‘সৈন্যরা পূর্ব পাকিস্তানে মার খাচ্ছে, ইয়াহিয়া মত্ত মদ-নারীতে’
১ ডিসেম্বর ২০২০ ১৬:০৬
ঢাকা: ডিসেম্বর উনিশশ একাত্তর। বাংলাদেশ নামক স্বাধীন সার্বোভৌম রাষ্ট্রের জন্ম সময়ের ব্যাপার মাত্র। পাকিস্তানের সামরিক জান্তা বিশ্বাস করুক বা না করুক, গোপন চিঠি চালাচালির মাধ্যমে তাদের প্রধান মিত্র যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট স্পষ্টই জেনে গেছে— পাকিস্তানের পরাজয় ঠেকানোর আর কোনো উপায় নেই। অতঃপর ১৬ ডিসেম্বর অসহায় আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে চূড়ান্ত পরাজয় স্বীকার করে নেয় জেনারেল ইয়াহিয়া খানের শাসনাধীন পাকিস্তান। বিশ্বের মানচিত্রে জন্ম হয় স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের। এ ঘটনাটি ছিল বাঙালি জাতির জন্য গৌরবের, আনন্দের। অপরদিকে পাকিস্তানের জন্য ছিল লজ্জার, বেদনার, হতশার।
পৃথিবীর অমোঘ নিয়ম মেনেই সেদিন জেনারেল ইয়াহিয়া খানের নেতৃত্বাধীন পাকিস্তান সরকারের পরাজয়ের ভাগ নিতে রাজি ছিলেন না দেশটির অপরাপর রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতারা, সাবেক সরকারের প্রধান ব্যক্তিরা। পতনোম্মুখ পাকিস্তানের বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ জেনারেল ইয়াহিয়া খানের নেতৃত্বের কঠোর সমালোচনা শুরু করেন। বিশেষ করে ডিসেম্বর মাসের শুরুতে ধীরে ধীরে পরাজয় নিশ্চিত হতে থাকলে জেনারেল ইয়াহিয়াকে তুলোধূনা করতে থাকেন পাকিস্তানের রাজনীতিতে থাকা শীর্ষ ব্যক্তিরা।
এ ক্ষেত্রে পিছিয়ে ছিলেন না পাকিস্তানের রাজনীতিতে লৌহমানব হিসেবে খ্যাত জেনারেল মোহম্মদ আইয়ুব খানও। ১৯৬৯ সালে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাঙালির গণঅভ্যুত্থানে নিজে ক্ষমতাচ্যুত হলেও বাঙালির কাছে ইয়াহিয়া নেতৃত্বাধীন পাকিস্তান সরকারের পরাজয় নিয়ে বেফাঁস মন্তব্য করতে ছাড়েননি আইয়ুব খান। বিভিন্ন মাধ্যমে কঠোর সমালোচনার পাশাপাশি নিজের ব্যক্তিগত ডায়েরিতেও জেনারেল ইয়াহিয়াকে নিয়ে বিষোদগারপূর্ণ রোজনামচা লিখেছেন আইয়ুব খান।
১৯৬৯-এর ২৫ মার্চ ক্ষমতাচ্যুত পাকিস্তানি প্রেসিডেন্ট ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান ডিসেম্বরের প্রথম দিন ডায়েরিতে লেখেন— ‘এত দিন যারা আমার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করেছে, তারা এখন আমাকে ফিরে চাচ্ছে। অবশ্য শেখ মুজিবুর রহমানকে জেল থেকে ছেড়ে দেওয়ার কারণে (আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার পর) অনেকেই আমাকে দোষারোপ করছেন।’…
এদিন তিনি ডায়েরিতে আরও লেখেন, ‘সীমান্তে সৈন্যরা কেমন আছে, তা জানতে ইয়াহিয়া সরেজমিন সফর করছেন না কেন? তার যাওয়া উচিত সৈন্যদের কাছে, বিশেষ করে পূর্ব পাকিস্তানে, যেখানে সৈন্যরা ভয়ংকর চাপের মধ্যে রয়েছে। তা না করে, তিনি মদ খেয়ে মেয়েমানুষ নিয়ে মেতে আছেন।’
আইয়ুব খান লিখেছেন, ‘একটি অভ্যুত্থান হতে পারে— এমন গুজব শুনতে পাচ্ছি। অভ্যুত্থানের সম্ভাবনা আছে— আমি এমন মনে করছি না। তবে ইয়াহিয়া খানের বিরুদ্ধে মানুষের অসন্তোষ বাড়ছে। জনগণ মনে করছে কোনো ধরনের দিকনির্দেশনা দেওয়ার ক্ষমতা ইয়াহিয়ার নেই।’
বিভিন্ন মহলের অব্যহত সমালোচনার মধ্যে ১ ডিসেম্বর জেনারেল ইয়াহিয়া ‘পাকিস্তান ডিফেন্স অর্ডিন্যান্স ও ডিফেন্স অ্যাক্ট’ জারি করেন। সেখানে বলা হয়— ‘১ ডিসেম্বর ১৯৭১ জিরো আওয়ার থেকে যুগপৎ পাকিস্তান ডিফেন্স অর্ডিন্যান্স ও ডিফেন্স অ্যাক্ট পাকিস্তানে উভয় অংশে বলবৎ হলো। এর সারাংশ— সশস্ত্র বাহিনীর সুরক্ষা ও সব সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত হবে; শত্রুদের সহযোগিতা, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সামরিক তৎপরতা ও যুদ্ধ পরিচালনায় বাধা প্রদান বিশেষ অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হবে; স্টেট ব্যাংকসহ অন্যান্য রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের কাজে বাধাদান রাষ্ট্রানুগত্যের বিরোধিতা বলে গণ্য হবে; গুজব ও অসন্তোষ বিস্তার, পাকিস্তানের সঙ্গে অন্য রাষ্ট্রের সম্পর্কের অবনতি ঘটানো, নিরাপত্তা হুমকি সব অপরাধ কঠোরভাবে বিবেচনা করা হবে। জল, স্থল ও আকাশ যোগাযোগ, রেলপথ, নৌপথ, ডাক যোগাযোগসহ সব যোগাযোগ মাধ্যম সরকারের পূর্ণ কর্তৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণে থাকবে; জননিরাপত্তার বিঘ্নকারী এবং জননিরাপত্তার হুমকি হিসেবে চিহ্নিত সন্দেহভাজনকে আটক করা হবে; পাকিস্তানে আগত ও পাকিস্তান থেকে প্রত্যাগত সবার প্রতিনিধি নিয়ন্ত্রণ ও পর্যবেক্ষণ করা হবে; ডাক, তার ও বেতার সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকবে। সাব্যস্ত অপরাধীর ন্যূনতম পাঁচ বছরের কারাদণ্ড থেকে শুরু করে যেকোনো মেয়াদের দণ্ড এবং মৃত্যুদণ্ড হতে পারে।’
এদিন রাওয়ালপিন্ডি থেকে জানানো হয়, ভারত পাকিস্তানের আকাশসীমা লঙ্ঘন করেছে। পাকিস্তানি ফাইটারের ধাওয়ায় ভারতীয় জাহাজ চলে গেলেও চৌগাছায় মাটি থেকে শত্রুর গুলিতে তাদের স্যাবর যুদ্ধবিমান ভূপাতিত হয়েছে।
এদিন রাওয়ালপিন্ডি থেকে কেন্দ্রীয় সরকারের মুখপাত্র জানান, ভারত সংঘর্ষ তীব্রতর করে পাকিস্তানকে যুদ্ধের দিকে টেনে আনছে, যদিও পাকিস্তান বরাবরই শান্তি বজায় রাখার এবং যুদ্ধ পরিহার করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
আরও পড়ুন-
১ ডিসেম্বর ১৯৭১— মুক্তিযোদ্ধাদের সর্বাত্মক আক্রমণ
১৯৭১ জেনারেল ইয়াহিয়া খান ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান মুক্তিযুদ্ধ