ঘরে ঘরে মাদকের আস্তানা, পুকুরে বস্তাভর্তি ফেনসিডিল
১৫ মার্চ ২০১৮ ১০:২১ | আপডেট: ৫ নভেম্বর ২০১৮ ২০:০৫
হৃদয় দেবনাথ, মৌলভীবাজার থেকে
ভারতের সীমান্ত ঘেঁষা মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলের মন্দিরগাঁও । এই গ্রামেই জুনন মিয়ার বাড়ি। মন্দিগাঁও ছাড়াও দুর-দুরান্তের মানুষের কাছেও এ বাড়িটি খুবই চেনা। দুর থেকে দেখা যায় জুনন মিয়ার বাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে আছে সারি সারি গাড়ি ও মোটর সাইকেলের । আর বাড়ির ভেতরে বসেছে শহর থেকে আসা যুবকদের ফেনসিডিল আড্ডা।
গত একমাসে সারাবাংলার অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে মৌলভীবাজারে এমন বেশকিছু মাদক আস্তানার তথ্য। জুনন মিয়ার বাড়িসহ ভারতের সীমান্তবর্তী এলাকার মাদক বিক্রির কেন্দ্রগুলো ঘুরে এ প্রতিবেদনটি তৈরি করতে গিয়ে গত ২৭ ফেব্রুয়ারি মাদক ব্যবসায়ীদের হামলারও শিকার হন এই প্রতিবেদক।
সারাবাংলার অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ভারত সীমান্তবর্তী মৌলভিবাজারের শ্রীমঙ্গল উপজেলার মন্দিরগাঁও, সিন্দুরখান ও কুঞ্জবন গ্রামের প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই এভাবে মাদকের ব্যবসা চলছে।
স্থানীয়দের অভিযোগ, রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর যোগসাজশে চলে এসব মাদক বেচা-কেনা।
এ প্রতিবেদকের সঙ্গে থাকা একজন মাদক ব্যবসায়ী জুনুন মিয়াকে ডেকে দুই বোতল ফেনসিডিলের অর্ডার দেয়। এরপর জুনুন মিয়া পাশের পুকুরের পানিতে লুকিয়ে রাখা বস্তা থেকে ফেনসিডিল বের করে এনে সোর্সের হাতে তুলে দেয়। জুনুন মিয়ার মাদক বিক্রির এ দৃশ্য ধারণ করা হয় ক্যামেরায়।
কুঞ্জবন গ্রামের একজন মাদক ব্যবসায়ী জানান, এ মুহূর্তে জেলার সবচেয়ে বড় মাদক ব্যবসায়ী হলেন সিন্দুরখান বাজার কমিটির সাধারণ সম্পাদক ফটিক মিয়া। এরইমধ্যে ফটিক মিয়ার স্ত্রী একাধিকবার বিপুল পরিমাণ মাদকসহ র্যাবের হাতে আটক হয়েছে। তবে এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়েছে ফটিক মিয়া। স্থানীয় প্রশাসনকে ম্যানেজ করেই ওই এলাকায় মাদকের ব্যবসা করে সে।
এই মাদক ব্যবসায়ী বলেন, ফটিক মিয়া সীমান্ত পথে ভারত থেকে প্রতিদিন প্রায় পাঁচ থেকে দশ লাখ টাকার ফেনসিডিল, মদ ও গাঁজাসহ বিভিন্ন ধরনের অবৈধ মালামাল নিয়ে আসে। ফটিক মিয়া মূলত ওই এলাকার মাদকের পাইকারি ব্যবসায়ী। তার অধীনে ২০-৩০ জনের মতো খুচরা ব্যবসায়ী রয়েছে যারা জেলার শতাধিক পয়েন্টে মাদক দ্রব্য সরবরাহ ও বিক্রি করে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক পুলিশ কর্মকর্তা জানান,ভারত থেকে চোরাই পথে মাদক পাচার ব্যবসায় পুরুষের পাশাপাশি অনেক নারীও জড়িয়ে পড়েছে।পাইকারি ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে কিনে খুচরা ব্যবসায়ীরা সেগুলো নির্দিষ্ট স্থানে গ্রাহকদের কাছে সরবরাহ করে। মাদক সরবরাহের দুই ধরনের ব্যবস্থা আছে, কোথাও কোথাও মাদক ব্যবসায়ীর বাড়িতে গিয়ে মাদক সেবন করে আসা যায়। আবার কিছু ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীরাই মাদকসেবীদের কাছে মাদক পৌঁছে দেয়।
বর্তমানে পুলিশের হাতে আটক হয়ে জেলে আছেন মন্দিরগাঁওয়ের বশির। এ ছাড়াও র্যাবের হাতে আটক হয়ে জেলে আছে পশ্চিম ভাড়াউড়ার লেংড়া অমৃত। বাকিরা এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে।
মৌলভীবাজারের পুলিশের অপরাধ স্পটের তালিকায় বাস-ট্রেন স্টেশনসহ প্রায় অর্ধশত আস্তানা আছে যেখানে প্রতিনিয়ত বিক্রি হচ্ছে ইয়াবা ও ফেনসিডিল।
মৌলভীবাজারের উল্লেখযোগ্য কয়েকটি মাদক স্পট হলো সীমান্তবর্তী ফুসকুড়ি ফিনলে চা বাগান এলাকা, রাজঘাট ফিনলে চা বাগান এলাকা, সিন্দুরখান, সিন্দুরখাঁনের বালুর ঘাট, মন্দিরগাঁও, কুঞ্জবন, শ্রীমঙ্গল রেলওয়ে স্টেশনের আশপাশ, শ্রীমঙ্গল শহরের লালবাগ এলাকা, কলেজ রোড, জোড়াপুল, রেলওয়ে গেটের পাশে নার্সারি, শাহজীবাজার, পশ্চিম ভাড়াউড়া, সবুজবাগ এলাকার ত্রিমুখী পুল, পশ্চিম ভাড়াউড়া, কালীবাড়ি বাজার, লইয়ারপুর কামার পাড়া, জাম্বুরা ছড়া, জানাউরা, উত্তরসুর, পূর্বাশা, কলেজ রোড জোড়াপুল, সুরভীপাড়া, ও মৌলভীবাজার সদরের বর্ষিজোড়া, বড়হাট, চাঁদনীঘাট ব্রিজের নিচ, টেংরা বাজার ও এসব মাদক ব্যবসাগুলোর নিয়ন্ত্রণ করছে বিভিন্ন ব্যক্তি।
তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে সিন্দুরখান বাজার কমিটির সাধারণ সম্পাদক ফটিক মিয়া, মন্দিরগাঁওয়ের জুনুন মিয়া, সাইটুলার নজরুল, কুঞ্জবন এলাকার কাওছার ও জয়নাল, লালবাগ এলাকার মিলি বেগম, পশ্চিম ভাড়াউড়া এলাকায় লেংড়া অমৃত, শাহজী বাজার এলাকার রতন ও শামীম, মন্দির গাঁওয়ের বশির, জানাউরা এলাকার রাজনসহ আরও অনেকে।
এ বিষয়ে মৌলভীবাজার জেলার সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার আশরাফুজ্জামান সারাবাংলাকে জানান, মাদক নির্মূলে আমরা জেলা পুলিশ কাজ করে যাচ্ছি। মরণঘাতী নেশা ফেনসিডিল ইয়াবাসহ সমস্ত নেশাকে যাতে সহনীয় পর্যায়ে আনা যায়, আমরা জেলা পুলিশ সে লক্ষ্যেই কাজ করে যাচ্ছি। কোনো পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে মাদকের সঙ্গে জড়িত থাকার প্রমাণ পেলে তাকেও আইনের আওতায় এনে শাস্তির ব্যবস্থা করা হবে।
তবে জেলা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা সুবোধ কুমার বিশ্বাস বলেন, মাদক কম বেশি সবখানেই আছে। মৌলভীবাজারে মাদকের এমন ভয়াবহতা আমার জানা নেই। এ ছাড়া তিনি আরও জানান, আমাদের জনবল সংকটের পাশাপাশি যানবাহনেরও ব্যাপক সংকট রয়েছে।
সারাবাংলা/আরডি/এমআই