যে ভয়-লজ্জা কাজ করে। আবার যিনি ধর্ষণের শিকার হচ্ছেন, তাকে চরিত্রের পরীক্ষা দিতে হচ্ছে। তাকে যখন আদালতে নেওয়া হচ্ছে, ডিফেন্সের (আসামিপক্ষ) আইনজীবীর কাছে চরিত্র নিয়ে প্রশ্নের মুখে পড়তে হচ্ছে। এগুলো ধর্ষণের ঘটনায় অভিযোগ বা মামলা দায়েরের ক্ষেত্রে অন্তরায়। আবার যে বাকি যে ১০ ভাগ ঘটনায় অভিযোগ বা মামলা হচ্ছে, তার মধ্যে দুই থেকে আড়াই শতাংশের শাস্তি হচ্ছে। ধর্ষণের বিচারে এই দীর্ঘসূত্রিতাও এই অপরাধ না কমার পেছনে একটি বড় কারণ। অনেক ক্ষেত্রে বছরের পর বছর ঝুলে থাকছে মামলা। সে ক্ষেত্রে আসামির সাজা কম হচ্ছে।
আইআরসি’র সাইকোলজিক্যাল কনসালট্যান্ট রেজিনা পারভীন বলেন, যখন কোনো নারী ধর্ষণের শিকার হন, থানায় যেতে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভোগেন। নারীকে চরিত্র নিয়ে কথা বলা হয়। নারীরা মুখ খুলতে পারছেন না। সমাজে এমন একটি অবস্থা তৈরি করে রাখা হয়েছে, যেখানে নারীদের চুপ করিয়ে রাখা হয়। ছোটবেলা থেকেই তাদের পুরুষদের চেয়ে ছোট করে রাখা হয়। মিনা কার্টুনেও কিন্তু এই বিষয়টিই দেখানো হয়েছে যে মেয়েরা ছেলেদের চেয়ে কম মর্যাদাসম্পন্ন। ফলে সমাজ নারীদের শিখিয়েছে চুপ থাকতে।
তিনি বলেন, এসব কারণে যখন কোনো নারী ধর্ষণের শিকার হন, তখন তিনি আর কিছু বলতে পারেন না। আমাদের সামাজে কেউ ধর্ষণের শিকার হলে তার আশপাশের মানুষেরাও খুব ভয় পেয়ে যায়। তখন সমাজ ও অন্যদের কথার ভয়ে মুখ চেপে ধরা হয়। কেউ এই ঘটনা প্রকাশ করতে চাইলে এমনকি অনেক ক্ষেত্রেই পরিবারের কাছে লাঞ্ছিত হতে হয়।
নির্যাতনের শিকার নারীদের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করে থাকেন রেজিনা পারভীন। সেই অভিজ্ঞতা তুলে ধরে তিনি বলেন, আমাদের কাছে যখন নির্যাতনের শিকার কোনো নারী আসেন, তখন তাকে আমরা এসব কথা বলি না। তাকে একটি সুন্দর পরিবেশ দিয়ে মানসিক যন্ত্রণা লাঘব করার চেষ্টা করে থাকি। কিন্তু যে সমাজ ধর্ষণের শিকার একজন নারীকে খারাপ চোখে দেখছে, সেই সমাজ কেন অপরাধী পুরুষটাকে খারাপ চোখে দেখে না? এটি কিন্তু বড় একটি প্রশ্ন।
ধর্ষণের ঘটনার বিচারের ক্ষেত্রে ধর্ষণ পরবর্তী সময়ে আলামত সংরক্ষণের দিকে জোর দেন রেজিনা পারভীন। তিনি বলেন, ধর্ষণের আলামত আলাদা আলাদা করে রাখতে হবে। প্রয়োজনে পোশাকগুলোকেই আলাদা করে রাখতে হবে। এসব আলামত যথাযথভাবে সংরক্ষণের অভাবে কিন্তু অনেক মামলায় অপরাধীকে সঠিকভাবে সাজার আওতায় আনা যায় না।
ধর্ষণ সংক্রান্ত আইনে কিছু স্পষ্টতা আনা প্রয়োজন উল্লেখ করে ব্যারিস্টার ইফফাত গিয়াস আরেফিন বলেন, আমাদের এখনকার আইনে ধর্ষণের সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ডের বিধান রয়েছে। কিন্তু অপরাধীকে সেই শাস্তি পর্যন্ত নিয়ে যাওয়ার জন্য অনেকগুলো ধাপ পার করতে হয়। এর কোনো একটি ধাপেও যদি সমস্যা হয়, তাহলে কিন্তু অপরাধীকে সর্বোচ্চ সাজার সেই পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারব না।
তিনি বলেন, ১৮৬০ সালের পেনাল কোডের ৩৭৫ ধারা অনুযায়ী ধর্ষণকে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। সেই সংজ্ঞা ২০০০ সালের আইনে ব্যবহার করা হয়েছে। এই সংজ্ঞা সনাতন। বিশ্বের সমসাময়িক ধর্ষণ আইনেরগুলোতে অনেক যৌন নির্যাতনকেও ধর্ষণ হিসেবে ধরা হচ্ছে। আমাদের আইনের সেগুলোর উল্লেখ নেই। দণ্ডবিধি আইনে সেগুলো উল্লেখ নেই। দণ্ডবিধি আইনে বলা হয়েছে, যৌনসঙ্গম বিবেচনার করার জন্য প্রবিষ্ট ও পেনিট্রেশন যথেষ্ট। কিন্তু পেনিট্রেশন বলতে কী বোঝায়, সেটা কিন্তু পেনাল কোডের একবারও ব্যাখ্যা করা হয়নি। নারী ও পুরুষের মধ্যে যে পেনিট্রেশনে যৌন মিলন হয়, আদালত সেটাকে প্রচলিত আইনে ব্যবহার করেন। ফলে পুরুষাঙ্গ ছাড়া অন্য কোনো বস্তুর মাধ্যমে জোর করে প্রবেশ করা হলে কিন্তু সেটি ধর্ষণের সংজ্ঞায় পড়বে না।
তিনি আরও বলেন, আমাদের সমাজে অনেক বিকৃত মন-মানসিকতার মানুষ রয়েছেন যারা নানাভাবে যৌন ধর্ষণ করে। যদি শরীরের কোনো চিহ্ন না থাকে, তাহলে ডিফেন্সের আইনজীবী এটাকে ধর্ষণের জন্য সম্মতি ছিল বলে উপস্থাপন করেন। ধর্ষণের চিহ্ন নেই কেন— সেই প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন। এটি আইনের একটি দুর্বলতা, যার ফাঁকফোকড় দিয়ে আসামিরা বের হয়ে যাচ্ছে। আবার আমরা দেখি ছেলে শিশুদের ধর্ষণ করা হচ্ছে। সেখানে কিন্তু ধর্ষণের কথা বলা হচ্ছে না। এমনকি ধর্ষণের সংজ্ঞায় সেটির কোনো উল্লেখই নেই।
সুপ্রিম কোর্টের এই আইনজীবী বলেন, মেডিকেল রিপোর্ট ধর্ষণের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ধর্ষণের শিকার ব্যক্তির ২৪ ঘণ্টার মধ্যে মেডিকেল করাতে হবে। যত দ্রুতসম্ভব টেস্ট করানো না হলে এভিডেন্সের সমস্যা হতে পারে। আবার দেখা যায়, ধর্ষণের কোনো মামলায় সাক্ষী সময়মতো আনতে পারে না। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপক্ষ ও পুলিশকে সাক্ষীদের গুরুত্বর সঙ্গে নিরাপত্তা দিয়ে নিয়ে আসতে হবে। সাক্ষী যেন ভয় না পায়, সে ব্যবস্থা নিতে হবে।
‘ম্যারাইটাল রেপ’ বিষয়ে আইনের দুর্বলতার কথা তুলে ধরে রেজিনা পারভীন বলেন, অনেক সময় দেখা যায় আমাদের সমাজে স্বামীর কাছেই স্ত্রী যৌন নির্যাতন ও ধর্ষণের শিকার হচ্ছেন। অর্থাৎ স্বামীর জোর করে স্ত্রীর সম্মতি ছাড়াই দিনের পর দিন বিকৃতভাবে ধর্ষণ করছে। সে বিষয়ে আমাদের আইনে সুস্পষ্ট কোনো বিধানই নেই।
তিনি আরও বলেন, অনেক ক্ষেত্রে ধর্ষণের শিকার নারীকে কিছু প্রলোভন দেখিয়ে মা-বাবা তাদের ধর্ষকের সঙ্গেই বিয়ে দিয়েছেন। ফলে আসল অপরাধী অপরাধ করেও রেহাই পাচ্ছে। আগে মেয়েদের মুখের কথায় কাজ হতো না। তবে বর্তমান মেয়েদের মুখের কথাকে অনেকটা গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। তাই মেয়েদের মুখ খুলতে হবে। ধর্ষণের শিকার হলে সেটি আইনি প্রক্রিয়ার মধ্যে নিয়ে আসতে হবে। তাহলেই ধর্ষকের শাস্তি হবে।
অপরাধ মনস্কতা নিয়ে গবেষণা ও যৌন শিক্ষার কথাও তুলে ধরেন রেজিনা পারভীন। তিনি বলেন, অপরাধী মানসিকতা নিয়ে গবেষণা করা খুবই জরুরি। ছোটবেলা থেকে শিশু ও নারীদের যৌনতা বিষয়ে জ্ঞান অর্জনের ব্যবস্থা করতে হবে। প্রয়োজন পাঠ্যপুস্তকে যৌন শিক্ষা অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
ধর্ষণ ধর্ষণ প্রবণতা ধর্ষণ সংক্রান্ত আইন ধর্ষণের সাজা নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ব্যারিস্টার ইফফাত গিয়াস আরেফিন রেজিনা পারভীন সারাবাংলা ফোকাস