চীনা গবেষণায় দাবি— করোনার উৎপত্তি বাংলাদেশ বা ভারতে!
২৮ নভেম্বর ২০২০ ১৯:৪৩
চীনের হুবেই প্রদেশের উহান শহর থেকে করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) উৎপত্তি— এতদিন ধরে এ তথ্যই জেনে এসেছে সারাবিশ্ব। তবে এবারে চীনের একদল বিজ্ঞানী তাদের এক গবেষণার বরাত দিয়ে দাবি করেছেন— চীন নয়, এই ভাইরাসের উৎপত্তি ভারত কিংবা বাংলাদেশের কোনো শহরে। তবে এ ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্টভাবে কোনো শহরের নাম তারা জানাননি।
গবেষকরা আরও বলছেন— ডিসেম্বরে উহানে করোনাভাইরাসের প্রথম সংক্রমণ শনাক্ত হলেও ভারত বা বাংলাদেশে এই ভাইরাসের সংক্রমণ হয়েছে আরও তিন থেকে চার মাস আগে। তবে ভারতের বিজ্ঞানীরা চীনা বিজ্ঞানীদের এই দাবিকে নাকচ করে দিয়েছেন। আর আন্তর্জাতিক গবেষকরা বলছেন, এটি একটি ‘ত্রুটিপূর্ণ’ গবেষণা। ‘ব্লেম গেমে’র অংশ হিসেবে চীন এই গবেষণা চালিয়ে থাকতে পারে। আর গবেষণাটি এখনো কোনো স্বীকৃত জার্নালে প্রকাশ পায়নি, ছাপা হয়েছে একটি প্রিপ্রিন্ট সার্ভারে।
ব্রিটিশ গণমাধ্যম সানের খবরে এ তথ্য উঠে এসেছে। খবরে বলা হয়েছে, চীনের সাংহাই ইনস্টিটিউট ফর বায়োলজিক্যাল সায়েন্সের গবেষকরা এই গবেষণা পরিচালনা করেছেন। ‘দ্য আর্লি ক্রিপটিক ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ইভোল্যুশন অব সার্স-কোভ-২ ইন হিউম্যান হোস্ট’ শিরোনামের গবেষণাতেই চীনের উহান থেকে করোনাভাইরাসের উৎপত্তির তথ্যকে নাকচ করে দেওয়া হয়েছে।
গবেষণাপত্রটি এখনো কোনো জার্নালে প্রকাশিত হয়নি। তবে এটি সোস্যাল সায়েন্স রিসার্চ নেটওয়ার্ক (এসএসআরএন ডটকম) নামের প্রিপ্রিন্ট সার্ভারে প্রকাশ করা হয়েছে। এই প্রিপ্রিন্ট সার্ভারটি পরিচালনা করে থাকে এলসেভিয়ার, যারা ল্যানসেট ও সেলের মতো স্বনামধন্য জার্নাল প্রকাশ করে থাকে। অন্যদিকে এসএসআরএনের মতো প্রিপ্রিন্ট সার্ভারগুলো যেকোনো গবেষণাপত্রই জার্নালে প্রকাশের আগেই সেটি প্রকাশ করে থাকে। তবে এই গবেষণাপত্র পিয়ার রিভিউড না, অর্থাৎ অন্য গবেষকরা এই গবেষণাকে কোনো স্বীকৃতি দেননি।
এসএসআরএন প্রিপ্রিন্ট সার্ভারে প্রকাশিত জার্নালে চীনের বিজ্ঞানীদের গবেষণাপত্রটির তথ্য বলছে, তারা ১৭টি দেশ থেকে সংগৃহীত করোনাভাইরাসের নমুনার স্ট্রেইন নিয়ে গবেষণাটি করা হয়েছে। গবেষণা দলের নেতৃত্ব দিয়েছেন ড. শেন লিবিং। তিনি জানিয়েছেন, করোনাভাইরাসের উৎস খুঁজতে প্রচলিত পদ্ধতি উপযুক্ত নয়। এর বদলে তারা প্রতিটি ভাইরাল স্ট্রেইনের মিউটেশনের তথ্য বিশ্লেষণ করেছেন।
গবেষকদের দাবি, যেসব ভাইরাল স্ট্রেইনের মিউটেশন সবচেয়ে বেশি হয়েছে, সেগুলো দীর্ঘ দিন ধরে সেগুলো অস্তিত্বশীল। অন্যদিকে যেসব স্ট্রেইনের মিউটেশন কম হয়েছে, সেগুলো করোনাভাইরাসের প্রকৃত পূর্বপুরুষের সবচেয়ে কাছাকাছি রয়েছে। গবেষণাপত্রে দাবি করা হয়েছে, যেসব স্ট্রেইনের মিউটেশন সবচেয়ে কম হয়েছে, সেগুলো পাওয়া গেচে আটটি দেশে— অস্ট্রেলিয়া, বাংলাদেশ, ভারত, গ্রিস, যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, ইতালি ও চেক রিপাবলিক।
গবেষণাপত্রে আরও দাবি করা হয়েছে, এই ভাইরাসটি প্রথম সেসব শহরেই প্রথম মহামারি আকারে ছড়িয়েছে, যেসব শহরে জিনগত বৈচিত্র্য ছিল সবচেয়ে বেশি। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ও ভারতের কয়েকটি শহরের দিকে ইঙ্গিত করেছেন গবেষকরা। তারা বলছেন, এসব শহরের তরুণ জনগোষ্ঠী ও চরম ভাবাপন্ন আবহাওয়া ও এই ভাইরাসকে মানব শরীরে আক্রমণের উপযোগী পরিবেশ তৈরি করেছে।
গবেষকরা লিখেছেন, আমাদের গবেষণায় প্রাপ্ত ফল থেকে দেখা যাচ্ছে, মানবশরীরে সার্স-কোভ-২-এর প্রথম সংক্রমণ উহানে হয়নি। এই ভাইরাসের যেসব স্ট্রেইনের মিউটেশন সবচেয়ে কম হয়েছে সেসব স্ট্রেইনের তথ্য এবং স্ট্রেইনের বৈচিত্র্য ইঙ্গিত করে, ভারতীয় উপমহাদেশ থেকেই প্রথম এই ভাইরাস মানবশরীরে প্রবেশ করে থাকতে পারে, যা উহানের করোনাভাইরাস সংক্রমণ শনাক্ত হওয়ারও তিন থেকে চার মাসে ঘটেছিল।
প্রিপ্রিন্ট সার্ভারে প্রকাশিত এই গবেষণাপত্রটি এখনো পিয়ার রিভিউড নয়। ফলে এই গবেষণাপত্র নিয়ে স্থির কোনো সিদ্ধান্ত ঘোষণা করার সুযোগ নেই। ভারতীয় বিজ্ঞানীরাও এই গবেষণা নিয়ে স্পষ্ট ভাষায় দ্বিমত জানিয়েছেন। গবেষণা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অন্য দেশের বিজ্ঞানীরাও।
ভারতীয় ভাইরোলজিস্ট মুকেশ ঠাকুর সাউথ চায়না মর্নিং পোস্টকে বলেছেন, এই গবেষণায় তথ্য-উপাত্ত ভুলভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। অন্যদিকে, লস অ্যাঞ্জেলেসের ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার জেনেটিকস ও বায়োস্ট্যাটিসটিকসের অধ্যাপক মার্ক সুচার্ড বলেন, এই গবেষণার জন্য ভাইরাল স্ট্রেইনের নমুনা সংগ্রহের প্রক্রিয়াটি ‘অযৌক্তিক’। এ ধরনের নমুনা বিশ্লেষণ করে এই ভাইরাসের উৎস খুঁজে পাওয়াটা স্বাভাবিক নয়। অবশ্য তিনি চীনের গবেষকদের গবেষণা পদ্ধতিকে সম্ভাবনাময় বলেও মনে করেন। তবে একইসঙ্গে এর মধ্যে কিছু অনিশ্চয়তা রয়েছে— সেটিও উল্লেখ করেছেন তিনি।
ড. শেন লিবিং এসব সমালোচনাকেও স্বাগত জানিয়েছেন। তিনি বলেন, সবার মন্তব্য ও পর্যবেক্ষণের মাধ্যমেই কেবল গবেষণাটিকে ‘যথার্থভাবে’ গ্রহণযোগ্য বা বাতিল করে দেওয়ার সুযোগ আছে।
এখন পর্যন্ত পাওয়া তথ্য বলছে, চীনের উহান থেকে গত বছরের শেষ দিন, অর্থাৎ ৩১ ডিসেম্বর প্রথমবারের মতো কোনো মানুষের শরীরে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ পাওয়া যায়। শুরুতে একে কোনো ধরনের ফ্লু ভাইরাস মনে করা হলেও সংক্রমণ ছড়াতে থাকলে বিজ্ঞানীরা জানান, এটি নতুন এক ধরনের ভাইরাস। অনেক গবেষণার পর জানা যায়, এটি সার্স ভাইরাসের নতুন একটি ধারা। পরবর্তী সময়ে একে সার্স-কোভ-২ বা করোনাভাইরাস নাম দেওয়া হয়। এই ভাইরাসে আক্রমণে সৃষ্ট রোগের নাম দেওয়া হয় কোভিড-১৯।
এখন পর্যন্ত বিশ্বের ২১৮টি দেশে ৬ কোটি ২০ লাখেরও বেশি মানুষের শরীরে এই ভাইরাসের সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে। এই ভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ে মারা গেছেন ১৪ লাখেরও বেশি মানুষ। এই ভাইরাসের সংক্রমণে গোটা বিশ্বই বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। ১৯২০ সালের স্প্যানিশ ফ্লু মহামারির একশ বছর পর ফের এই ভাইরাস গোটা বিশ্বেই চরম মহামারি আকার ধারণ করেছে।
করোনাভাইরাস করোনাভাইরাসের উৎপত্তি করোনার উৎপত্তি কোভিড-১৯ চীনা গবেষণা প্রিপ্রিন্ট সার্ভার