Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

পারিবারিক সহিংসতার পেছনে পরকীয়া, উত্তরণে প্রয়োজন আইন সংস্কার


২১ নভেম্বর ২০২০ ১৬:৫৪

ঢাকা: বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) সংক্রমণের মধ্যে ব্যাপক হারে বেড়েছে পারিবারিক সহিংসতা। অনেক ক্ষেত্রে এই সহিংসতার শিকার হয়ে প্রাণও দিতে হয়েছে স্বামী-স্ত্রী বা সন্তানকে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এর পেছনের অন্যতম কারণ পরকীয়া। একে ‘সামাজিক ব্যধি’ হিসেবে অভিহিত করছেন আইন বিশেষজ্ঞরা, যা সমাজের বিভিন্ন স্তরে ছড়িয়ে পড়েছে। তারা মনে করছেন, এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য এ সংক্রান্ত আইনের সংশোধন ও আধুনিকায়ন জরুরি।

বিজ্ঞাপন

অনলাইন নিউজ পোর্টাল সারাবাংলা ডটনেটের নিয়মিত আয়োজন ‘সারাবাংলা লিগ্যাল চেম্বার’ অনুষ্ঠানে যুক্ত হয়ে বক্তারা এসব কথা বলেন। আইন বিষয়ক এই লাইভ অনুষ্ঠানের গত ৫ নভেম্বরের এই পর্বে আলোচনার বিষয় ছিল ‘পরকীয়া এবং ঘরোয়া সহিংসতা’। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার ইফফাত গিয়াস আরেফীনের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে যুক্ত ছিলেন জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত আসনের সংসদ সদস্য জাকিয়া পারভীন খানম মনি এবং সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার সাবরিনা জেরিন। অনুষ্ঠানে সংসদ সদস্য জাকিয়া পারভীন বলেন, তিনি এই আইন সংস্কার সংক্রান্ত বিষয়টি জাতীয় সংসদে তুলে ধরতে চান।

বিজ্ঞাপন

আলোচনায় সঞ্চালক ও বক্তারা পরকীয়া সংক্রান্ত বিদ্যমান আইন ও এর ফাঁকফোকড় তুলে ধরে এই আইনের সংস্কার দাবি করেন। তারা বলেন, বিদ্যমান আইনে যৌন সঙ্গমহীন বিবাহবহির্ভূত পরকীয়া কোনো অপরাধ নয় এবং এই অভিযোগে কাউকে দায়ী করা যাবে না। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কের বলি হতে হচ্ছে অনেককেই।

জাকিয়া পারভীন খানম বলেন, পরকীয়া একটি সামাজিক ব্যধি, যা মানুষকে মানসিকভাবে পীড়া দেয়। এই ব্যধি যার জীবনে আসে, তার জীবনকে কুঁড়ে কুঁড়ে খায়। মানসিক যন্ত্রণা অনেকসময় ভাষায় প্রকাশ করতে পারেন না অনেকে। বিশেষ করে ভুক্তভোগী নারীরা মুখ খুলতে পারে না। পরকীয়া বেড়ে যাওয়ার নানা কারণ থাকলেও এই মুখ খুলতে না পারাও একটি ব্যধি, যা এই সমস্যা আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। এমন ঘটনা প্রচুর ঘটলেও সামনে আসে খুবই কম। একে মারাত্মক ব্যধির সঙ্গে তুলনা করে তিনি বলেন, রোগের ভ্যাকসিন থাকলেও এর কোনো ভ্যাকসিন নেই।

সঞ্চালক ব্যরিস্টার ইফফাত গিয়াস আরেফীন পরকীয়ার বেশ কিছু কারণ তুলে ধরেন। এগুলোর মধ্যে আছে আত্মকেন্দ্রিকতা, মূল্যবোধের অবক্ষয়, অনৈতিক সম্পর্কের প্রতি আগ্রহ, সহনশীলতার অভাব, পরিবারের সদস্যদের মধ্যে বিভিন্ন বিষয়ে অসুস্থ প্রতিযোগিতার প্রবণতা ইত্যাদি।

এমপি জাকিয়া পারভীন এগুলোর সঙ্গে আরও কিছু কারণ তুলে ধরেন। তার মতে, রুচির বিকৃতি, সাংসারিক অশান্তি, বিয়ের পর সঙ্গীকে ভালো না লাগা, সামাজিক কারণে অসুখী বিয়ে থেকে বের হওয়ার মতো মনের জোর না থাকা, পারিবারিক অশান্তি থাকলে মানসিক শান্তির জন্য অন্য কাউকে বেছে নেওয়া, বিয়ের পরে প্রাপ্ত স্বাধীনতার অপব্যবহারের প্রবণতা, ফাঁদে পা দিয়ে পরকীয়া করতে বাধ্য হওয়া, সব ভালো থাকার পরও অনেকসময় যৌন বিকৃতির কারণেও পরকীয়া বাড়ছে।

পরকীয়াকে ‘অনৈতিক’ বললেও আইনের ভাষায় এটি অপরাধ কি না— সে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেন ব্যারিস্টার সাবরিনা জেরিন।  তিনি বলেন, পেনাল কোডের ৪৯৭ ধারায় ব্যভিচারের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে— একজন বিবাহিত পুরুষ যখন অন্যের বিবাহিত স্ত্রীর সঙ্গে যৌন সম্পর্কে জড়ান, সেটিই ব্যাভিচার। এক্ষেত্রে নারী যদি অবিবাহিত বা বিধবা হন, তাহলে সেটি আইনের ধারায় পরকীয়া হিসেবে স্বীকৃত না। অন্যদিকে কোনো স্ত্রী যদি অন্যের স্বামীর সঙ্গে পরকীয়া করেন, তাহলেও সেই স্ত্রীর বিরুদ্ধে কোনো আইনি ব্যবস্থা নেওয়া যাবে না। কিন্তু যার সঙ্গে তিনি সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ছেন, সেই ব্যক্তির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যাবে। আবার পরকীয়া করছেন যে ব্যক্তি, তার স্ত্রীও কোনো আইনের সাহায্য নিতে পারবেন না। এর ফলে ভুক্তভোগী মাত্রেই আইনের সাহায্য পান না। বিদ্যমান এই আইনকে অসম্পূর্ণ আখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, একে পরিপূর্ণ না করলে ভুক্তভোগী নারী বা পুরুষ আইনের সাহায্য থেকে বঞ্চিত হতেই থাকবেন।

আয়োজনে সাদিয়া খান (ছদ্মনাম) নামে একজন ভুক্তভোগীও অংশ নেন। তিনি জানান, তার স্বামী একজন সামরিক কর্মকর্তা। অবিবাহিত এক তরুণী সামরিক কর্মকর্তার সঙ্গে তার বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক রয়েছে। এক সন্তানের মা সাদিয়া খান স্বামীর এই পরকীয়ার জের ধরে শারীরিক ও মানসিক নিগ্রহের শিকার হচ্ছেন। কোনো আইনের সাহায্য নিয়ে তার স্বামীকে ডিভোর্স দিতে পারবেন কি না, অনুষ্ঠানে যুক্ত হয়ে সেটি জানতে চান তিনি।

তার প্রশ্নের জবাবে ব্যরিস্টার সাবরিনা বলেন, বিদ্যমান আইনে সাদিয়া তার স্বামীর বিরুদ্ধে মামলা করতে পারবেন না। তিনি নিকটবর্তী থানায় নির্যাতনের কারণে সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করতে পারবেন, আইনজীবীর মাধ্যমে আইনি নোটিশ পাঠাতে পারেন। এই কারণ দেখিয়ে ডিভোর্স দিতে পারবেন, তাতেও কোনো সমস্যা হবে না।

এই আইনজীবী বলেন, এখানে লক্ষ করার মতো বিষয় হলো, সাদিয়া পরকীয়ার কারণে নির্যাতনের শিকার হলেও পরকীয়াজনিত কারণে আইনি কোনো প্রক্রিয়া গ্রহণ করতে পারবেন না। আইনের আশ্রয় নিতে হলে তাকে পারিবারিক সহিংসতার বিষয়টি সামনে আনতে হবে।

আরেকজন ভুক্তভোগী নাদিয়া করিম (ছদ্মনাম) জানান, নিজের পছন্দে বিয়ে করেন তিনি। বিয়ের পর তার স্বামীর কর্মস্থলে উন্নতি হতে থাকে। সেইসঙ্গে তার চারিত্রিক অবনতিও মাত্রা ছড়াতে থাকে। এই বিষয়ে স্বামীকে কোনো প্রশ্ন করলেই শারীরিক নির্যাতনের শিকার হন নাদিয়া। তিনি স্বামীর মোবাইলে নানারকম আপত্তিকর ও অন্তরঙ্গ মেসেজ দেখেছেন। সেগুলোকে প্রমাণ হিসেবে ব্যবহার করে পরকীয়ার মামলা করতে পারবেন কি না, জানতে চান তিনি।

ব্যারিস্টার সাবরিনা বলেন, স্বামীর বিরুদ্ধে পরকীয়ার মামলা করতে পারবেন না নাদিয়া। স্বামীর বিরুদ্ধে নির্যাতন বা সহিংসতার অভিযোগে মামলা করতে পারবেন। পরকীয়ার অভিযোগে আইনের সাহায্য নিয়ে তার স্বামী বা অন্য নারীটিকে শাস্তি দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই, যদিও তাদের এই অনৈতিক সম্পর্কের ফলেই আজ নাদিয়া মার খাচ্ছেন।

সঞ্চালক ব্যারিস্টার ইফফাত গিয়াস বলেন, আইনের ধারা অনুযায়ী অন্য নারীটিকেও বিবাহিত হতে হবে এবং পরকীয়ায় লিপ্ততা প্রমাণের জন্য যৌন সম্পর্ক থাকার প্রমাণ থাকতে হবে। এসব প্রমাণ কিভাবে সংগ্রহ করবেন নাদিয়ার মতো ভুক্তভোগীরা— প্রশ্ন রাখেন তিনি।

ব্যরিস্টার সাবরিনা বলেন, নাদিয়ার মতো যেসব নারী শারীরিক নিগ্রহের শিকার হচ্ছেন, তারা যেন অবশ্যই কোনো সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে ডাক্তারি পরীক্ষা করান। সেখানে ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারের রেকর্ড কাজে লাগবে। এছাড়া ভিডিও, ছবি বা মেসেজও মামলায় সাহায্য করবে।

পকরীয়ায় নারী ও পুরুষ— উভয়ই শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। কিন্তু বিদ্যমান আইনের সাহায্য পাওয়ার সুযোগ কারোরই নেই। এ বিষয়টি উল্লেখ করে বিদ্যামান আইনের ফাঁকফোকড়গুলো দূর করে একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ আইন তৈরি করতে হবে বলে মত দেন সংসদ সদস্য জাকিয়া পারভীন। তিনি এই আইনকে ‘ছেঁড়াখোঁড়া’ আখ্যা দিয়ে বলেন, একে যত দ্রুতসম্ভব ঠিক করতে হবে ও সংবিধানের সম্মান সমুন্নত রাখতে হবে। সামাজিক এই ব্যধি দূর করতে আইন সংশোধনের জন্য এ বিষয়ে সংসদে আলোচনা করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন তিনি।

জাকিয়া পারভিন খানম মনি পরকীয়া পরকীয়া সংক্রান্ত আইন পারিবারিক সহিংসতা বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক ব্যারিস্টার ইফফাত গিয়াস আরেফিন ব্যারিস্টার সাবরিনা জেরিন সামাজিক ব্যধি

বিজ্ঞাপন

খুলনায় যুবকের পেটে মিলল ইয়াবা
২২ নভেম্বর ২০২৪ ১২:০২

আরো

সম্পর্কিত খবর