Friday 27 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

পাকিস্তানি মাইনে উড়ে যায় পা, তবু স্বপ্নে ছিল স্বাধীনতা


৮ ডিসেম্বর ২০২০ ০৮:৩৪

নেত্রকোনা: যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ওসমান গণি তালুকদার। বসবাস করেন নেত্রকোনা পৌর শহরের নাগড়া এলাকায়। দাদা আব্দুল আলীম তালুকদারের ছিল অগাধ জমিজমা। আর বাবা আব্দুল মজিদ তালুকদার ছিলেন স্থানীয় মাতব্বর, গরীব মানুষের পাশে দাঁড়াতেন। স্বচ্ছল পরিবারের সন্তান হিসেবে সুযোগ ছিল তাই আয়েশি জীবনযাপনের। কিন্তু দেশের ডাকে অস্ত্র হাতে তুলে নিতে একবারও ভাবেননি। ছুটে গিয়েছিলেন যুদ্ধক্ষেত্রে। পাকিস্তানিদের পুঁতে রাখা মাইনে এক পা উড়ে গেলেও একমুহূর্তের জন্যও ভুলে যাননি স্বাধীনতার কথা।

বিজ্ঞাপন

কথা হচ্ছিল যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা মো. ওসমান গণি তালুকদারের সঙ্গে। তাঁর বাড়ি নেত্রকোণার বারহাট্টা উপজেলার গাভারকান্দা গ্রামে। আব্দুল মজিদ তালুকদার ও আয়শা মজিদ তালুকদারের পঞ্চম সন্তান ওসমান গণি। লেখাপড়ায় হাতেখড়ি দেওপুর প্রাইমারি স্কুলে। এরপর ভর্তি হন বারহাট্টা কোরেন্যাশন কৃষ্ণপ্রসাদ উচ্চ বিদ্যালয়ে। সেখান থেকেই ১৯৬৬ সালে এসএসসি পাস করেন। এরপর নেত্রকোণা কলেজ থেকে এইচএসসি পাসের পর তিনি ওই কলেজেই ডিগ্রিতে ভর্তি হন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ছিলেন ডিগ্রি পরীক্ষার্থী।

বিজ্ঞাপন

নেত্রকোণায় সে সময়কার রাজনৈতিক অবস্থার বিষয়ে এই যোদ্ধা বলেন, ‘নেত্রকোণায় তখন মুসলিম লীগবিরোধী একটা রাজনীতি চলত। বিশেষ করে ছাত্র ইউনিয়ন, ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টি ছিল শক্তিশালী। তৃণমূল পর্যায়ে স্কুলগুলোতে গিয়ে ওরা ছাত্রদের সচেতন করত। কমিউনিস্ট পার্টির বড় নেতা ছিলেন কমরেড মনি সিংহ। ন্যাপের ছিলেন আজিজুর রহমান ও ওয়াজেদ আলী। এছাড়া আওয়ামী লীগ করতেন ফজলুল কাদের, ফজলুর রহমান খান, আব্দুল খালেক, মমিন সাহেবরা। সত্তরের নির্বাচনে আমাদের ওখানে আব্দুল মমিন সাহেব এমএনএ এবং এমপিএ হন আব্বাস আলী খান। কিন্তু তবু ক্ষমতা দিতে টালবাহানা করে পাকিস্তানের শাসকরা।’

“তখন আমার বিএ ফাইনালের প্রস্তুতি চলছে, থাকি কলেজ হোস্টেলে। সারা দেশ উত্তপ্ত। আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা না দিলে যেন যুদ্ধ শুরু হবে। সে ঘোষণারই অপেক্ষায় আছে সবাই। ল হোস্টেলের রেডিওতে শোনেন বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণটি। বঙ্গবন্ধু বললেন ‘এবারের সংগ্রাম, আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম…।’ তখনই বুঝে গেলাম এবার যুদ্ধে যেতে হবে”, বলেন এই মুক্তিযোদ্ধা।

ওসমান গণি আরও বলেন, ‘২৫ মার্চ পাকিস্তানি সেনারা গণহত্যা শুরু করে। ঢাকায় আর্মি নামার খবর ছড়িয়ে পরে সারা দেশে। ফলে মানুষ জীবন বাঁচাতে মানুষ চলে যেতে থাকে সীমান্তের ওপারে, ভারতে। নেত্রকোণায় পাকিস্তানি সেনারা প্রবেশ করে এপ্রিলের শেষে। তবে এর আগেই আমরা শহর ছেড়ে চলে যাই গ্রামে।’

শহরের এসেই পাকিস্তানি সেনারা হিন্দু ও আওয়ামী লীগের লোকদের বাড়িগুলো জ্বালিয়ে দিচ্ছিল। পাকিস্তানি সেনাদের সাহায্যে এগিয়ে আসে শান্তি কমিটির লোকেরা। ফজলুল হক ছিলেন শান্তি কমিটির নেতা। আমাদের পেলেই তো ওরা মেরে ফেলবে। বুঝলাম বাঁচতে হলে লড়াই করেই বাঁচতে হবে। দেশের স্বাধীনতার জন্য তাই একদিন ঘর ছাড়ি— বলেন এই মুক্তিযোদ্ধা।

যুদ্ধদিনের স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, ‘মে মাসের কথা। মা জানতো ফুপুর বাড়িতে গিয়েছি। আমার সঙ্গে ছিল আব্দুল হাকিম। বিজয়পুরের বর্ডার পাড় হয়েই নাম লেখাই ভারতের মোহাদেও ইয়ুথ ক্যাম্পে। ক্যাম্পের দায়িত্বে ছিলেন হাবিবুর রহমান খান। সেখানে এক মাস চলে লেফট-রাইট। পরে এক মাসের হায়ার ট্রেনিংয়ের জন্য পাঠানো হয় তুরাতে। এই ট্রেনিং শেষেই আমাদের পাঠিয়ে দেওয়া হয় রণক্ষেত্রে।  ১২০ জনের কোম্পানির কমান্ডার ছিলেন ইসলাম উদ্দিন খান আর আবুল হোসেন। শেষে কোম্পানি ভেঙে দু-তিনটি গ্রুপে অপারেশন চালানো হয়।’ ১১নং সেক্টরের ধর্মপাশা, কলমাকান্দা, দুর্গাপুর, বিজয়পুরসহ আশাপাশের এলাকায় নানা গেরিলা অপারেশনে অংশ নিয়েছিলেন তিনি।

তবে ১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর এক অপারেশনে মারাত্মকভাবে আহত হন এই সূর্যসন্তান। পাকিস্তানি সেনাদের পুঁতে রাখা মাইনের আঘাতে তাঁর ডান পা উড়ে যায়। স্প্লিনটার বিদ্ধ হয় তাঁর বা পা ও ডান হাতের আঙুলও। সেদিনের দুঃখস্মৃতি আজও তাঁকে আনমনা করে দেয়।

রক্তাক্ত ওইদিন নিয়ে মুক্তিযোদ্ধা ওসমান গণির বলেন, ‘৩ ডিসেম্বর ১৯৭১। তখন আমরা বাগমারায়, হাইট আউটে। সঙ্গে ছিল ৬০-৭০ জন মুক্তিযোদ্ধা। বাংলাদেশের ভেতরে ঢুকে অপারেশন করে আবার বাগমারা ক্যাম্পে ফিরে যাবো। ভারতীয় সেনারাও যোগ দেন আমাদের সঙ্গে। গঠিত হয় যৌথবাহিনী। আমাদের ওখানে যৌথবাহিনীর কমান্ডে ছিলেন মেজর মুরারি। পথে পাকিস্তানিদের পুঁতে রাখা মাইনে বিস্ফোরণে পা উড়ে যায়। যখন জ্ঞান ফেরে তখন ক্যাম্পের বিছানায়। ভেঙে পড়েছিলাম যুদ্ধে যেতে পারবো না ভেবে। তবে মনের মধ্যে থাকা স্বাধীনতার স্বপ্নই মনে হয় আমারে বাঁচায়ে দেয়। যুদ্ধদিনে একটাবারের জন্যও সে স্বপ্ন ছাড়িনি।’

মাইন মুক্তিযুদ্ধ যুদ্ধক্ষেত্র স্বাধীনতার কথা

বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ

শরৎ বাংলাদেশের কোমল স্নিগ্ধ এক ঋতু
২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১৭:৫৪

সম্পর্কিত খবর