Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

নিশ্চিন্তপুরের ‘অভিশাপ’: তাজরীনের আগুনে আজও ‘পুড়ছেন’ জরিনা!


২৪ নভেম্বর ২০২০ ১০:১৭

ঢাকা: মোছা. জরিনা বেগম (২৮)। বাড়ি ময়মনসিংহ জেলার হালুয়াঘাট থানার দক্ষিণ নলপুরা গ্রামে। বাড়িতে আছেন বয়োবৃদ্ধ মা, ‍দুই ছেলে-মেয়ে। অভাবের সংসারে অসুস্থ ভাই-বোনের চিকিৎসা করাতে মাত্র ২০ হাজার টাকায় বাড়ি বন্ধক দিয়েছিলেন। সেই বাড়ি আর ফিরে পাননি। জরিনা নিজেই আট বছর ধরে পঙ্গু। তবু এটা-ওটা করে জীবন চালিয়ে নিচ্ছিলেন কোনো রকমে। করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) ধাক্কা কেড়ে নিয়েছে সেই সুযোগটুকুও। এখন ভাড়া বাড়িতে বাকি পড়েছে বাড়ি ভাড়া। প্রাণটাই যেন এক বোঝা। জরিনার কণ্ঠে যেন তাই পৃথিবীর সমান বেদনা— ‘যদি জানতাম এমন অভিশপ্ত জীবন নিয়ে বাঁচতে হবে, তাহলে আগেই মরে যেতাম!’

বিজ্ঞাপন

কে এই জরিনা, যার কাছে বেঁচে থাকাটাই নিদারুণ কষ্টের? কিসের অভিশাপের কথা বলছেন তিনি? কেনই বা পঙ্গুত্ব বরণ করতে হয়েছিল তাকে? এসব প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে ফিরে যেতে হবে সাভারের আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুরে। ঠিক ঠিক আট বছর আগের আজকের দিনটিতে, ২৪ নভেম্বর ২০১২। ঘটনাস্থল তাজরীন ফ্যাশন গার্মেন্টস। সময় সন্ধ্যা।

আগুনের লেলিহান শিখা সেদিন ঝাঁপিয়ে পড়েছিল ওই পোশাক কারখানায়। প্রায় হাজারখানেক কর্মী তখনো কারখানায় কাজ করছেন। আগুন ক্রমেই অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠতে থাকলেও কারখানার গেট খুলে দেওয়া হয়নি। আগুন আর ধোঁয়ার মিলিত আক্রমণে ভেতরে আটকে পড়া শ্রমিকদের মধ্যে শতাধিক আর ফিরতে পারেননি জীবন নিয়ে। গেট বন্ধ থাকায় আগুন থেকে বাঁচতে অনেকেই পাঁচ তলা ভবনটির বিভিন্ন তলা থেকে লাফিয়ে বের হওয়ার চেষ্টা করেন। সেই চেষ্টাতেও না ফেরার দেশে চলে যেতে হয় কাউকে কাউকে। বাকিদের অনেককেই পঙ্গুত্ব বরণ করতে হয় সেদিন। তাদেরই একজন জরিনা বেগম।

রাজধানীর প্রেস ক্লাবের সামনে অবস্থান করছিলেন জরিনা। কেবল তিনি নন, তার মতো আরও ৪৪ জন রয়েছেন সেখানে। তারা সবাই-ই তাজরীনের সেই আগুনের কারণে হারিয়েছেন স্বাভাবিক জীবন। তাদের কাছে নিশ্চিন্তপুরের তাজরীন মানেই এক ‘অভিশাপ’। সেই ‘অভিশাপ’ থেকে কিছুটা হলেও মুক্তি পেতে তারা প্রেস ক্লাবে অবস্থান নিয়ে চেষ্টা করছেন সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণের। যদিও দুই মাসেরও বেশি সময় ধরে অবস্থানের পরও ‘কর্তৃপক্ষে’র ‍দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারেননি।

আট বছর আগের এই দিনের কথা মনে আছে?— প্রশ্ন করতেই জরিনা বেগমের চোখ-মুখের অভিব্যক্তি বলে দিচ্ছিল, সেই বিভীষিকাময় দিনটি হয়তো জীবনে কখনো ভুলতে পারবেন না। অতীত খুঁড়ে জরিনা বেগম বলেন, বিকেল ৫টায় গার্মেন্টস ছুটি দেওয়ার কথা ছিল। বাড়তি কাজের কথা বলে ছুটি দেয়নি। সন্ধ্যা হবে হবে— এই সময় ফায়ার অ্যালার্ম বেজে ওঠে। দৌড়াদৌড়ি করে নিচে নামি। সিকিউরিটি গার্ড আলামিনকে জানাই, আগুন লাগছে। সে আমাদের নিচে নামতে দেয় নাই। বলে, কিছুই হয় নাই। আর ফ্যাকটরি ম্যানেজার রাজ্জাক গালিগালাজ করতে থাকে। রাজ্জাক তখন বলে, তোমাদের কিছু হলে ঠিকই দৌড়াদৌড়ি শুরু করো, মাস শেষে তো ঠিকই টাকা বুঝে নাও।

বিজ্ঞাপন

‘আমরা বলি— স্যার, আগুন লাগছে। আপনি এইডা কী বলেন? আমরা নিজ চোখে সিঁড়িতে আগুন দেখে আসছি। আপনি বলতেছেন ওপরে উঠতে। আমরা বাঁচব ক্যামনে, সেই চিন্তাটা আপনি করতেছেন না! তবু কাজ হয় না। আমি জোর করে কেচি গেট (কলাপসিবল গেট) খুলে তিন তলায় উঠে পড়ি। অনেক শ্রমিক ছিল ওইখানে। ওই সময় ফ্লোরের লাইট সব বন্ধ করে দেয়। ধোঁয়াতে আমাদের নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসতেছিল। পাশে ছিল একতলা বিল্ডিং। ওইটার একতলার ছাদে অনেকে দাঁড়ায়েছিল সাহায্য করার জন্য। ওইখানকার একটা জানালা ভাঙা হয়। অনেক পাড়াপাড়ি করে ওই বিল্ডিংয়ের ছাদে ঝাঁপ দিচ্ছিল, নিচে ঝাঁপ দিচ্ছিল। আমি ভিতরে আটকিয়ে গেছিলাম। আমার টার্গেট ছিল, ভিতরে কোনভাবেই জ্ঞান হারাব না। যদি মরি, আগুনে পুড়ে মরব না। মরতে হলে নিচে পড়ে মরব, যাতে আমার মা লাশটা পায়,’— বলছিলেন জরিনা।

সেদিনের তাৎক্ষণিক সেই ভাবনা নিয়ে আজও আক্ষেপ জরিনার। কারণ তিন তলা থেকে ভাঙা জানালা গলে বেরিয়ে একটি বাঁশ বেয়ে নিচে নামার চেষ্টা করেন তিনি। সেই চেষ্টায় সফল হননি। মাথা ঘুরে পড়ে যান। জরিনা বলেন, তিন তলা থেকে নিচে পড়ছি, শুধু এইটুক জানি। পরার পর আমার জ্ঞান ছিল না। নিচের মানুষ এক ঘণ্টা ধরে পানি ঢালছে, কিন্তু জ্ঞান ফিরেনি। পরে আমাকে হাসপাতালে নেয়। আমার সাথে আরেক গার্মেন্টস শ্রমিক, আমেনা আপাকেও ঢাকা মেডিকেলে পাঠানো হয়। কিছুদিন পর আমেনা আপা মারা যায়। আমেনা আপা মেরে গিয়ে বেঁচে গেছে। আর আমি যে জীবন নিয়ে বেঁচে আছি, তা অভিশাপের জীবন। আমাদের অনেক কষ্ট হয়। এত কষ্টের চাইতে মরে যাওয়াও ভালো।

তিন তলা থেকে পড়ে যাওয়ার কারণে জরিনা বেগমের ডান পা ভেঙে যায়, মেরুদণ্ডের হাড় ভেঙে যায়। শরীরের একাধিক জায়গায় রড ঢুকে পড়েছিল। ট্রমা সেন্টারে ভর্তির পর জরিনার জ্ঞানই ফেরে ১১ দিনের মাথায়। টানা ১৭ দিন তার পা প্লাস্টার করে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল, যা নড়াচড়া করার সুযোগটুকু পর্যন্ত ছিল না। সে অবস্থাতেও প্রাণে বেঁচে যান তিনি, কিন্তু তার নিজের ভাষায় বেঁচে আছেন ‘জিন্দা লাশ’ হয়ে।

জরিনা বেগম বলেন, আগে যদি জানতে পারলাম আমারে এই অভিশপ্ত জীবন নিয়া বেঁচে থাকতে হবে, তাইলে আগেই মরে যাইতাম। আমি সামান্য ক্ষুদ্র গরীব মানুষ। গ্রাম থেকে আসছিলাম ভাত খাওয়ার জন্য। কিন্তু আমাদের যে জিন্দা লাশ হয়ে জীবন কাটাতে হবে, এটা আমি কোনোদিনও ভাবছিলাম না। আজকে যদি আমি ভালো থাকতাম, তাইলে কাজ করতাম। আমরা শিশু সন্তান নিয়ে কেনই বা রাস্তায় ঘুরব? আজকে ছেলে-মেয়ের কোনো চাহিদা মেটাতে পারি না, ‍দুইটা খাওয়াইতে পারি না। তাদের তো বাপও আমি, মাও আমি। আমার মা’র অসুখ। তাও মানুষের বাড়িত বাড়িত কাজ করে খায়। এর চায়ে তো আমার মরণও অনেক ভালো ছিল। আগে যদি জানতাম এমন কষ্ট হইব, স্বামী অসুস্থ রেখে চলে যাইব, তাইলে ঠিক অত্মহত্যা করতাম।

তাজরীন কেড়ে নিয়েছে চলৎশক্তি। সমাজের কাছেও আর কোনো সহায়তা পাননি। দুই সন্তানকে পঙ্গু জরিনার কাছে রেখে তার স্বামীও চলে যায়। পঙ্গু অবস্থাতেও চেষ্টা করেছেন বাড়িতে মাথা গুঁজে থেকেই কিছু করার। কিন্তু করোনাভাইরাস তার সব চেষ্টায় জল ঢেলে দিয়েছে। জরিনা বলেন, করোনার মধ্যে আমরা অনেক কষ্ট করছি। দুইটা ভাই-বোন তখন অসুস্থ। ২০ হাজার টাকায় বাড়ি বন্ধক রাইখা চিকিৎসা করছি। ফিরাইতে পারি নাই। যারে বন্ধক দিছিলাম, সেও বাড়ি ফিরত দেয় নাই। ভাই-বোন হারাইলাম, বাড়িঘরও হারাইলাম। একটা পাখিরও বাসা আছে। সে সন্ধ্যা হইলে বাসায় যায়। আমার সেটাও নাই। যেই খানে ভাড়া থাকি, করোনার মধ্যে রুম ভাড়া অনেক বাকি। বাড়িওয়ালার কাছে ফিরত যাওয়ার উপায় নাই। তাই শিশু বাচ্চারে নিয়া আজকে রাস্তার মধ্যে।

জরিনাসহ তাজরীনে ক্ষতিগ্রস্ত যে ৪৫ জন দুই মাসেরও বেশি সময় ধরে প্রেস ক্লাবের সামনে অবস্থান করছেন, তাদের দাবি তিনটি— তাজরীনের আগুনে দগ্ধ ও সেদিন যারা আহত হয়েছেন, তাদের ন্যায্য ক্ষতিপূরণ; যথাযথভাবে পুনর্বাসন; এবং দীর্ঘ মেয়াদে সুচিকিৎসার ব্যবস্থা। জরিনা জানালেন, এখানে যে ৪৫ জন অবস্থান নিয়েছেন, তারা সবাই একেবারেই নিঃস্ব। আরও অনেকেই হয়তো আছেন এমন। সরকার আর রাষ্ট্রের কাছে তাদের বক্তব্য— রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে তাদের এই তিনটি দাবি কোনোভাবেই অন্যায্য নয়। তাই দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত তারা প্রেস ক্লাবের সামনের অবস্থানও ছাড়ছেন না।


কথা বলতে বলতে ঘুরেফিরেই ২০১২ সালের ২৪ নভেম্বরে ফেরত যান জরিনা বেগম। চোখের সামনে আগুনের লেলিহান শিখায় সহকর্মীদের পুড়ে যাওয়ার স্মৃতি ভুলতে পারেন না। আজও যেন সেই ট্রমা কাটেইনি জরিনা বেগমের।

তিনি বলেন, ওই দিনের কথা মনে পড়লে এখনো মাঝে মধ্যে জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। চোখের সামনে কত মানুষ পুড়লো। আমি এখনো আলো ছাড়া ঘুমাতে পারি না। অন্ধকার দেখলেই সেই দিনের কথা চোখের সামনে ভেসে ওঠে। বিল্ডিং দেখলেই মনে হয়, আবার কি আটকে যাব! অনেক ডাক্তার দেখাইছি, কাজ হয়নি। সেই দিনের কথা মনে হইলেই টেনশন হয়। তখন বুকের ব্যথা বেড়ে যায়। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয়। কিন্তু ভুলতে তো পারি না। কিভাবে ভুলব! চোখের সামনে যারা পুড়ে মারা গেছে, ওরা তো আমার পরিবারের মতোই আপন ছিল! একেকটা মানুষ পুড়ে পুড়ে কয়লা হয়ে গেল!

বলতে বলতেই দুই চোখ ভেঙে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে জরিনার। কিছুক্ষণ কথা বলতে পারেন না। চোখটা বন্ধ করে থাকেন। যখন চোখ খোলেন, সে চোখজুড়ে দুঃখ-বেদনা-ক্ষোভ ছাড়িয়েও এক অসীম শূন্যতা। কিছুক্ষণ পর স্বগতোক্তির মতো যেন বলে ওঠেন— পুড়ে না মরে লাভটা হলো কী, ওদের মতো পুড়লেই ভালো হতো! আট বছর ধরে তো অভিশাপের আগুনে পোড়া লাগত না!

অভিশাপ তাজরীন দৃষ্টি আকর্ষণ প্রেস ক্লাব

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর