Wednesday 09 Jul 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

মহাকালের মহাকাশে সবুজ বিবেকের যন্ত্রজয়ী মানুষটি


১৪ মার্চ ২০১৮ ২১:১১ | আপডেট: ১৫ মার্চ ২০১৮ ১৩:২৯
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

সন্দীপন বসু, অ্যাসিট্যান্ট এডিটর।।

‘জীবন দুদিনের বই তো নয়, কখন যে কার সন্ধ্যা হয়’ কথাটি বোধহয় ভালোভাবেই উপলব্ধি করছেন বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিংয়ের সহযোগী ডেনিস স্টানটন অ্যাভরি। মাত্র ২২ দিন আগেই তিনি হকিংয়ের একটি কথা জানিয়েছিলেন বিশ্বকে। ‘ভবিষ্যতের পৃথিবীর শান্তির দূত’ হকিং বলেছিলেন, ‘মরতে ভয় নেই আমার। কিন্তু অনেক কিছুই করার বাকি এখনও।’

কিন্তু জন্ম মৃত্যুর নিয়ন্তকের ইচ্ছে বোধহয় তা ছিল না। অথবা হকিংই বোধহয় অনুভব করেছিলেন, আরও ‘অনেক কিছুই’ করা হবে না। তাই হয়তো স্বগতোক্তি বেরিয়ে এসেছিল অন্তঃস্থল থেকে।

তবে হকিংয়ের এই মৃত্যুর সঙ্গে পথচলা কিন্তু আজকের নয়। ৫৫ বছর আগে হকিংয়ের বয়স যখন মাত্র ২২ বছর তখনই চিকিৎসকরা তাকে জবাব দিয়ে দিয়েছিলেন। ১৯৬৩ সালে মারাত্মক স্নায়ুর অসুখ এএলএস (অ্যামিয়োট্রপিক ল্যাটেরাল স্কেলেরোসিস) বা মোটর নিউরন নামে দূরারোগ্য রোগে আক্রান্ত হকিং জেনেছিলেন আর বড়জোর বছর দুয়েক তার আয়ুষ্কাল।

বিজ্ঞাপন

Portrait of a young Stephen Hawking.

লড়াইটার শুরুই এরপর থেকে। অসুখ ক্রমে গ্রাস করেছিল তার কর্মক্ষমতা। কিন্তু রোগটি যতটা দ্রুততার সাথে ছড়ানোর আশঙ্কা করা হচ্ছিল তার চেয়ে কম গতিতে ছড়ায় তার শরীরে।

এরপরে হকিংয়ের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে ওঠে যন্ত্রচালিত একটি হুইলচেয়ার। ডান দিকে হেলানো ঘাড়। হুইলচেয়ারের হাতলের কন্ট্রোলের উপর রাখা হাত।  কম্পিউটার স্পিচ সিন্থেসাইজারের মাধ্যমে কথা বলতেন। বিশ্ব তাঁকে এই অবস্থাতেই দেখেছে কয়েক যুগ।

মৃত্যুকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে কীভাবে জীবনের মনিমুক্তা আহরণ করতে হয় তা হকিংয়ের চেয়ে হয়তো আর কেউ ভালোভাবে উপলব্দি করেননি। স্টিফেন হকিং দেখিয়ে দিয়েছিলেন, হুইল চেয়ারে বসেই শত প্রতিবন্ধকতার মধ্যেই কীভাবে বিশ্ব থেকে মহাবিশ্বে ঘুরে বেড়ানো যায়।

অবশেষে ৭৬ বছর বয়সে শেষ হল সেই মহাজীবনের। বুধবার (১৪ মার্চ, ২০১৮) ভোররাতে ইংল্যান্ডের কেমব্রিজে, নিজের বাড়িতেই শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করলেন স্টিফেন হকিং। এই কর্মবীর মহাপ্রাণ শেষপর্যন্ত লড়ে গিয়েছিলেন।

স্টিফেন উইলিয়াম হকিংয়ের জন্ম যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ডে ১৯৪২ সালের ৮ জানুয়ারি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছিল তখন। বাবা ফ্রাঙ্ক হকিং ছিলেন চিকিৎসক ও জীববিজ্ঞানের গবেষক, মা ইসাবেলা রাজনৈতিক কর্মী ও সমাজসেবী। হকিংয়ের বাবা-মা দুজনেই পড়তেন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে। বাবা ছিলেন মেডিসিনের ছাত্র। মা পড়তেন রাজনীতি, অর্থনীতি এবং দর্শন। হকিংরা ছিলেন চার ভাই-বোন।

হকিংয়ের বাবার ইচ্ছে ছিল ছেলে যেন তার মতো ডাক্তার হয়। কিন্তু হকিংয়ের ছিল অন্য ইচ্ছা, তিনি চেয়েছিলেন গণিত পড়তে। কিন্তু যেহেতু অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ইউনিভার্সিটি কলেজে গণিতের কোর্স পড়ানো হতো না, সেজন্য হকিং পদার্থবিজ্ঞান নিয়ে পড়া শুরু করেন। সে সময়ে তার আগ্রহের বিষয় ছিল তাপগতিবিদ্যা, আপেক্ষিকতা ও কোয়ান্টাম বলবিদ্যা।

মাত্র ৩২ বছরে বয়সে রয়্যাল সোসাইটির ফেলো হন হকিং। ১৯৭৯ সালে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের লুকেসিয়ান প্রফেসর হন। এই আসনে দীর্ঘ ৩০ বছর (১৯৭৯-২০০৯) ছিলেন তিনি। বিশ্বের সবচেয়ে সম্মানজনক এই অ্যাকাডেমিক পদে এক সময় (১৬৬৯-১৭০২) ছিলেন বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানী স্যার আইজ্যাক নিউটন।

হকিংয়ের কাজের বেশিরভাগ অংশ জুড়েই ছিল আপেক্ষিকতাবাদ, কোয়ান্টাম তত্ত্ব এবং মহাবিশ্ব জুড়ে ছড়িয়ে থাকা অজস্র ক্ষুদ্র কণা ও তাদের চরিত্র এবং অতি অবশ্যই ব্ল্যাক হোল। ১৯৭৪ সালে ব্ল্যাক হোলের উপর তার বিখ্যাত তত্ত্ব ‘হকিং রেডিয়েশন’ সামনে আনেন।

বিজ্ঞানকে জনপ্রিয় করার পিছনে তার অবদান ছিল অনেক। ১৯৮৮ সালে প্রকাশিত হয় ‘আ ব্রিফ হিস্ট্রি অব টাইম’। বইটির শুধুমাত্র ইংরেজি সংস্করণই  বিক্রি হয়েছিল এক কোটি কপি। বইটিতে মহাবিশ্বের জন্ম, তার বিকাশ এবং ব্ল্যাকহোলের পরিণতির মতো তত্ত্ব নিয়ে লিখেছিলেন তিনি। ২০০১ সালের মধ্যে ৩৫টি ভাষায় অনূদিত হয়েছিল ‘আ ব্রিফ হিস্ট্রি অব টাইম’। ২০০১ সালে প্রকাশিত হয় তার আরেক বিখ্যাত বই ‘দ্য ইউনিভার্স ইন আ নাটশেল’।

১৯৬৫ সালে জেন ওয়াইল্ডকে বিয়ে করেছিলেন হকিং। তাঁদের তিন সন্তান- লুসি, রবার্ট এবং টিম। ২৫ বছর পর তাঁদের বিচ্ছেদ হয়। পরে তিনি তার নার্স এলাইন ম্যাসনকে বিয়ে করেন। যদিও এ সম্পর্কও বেশি দিন টেকেনি। ২০১৪ সালে তাঁকে নিয়ে তৈরি হয় সিনেমা ‘দ্য থিওরি অব এভরিথিং’।

বিজ্ঞানী হকিং বরাবরই ছিলেন মানবতাবাদী। ভিয়েতনামে হামলার প্রতিবাদে রাস্তায় নামা হকিং, ইরাকে হামলার বিরুদ্ধে সোচ্চার হকিং। রাজনীতি নিয়েও সরব হতে দেখা গিয়েছে এই বিজ্ঞানীকে। মার্কিন নির্বাচনের আগে ডোনাল্ড ট্রাম্পের বুদ্ধিমত্তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন তিনি। সরব হয়েছিলেন ব্রেক্সিটের বিরুদ্ধেও।

হকিং চেয়েছিলেন বিশ্ব থাকুক সবুজের, বিজ্ঞান সচেতনতার। আর তাই বোধহয় পদার্থবিজ্ঞানী হয়েও সোচ্চার ছিলেন কৃত্তিম বৃদ্ধিমত্তার বিরুদ্ধে। মানবজাতিকে বারবার তাড়া দিয়েছেন এই বিজ্ঞানী। একটু জলদি করো ভাই… বলে গেছেন পৃথিবীর বাইরে বিকল্প বাসস্থান না গড়তে পারলে ধ্বংস হয়ে যাবে মানবজাতি। ধ্বংসের দূত হিসেবে চিহ্নিত করে গেছেন, যন্ত্রের কৃত্রিম বুদ্ধি তথা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সকে (এআই)।

জীবনের শেষদিকে এসে এই কৃত্তিম বৃদ্ধিমত্তার বিরোধিতা করেছেন বারবার। এ জন্য অনেকেই তার সমালোচনা করতেও ছাড়েননি। কিন্তু হকিং বোঝানোরও চেষ্টা করেছেন বারবার। শুনিয়েছেন আশঙ্কার কথা। সবশেষ গত বছরের নভেম্বরে কেমব্রিজের কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা গবেষণার পরীক্ষাগারের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে গিয়ে বলেছিলেন, ‘এ আবিস্কার, এ উদ্ভাবন মানুষকে কোথায় নিয়ে যাবে তা আমি কল্পনাও করতে পারি না। এটা আমাদের মস্তিস্কের কর্মক্ষমতা বাড়িয়ে দেবে বহুগুন।’ হকিং আরও মন্তব্য করেছিলেন, আমাদের সভ্যতার সবচেয়ে ভালো কিংবা সবচেয়ে খারাপ আবিষ্কার হতে যাচ্ছে এই কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা। এমন সময় বেশি দূরে নয় যখন মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করতে চাইবে কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা। এ হবে মানুষ কিংবা মানবসভ্যতারই আরেক রূপ।

মানবজাতির জন্য নতুন বিশ্ব খোঁজার তাগিদ বহুবার দিয়েছেন তিনি। পৃথিবীর দূষণ ও জনসংখ্যা বাড়া নিয়েও ছিলেন সচেতন। পৃথিবীকে মানুষের জন্য ‘বড় ছোট’ অ্যাখ্যা দিয়েছেন বারবার।

২০১৪ সালে নরওয়েতে স্টারমাস সায়েন্স ফেস্টিভ্যালে হকিং বলেছিলেন, আমি নিশ্চিত, হাতে আর খুব বেশি সময় নেই আমাদের। এই পৃথিবীটাকে আমাদের ছেড়েছুড়ে অন্য জায়গায় চলে যেতেই হবে। এখানে জায়গাটা খুব দ্রুত ছোট হয়ে আসছে আমাদের টিঁকে থাকার জন্য। বেঁচে থাকার জন্য যে সব প্রাকৃতিক সম্পদ দরকার, তা খুব তাড়াতাড়ি ফুরিয়ে আসছে।

কেন এই সতর্কতা তার ব্যাখ্যাও দিয়েছিলেন হকিং। বলেছিলেন, ইতিহাস এই ভাবেই বাঁক নেয়, পথ বদলায়। সভ্যতাকে বাঁচানোর জন্য নতুন নতুন ঠিকানা খুঁজে নেয়, অতীতে বহু বার নিয়েছে।

ভিনগ্রহে যে মানুষের অস্তিত্ব আছে তার কথা জানিয়েছিলেন বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং। এমনকি ভিনগ্রহীদের যে সভ্যতা তা আমাদের চেয়ে উন্নত তাদের দিক থেকে বিপদ আসতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন তিনি। তাই অযথা আগ বাড়িয়ে বিপদ ডেকে না আনারই কথা জানিয়েছিলেন এই পদার্থবিজ্ঞানী।

মানুষের চেয়ে উন্নত কোনো সভ্যতার সঙ্গে যোগাযোগকে তিনি কলম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কারের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। ইউরোপীয়দের সংস্পর্শ আমেরিকার আদিবাসীদের জন্য সুখকর ছিল না। একটি অনলাইন ফিল্ম ম্যাগাজিনকে দেওয়া সাক্ষাতকারে নিজের এই মতই একসময় তুলে ধরেছিলেন হকিং।

২০০৭ সালে হকিং প্রথম চলৎশক্তিহীন ব্যক্তি হিসেবে একটি বিশেষ বিমানে ওজনশূন্যতার অভিজ্ঞতা নেন। মানুষকে মহাকাশ ভ্রমণে উৎসাহ দেয়ার জন্যই তিনি এটি করেছেন বলে জানান।

হকিং বলেছিলেন, পারমাণবিক যুদ্ধ, জিন প্রকৌশলের মাধ্যমে তৈরি ভাইরাস অথবা অন্য কোনো কারণে পৃথিবীতে প্রাণের অবসান হতে পারে। মানুষ যদি মহাকাশে না যায় তাহলে মানবজাতির কোনো ভবিষ্যৎ নেই বলে মনে করতেন তিনি। তাই নিজে চলৎশক্তিহীন হয়েও মানুষকে মহাকাশ ভ্রমণে উৎসাহ দিয়ে গেছেন।

জীবদ্দশাতেই কিংবদন্তি হয়ে উঠেছিলেন স্টিফেন হকিং। ঘটনাচক্রে তার জন্ম আর মৃত্যুর সঙ্গে জুড়ে রইল বিজ্ঞানের আরও দুই কিংবদন্তি পদার্থবিদের নাম। তার জন্মদিন ৮ জানুয়ারি গ্যালিলিও গ্যালিলিওর মৃত্যুদিন। আর যে দিন মারা গেলেন হকিং, সেই ১৪ মার্চ অ্যালবার্ট আইনস্টাইনের জন্মদিন। তিনি মিশে গেলেন অনন্তের চিরন্তন অভিযাত্রায়, কৃষ্ণগহ্বরের রহস্যময়তায়, মহাবিশ্বের মহাকালের বিপুলতায়।

সারবাংলা/এসবি/এমআই/এমএ

 

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর