Saturday 23 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

উড়াও শতাবতী (৭) মূল: জর্জ অরওয়েল, অনুবাদ: মাহমুদ মেনন


১৫ মার্চ ২০১৮ ১২:৩২

<< শুরু থেকে পড়তে

– ‘আমরা এগুলো কিনতে পারবো না,’
– ‘কিনতে পারবে না! কেন কিনতে পারবে না?’
– ‘কারণ ওগুলো কিনে আমাদের কোনোই ফায়দা নেই। এগুলো আমরা বিক্রি করতে পারবো না।’
– ‘তাইলে আমাকে দিয়ে ওগুলো ব্যাগ থেকে বের করালে কেন?’ ক্ষিপ্ত স্বর বুড়ির।

গন্ধটা এড়াতে বুড়ির কাছ থেকে একটু দূরত্ব রেখে ঘুরে এলো গর্ডন আর আস্তে করে দরজাটা খুলে ধরলো। তর্ক করে যে কোনও ফায়দা হবে না সে বুঝে গেছে।

সারাদিন এমন কিছু উটকো ঝামেলার লোকজন দোকানে আসেই। ব্যাগটি কাঁধে তুলে গজরাতে গজরাতে বুড়ি দরজা পথে বেরিয়ে গেলো আর স্বামীর সঙ্গে গিয়ে কাঁধ মেলালো। বুড়োটি তখনও স্বশব্দে কেশে গলা থেকে কফ ছাড়িয়ে চলেছে, এতই উচ্চশব্দে যে দরাজার কাচ ভেদ করে তা এসে গর্ডনের কানে লাগলো। এরপর একদলা কফ মুখের গহ্বরে নাড়াচাড়া করে, দুই ঠোঁটের মাঝখানে কিছুক্ষণ ধরে রেখে থু করে ফেললো পয়ঃনালিতে। অতঃপর দুই বৃদ্ধচিড়িয়া হেলেদুলে পথ ধরলেন, আর তাদের উপর চড়াও হয়ে চলতে শুরু করলো তেলচিটচিটে দুটি ওভারকোট। পা দু’জোড়াসহ সবকিছুই ঢাকা পড়ে আছে সেই কোটের নিচে। গর্ডন চেয়ে চেয়ে দেখলো তাদের সে গমন। এরা এখন সমাজের স্রেফ উপজাত। অর্থ নামক ঈশ্বর এদের উচ্ছিষ্ট করেছে। গোটা লন্ডনে এমন লাখ লাখ চোখে পড়বে, ভাগারের নোংরা ডুমো মাছির মতো এই একই দৃশ্যের অবতারণা ঘটিয়ে সড়কময় ঘুরে বেড়াচ্ছে। নোংরা সড়কের উপর চোখ পড়লো তার। এই মূহূর্তে মনে হল- এই যে সড়ক, এই যে শহর, এখানে জীবন ক্রমেই হয়ে উঠেছে অর্থহীন, অসহনীয়। সমন্বয়হীনতা, পতনশীলতারই এ এক সময়, এই ভাবনাটিই তার ওপর শক্ত হয়ে চেপে বসলো। আর কেমন করে যেন সে ভাবনা গিয়ে ভর করলো উল্টো দিকে বিজ্ঞাপনী পোস্টারগুলোর ওপর। এবার যেন আরো একটু স্পষ্ট করে চোখ ফেললো কেলিয়ে থাকা মুখগুলোর দিকে। স্রেফ যে অর্থহীন, লোভ আর নোংরামিতে ভরা তাই নয়, এতে যেন তার চেয়েও বেশি কিছু প্রকাশ্য। কোণার টেবিলটি যেন তোমার দিকে তাকিয়ে হাসছে, দেখে মনে হবে বেশ আশাবাদিতা ছড়াচ্ছে মিথ্যা দাঁতের ঝলকানিতে। কিন্তু সে হাসির পিছনে কী লুক্কায়িত? উৎসাদন, শূন্যতা আর বিপর্যয়ের ভবিষ্যবচন। তুমি দেখতে পাবে না, কিন্তু যদি জানো যে কীভাবে দেখতে হয়, তাহলে দেখতে পাবে ওই মেকি আত্মতুষ্টি, ওই পেটফোলা মূর্খতার হাসির পেছনে ভয়ানক শূন্যতা, গোপন হতাশা ছাড়া আর কিছুই নেই। আধুনিক জগতের এ এক মহান মৃত্যু-কামনা। আত্মহননের সন্ধি। মস্তকগুলো আটকে গেছে শূন্যবাড়ির গ্যাসের চুলোয়, ফরাসি বর্ণমালায় আর খাবার বড়িতে। ভবিষ্যৎ যুদ্ধের পরাঘাতে। শত্রুর উড়োজাহাজ উড়ছে লন্ডনের আকাশজুড়ে, তার প্রোপেলারগুলো গভীর গোংগাচ্ছে, কাঁপাচ্ছে বোমার বজ্রনিনাদে। এসবই যেন লেখা আছে কোণার টেবিলে বসে থাকা মুখটিতে।

বিজ্ঞাপন

আরো খদ্দের আসছে। গর্ডন ঘুরে দাঁড়ালো, দাসোচিত ভদ্রস্থতায়। দরোজার ঘণ্টিতে শব্দ তুলে দুই উচ্চ-মধ্যবিত্তা কলকলিয়ে ঢুকলেন। একজন গোলাপি টসটসে পয়ত্রিশীয়, কাঠবেড়ালির চামড়ায় তৈরি কোটের ভেতর থেকে বিশালকায় স্তনযুগল বেশ প্রস্ফুটিত। আর পারমা ভায়োলেটের অতি-নারীয় সুঘ্রাণ ছড়িয়ে অপরজন মধ্যবয়ষ্কা বেশ কঠিনা, ঝাঁঝওয়ালী- ভারতীয় হতে পারেন। এদের ঠিক পিছে পিছে বেড়ালস্বভাবী মিনমিনে ভাব নিয়ে নোংরা কাপড়ে ঢুকলো লাজুক এক কৃষ্ণাঙ্গ যুবক। দোকানের সেরা খদ্দেরদের মধ্যে সে একজন। ভবঘুরে এক একক চিড়িয়া, মুখ ফুটে কথাটি পর্যন্ত বলতে লজ্জা পায় আর কোনো এক অদ্ভুত ব্যবস্থায় তাকে সবদিনই মনে হয়, আজ নয়, দাড়ি কামিয়েছে গতকাল।
গর্ডনের অভিবাদন পন্থা একই পুরোনো:

‘শুভ অপরাহ্ন। আপনাদের জন্য কী করতে পারি? কোনো বিশেষ বই খুঁজছেন কি? রস-টসটসা গোলাপীমুখো মায়াবী হাসিতে বিগলিত। তবে ঝালমুখী তার প্রশ্নগুলোকে স্রেফ ধৃষ্ঠতা হিসেবেই দেখলেন। গর্ডনকে সামান্য পাত্তা না দিয়ে রসমুখীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে সোজা নতুন বইয়ের তাকে মনোনিবেশ করলেন। ওখানে থরে থরে কুকুর বিষয়ক, বেড়াল বিষয়ক বইগুলো রাখা। দুজনই এবার তাক থেকে একের পর এক বই বের করতে শুরু করলেন, আর কথা বলতে থাকলেন উচ্চস্বরে। ঝালমুখীর কণ্ঠটাও বেশ ঝাঁঝালো। সন্দেহাতীতভাবেই কোনো কর্নেলের বউ, নয়তো বিধবা হবেন। সেই লুতুপুতু বালক তখনও রুশ ব্যালেনৃত্তের বইয়ে মুখ চুবিয়ে, তবে আস্তে করে একপাশে একটু সরেই দাঁড়ালো। তার চেহারা বলছে, প্রাইভেসিতে আর যদি সামান্যও ব্যাঘাত ঘটে তো দোকান ছাড়বে। লাজুক যুবক এরই মধ্যে কবিতার তাকে তার গন্তব্য খুঁজে নিয়েছে। এই দুই নারীও প্রায়শঃই আসেন ম্যাকেচনির দোকানে। আর তাদের আগ্রহ কুকুর-বেড়ালের বইয়েই, তবে কখনো কিছু কিনেছেন বলে গর্ডনের মনে পড়েনা। দুই তাক ভরা কুকুর ও বেড়াল বিষয়ক বই, ম্যাকেচনি তার নাম দিয়েছে ‘লেডিস কর্নার’।

বিজ্ঞাপন

তখনই লাইব্রেরির জন্য আরেক খদ্দের এসে হাজির। কুৎসিত দেখতে এই কন্যার বয়স বিশ। সাদা আলখেল্লা গায়ে, মাথায় হ্যাট নেই। পাংশুবর্ণা খসখসে সৎ একটা মুখ, শক্তিশালী চশমায় চোখদুটো বিকৃতই দেখা যায়। একটি কেমিস্ট শপের সহকারী। এবার গর্ডন তার ঘরোয়া লাইব্রেরীয় আদলটা চেহারায় মেখে নিলো। মেয়েটি তার পানে চেয়ে সামান্য হাসি ছুড়ে দিয়ে, অনেকটা ভল্লুকের ভঙ্গিতে পা ফেলে ফেলে লাইব্রেরির ভেতরে ঢুকলো।

‘কী ধরনের বই পড়তে চাইছেন, মিজ উইকস?’

‘এইতো’- আলখেল্লার সামনের দিকটা একটু খামচে ধরলো সে। আর কালো-মনির চোখদুটো বিশ্বস্ততার দৃষ্টি ফেললো গর্ডনের উপর। ‘এইতো, আসলে একটা গরমাগরম প্রেমের গল্প পড়তে চাই। তুমিতো জানো- আধুনিক কিছু একটা।’
‘আধুনিক কিছু? যেমন ধরো বারবারা বেডওর্দি’র যদি হয়? তুমি কি অলমোস্ট আ ভারজিন পড়েছো?’

‘আরে না, বারবারার বই না, উনি খুব গভীরে যান। বেশি গভীরের কিছু পড়তে আমার ভাল্লাগে না। তবে আমি আধুনিক কিছুই চাই। এই ধরো যৌনতার সঙ্কট বিষয়ক, বিয়ে বিচ্ছেদ এই ধরনের।’

‘আধুনিক কিন্তু গভীরের কিছু নয়,’ বললো গর্ডন আর তাক ধরে তার চোখ ক্রমেই নিচের দিকে নামাতে থাকলো। তবে গরম প্রেমের কাহিনীর অংশেই দৃষ্টি সীমাবদ্ধ রাখলো। লাইব্রেরিতে সে ধরনের বই তিন শ’র কম হবে না। সামনের কামরা থেকে দুই উচ্চমধ্যবিত্তার গলার আওয়াজ তখনও আসছে।

পরের অংশ>>

বিজ্ঞাপন

বরিশালে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ২
২৩ নভেম্বর ২০২৪ ১৭:৩১

বাঘায় কৃষককে গলা কেটে হত্যা
২৩ নভেম্বর ২০২৪ ১৬:৪৩

আরো

সম্পর্কিত খবর