‘কোরআন-হাদিসের আলোকে মতামত দিয়েছি, মূর্তি ভাঙতে বলিনি’
৮ ডিসেম্বর ২০২০ ১৩:১৪
ঢাকা: ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশে’র আমীর মুফতি সৈয়দ মোহাম্মদ রেজাউল করীম বলেছেন, ‘ভাস্কর্য বা মূর্তির ব্যাপারে আমরা কেবল কোরআন হাদিসের আলোকে মতামত দিয়েছি, মূর্তি ভাঙার নির্দেশ দিইনি!’
মঙ্গলবার (৮ ডিসেম্বর) দুপুরে পুরানা পল্টনে দলটির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ মন্তব্য করেন। ভাস্কর্য নিয়ে উদ্ভূত পরিস্থিতি সম্পর্কে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের অবস্থান তুলে ধরার জন্য এ সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়।
সৈয়দ মোহাম্মদ রেজাউল করীম বলেন, ‘আমরা মূর্তি ভাঙতে বলিনি! সুতরাং রাতের আঁধারে যারা মূর্তি ভেঙেছে, তাদের ভিন্ন উদ্দেশ্য আছে! তৃতীয় কোনো পক্ষ মূর্তি ভেঙে দেশের উন্নয়ন, অগ্রগতি, ঐক্য নষ্ট করার ষড়যন্ত্র করছে।’
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের সিনিয়র নায়েবে আমীর মুফতি সৈয়দ মুহাম্মাদ ফয়জুল করীম, হেফাজতে ইসলামের আমীর জুনায়েদ বাবুনগরী এবং যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা মামুনুল হকের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলা প্রত্যাহারের দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, ‘চক্রান্তকারীরা বাংলাদেশের মানুষের ঐক্য বিনষ্ট করে ভিনদেশি এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে সামাজিক ও ধর্মীয় অস্থিতিশীলতা তৈরি করতে চায়।’
মোহম্মদ রেজাউল করীম বলেন, ‘একটি সুবিধাভোগী মহল সাধারণ মুসলিম জনতার উত্থাপিত মতামতকে কেন্দ্র করে দেশে লম্ফ-ঝম্ফ, হুমকি-ধমকি দিয়ে বিশৃঙ্খলা তৈরির অপচেষ্টা করছে। তাদের পেছনে বাংলাদেশের অর্জন, উন্নয়ন, সামাজিক সম্প্রীতি ও স্থিতিশীলতা বিনাশে কর্মরত কিছু দেশি-বিদেশি চক্রেরও ইন্ধন রয়েছে বলে ধারণা করছি।’
তিনি বলেন, ‘স্বপ্নের পদ্মাসেতু প্রকল্পের ঢাকা কেন্দ্রের প্রবেশ দ্বারে বঙ্গবন্ধুকে স্মরণ করে স্থাপিত হতে যাওয়া ভাস্কর্য নিয়ে ইমাম, মুসল্লি ও তৌহিদী জনতার আপত্তির কারণ হচ্ছে- এটি ৫/৭টি মসজিদ মাদরাসার মিলন মোহনা এবং দু’টি মসজিদের অবকাঠামো ভেঙে এই পয়েন্টে ভাস্কর্য স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তারপরও স্থানীয় ইমাম মুসল্লি ও তৌহিদী জনতা সেখানে ভাস্কর্যের বদলে বিকল্প কোনো উত্তম পন্থায় বঙ্গবন্ধুকে স্মরণীয় করে রাখার দাবি জানিয়েছে।’
রেজাউল করীম বলেন, ‘সরকারের বিদ্যমান আইন কানুন মেনেই তৌহিদী জনতা সমাবেশ করেছে এবং সেখানে শালীন ভাষাতেই যৌক্তিকভাবে মানবভাস্কর্য বিষয়ে বক্তব্য তুলে ধরা হয়েছে। সেইসঙ্গে বঙ্গবন্ধুকে সম্মান জানানোর বিকল্প পন্থাও প্রস্তাব করা হয়েছে। বিষয়টি একেবারেই স্বাভাবিক একটি নাগরিক প্রতিক্রিয়া। কিন্তু একটি সুবিধাভোগী মহল এটিকে কেন্দ্র করে দেশে চরম উস্কানি ও উত্তেজনা তৈরি করছে।’
তিনি বলেন, ‘সরকার যেখানে প্রতিবাদ সমাবেশের অনুমতি দিয়ে যৌক্তিক আলোচনা ও মতামতের পরিবেশ সংযমের সাথে বজায় রেখেছে সেখানে জনবিচ্ছিন্ন সুবিধাভোগী শ্রেণিটি উলামায়ে কেরামকে সন্ত্রাসী ভাষায় গালিগালাজ করছে, ঢালাওভাবে অপবাদ দিচ্ছে। মাহফিলের মতো ধর্মীয় সংস্কৃতিকে উগ্রপন্থায় প্রতিহত করার ঘোষণা ও রাজপথে সন্ত্রাসী কায়দায় উগ্র বক্তব্য ও স্লোগান দিচ্ছে। যা অত্যন্ত দুঃখজনক ও উদ্বেগের বিষয়। আইন অমান্য করে সন্ত্রাসী কায়দায় প্রকাশ্যে আলেম সমাজকে মারধর, অপমান, এমনকি তাদের প্রাণনাশের হুমকি দিচ্ছে।’
‘এহেন পরিস্থিতিতে আমরা পরিষ্কার করে জানাচ্ছি যে, উলামায়ে কেরামের দাবির মধ্যে স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধুর প্রতি কোনো বিদ্বেষ ছিল না, অসম্মানও ছিল না। বরং বিষয়টি ছিল দেশের প্রায় ৯২ শতাংশ জনগণের বোধ-বিশ্বাসের সঙ্গে সাংঘর্ষিক মূর্তি স্থাপন না করে অন্য কোনো পন্থায় তাকে স্মরণ করার। আলেম সমাজ ও সাধারণ ধর্মপপ্রাণ জনগণ এ ক্ষেত্রে সরকারের কাছে নিজেদের প্রাণের আকুতি তুলে ধরতেই পারে। এই যৌক্তিক দাবিকে কেন্দ্র করেই তারা তাদের দীর্ঘদিনের লালিত মূর্তি প্রীতি ও বিজাতীয় চেতনার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছে। বিষয়টিকে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করে দেশের সর্বজন শ্রদ্ধেয় উলামায়ে কেরামকে অপদস্থ করার হাতিয়ার হিসেবে গ্রহণ করেছে। এসব কোনো দেশপ্রেমিক মানুষের কাজ হতে পারে না’— সৈয়দ রেজাউল করীম।
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে আজ ৫০ বছর হতে চলছে। ঐক্যবদ্ধ এই জাতি মাত্র নয় মাসে দেশটাকে স্বাধীন করেছে। এখানকার মানুষের ভাষা-সংস্কৃতি-ধর্মও প্রায় এক। এমন ঐক্যবদ্ধতা যেকোনো জাতির জন্যই গর্বের। কিন্তু আমরা দুঃখের সঙ্গে লক্ষ্য করছি, একটি মহল জনতার এই ঐক্যকে ছিন্নভিন্ন করতে চায়।’
ইসলামী আন্দোলনের আমীর বলেন, ‘ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা ও তার পরিবার ১৯৭১ সালে একনিষ্ঠভাবে মুক্তি সংগ্রামের সহযোগী ছিলেন। তার দরবার ছিল এলাকার সকল ধর্ম-বর্ণের মানুষের আশ্রয়স্থল। বিষয়টি এলাকার মুক্তিযোদ্ধাদের মাঝে সর্বজনবিদিত। যারা এ বিষয়ে বিতর্ক তৈরি করছে, তারা মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে তামাশায় পরিণত করছে। আমরা এর তীব্র প্রতিবাদ ও নিন্দা জানাই।’
তিনি বলেন, ‘ভাস্কর্য ও মূর্তি ইস্যুতে চরম উসকানির মুখেও দেশের শান্তি ও স্থিতিশিলতা বজায় রাখার স্বার্থে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ সীমাহীন ধৈর্য্যের পরিচয় দিয়ে এসেছে। কিন্তু এরই মাঝে গতকাল মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ নামের একটি ভূঁইফোড় সংগঠন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের সিনিয়র নায়েবে আমির মুফতী সৈয়দ মুহাম্মাদ ফয়জুল করীমের নামে একটি জঘন্য মিথ্যা মামলা দায়ের করেছে। সঙ্গে আরও দুজন বিশিষ্ট আলেম জুনায়েদ বাবুনগরী ও মাওলানা মামুনুল হকের নামেও মিথ্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে। বিষয়টিকে রাজনৈতিক ইস্যু মনে করিনি। যে কারণে ধৈর্য্যের সঙ্গে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করেছি মাত্র।’
সৈয়দ রেজাউল করীম বলেন, ‘উগ্রবাদী শক্তি ও তাদের উশৃঙ্খল সহযোগীরা আমাদের নীরবতাকে দুর্বলতা ভেবেছে। আমি সরকারকে এসব অন্যায় সীমালঙ্ঘনকারীদের নিবৃত করতে অনু্রোধ জানাই। এদেশের ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা আজ ঐক্যবদ্ধ। শান্তিপ্রিয় ধর্মপ্রাণ মানুষের ধৈর্য্যেরও একটা সীমা আছে। আমরা অনেক অপমান সহ্য করেছি। সরকার যদি তাদের সুবিধাভোগী উগ্র সমর্থক এবং দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারী শক্তিগুলোর বাড়াবাড়ি ও উসকানিমূলক কর্মকাণ্ড বন্ধ করতে ব্যর্থ হয়, তাহলে দেশপ্রেমিক জনতা ও ধর্মপ্রাণ মানুষ তাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে বাধ্য হবে।’
এক প্রশ্নের জবাবে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের নায়েবে আমীর মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ ফয়জুল করীম বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর ছিলেন একজন মুমিন মুসলমান। ইসলামের জন্য তিনি অনেক কিছু করেছেন। তার বাবা-দাদার মুখে ছিল দাঁড়ি-টুপি। তাদের পূর্বপুরুষেরা পারস্য থেকে এ দেশে এসেছিলেন ইসলাম প্রচারের জন্য। সুতরাং তাদের অসম্মান-অশ্রদ্ধা জানানো আমাদের কাজ নয়। আমরা কেবল কোরআন-হাদিসের আলোকে মূর্তির বিরোধিতা করেছি।’
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন দলের নায়েবে আমীর মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ ফয়জুল করীম শায়খে চরমোনাই, প্রেসিডিয়াম সদস্য অধ্যক্ষ মাওলানা সৈয়দ মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল-মাদানী ও আলহাজ্ব খন্দকার গোলাম মাওলা, রাজনৈতিক উপদেষ্টা অধ্যাপক আশরাফ আলী আকন, যুগ্ম মহাসচিব অধ্যাপক মাহবুবুর রহমান ও মাওলানা গাজী আতাউর রহমান, আলহাজ্ব আমিনুল ইসলাম, মাওলানা ইমতিয়াজ আলম, ইঞ্জিনিয়ার আশরাফুল আলম, কেএম আতিকুর রহমান, আহমদ আবদুল কাইয়ূম, মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাকী, মাওলানা নেছার উদ্দিন, বরকত উল্লাহ লতিফ, বীর মুক্তিযোদ্ধা আবুল কাশেম, জিএম রুহুল আমীন, মাওলানা খলিলুর রহমান, অ্যাডভোকেট একেএম এরফান খান, ছাত্রনেতা এম হাছিবুল ইসলাম, নুরুল করীম আকরাম, অ্যাডভোকেট আবদুল বাসেত, শ্রমিক আন্দোলন নেতা শহিদুল ইসলাম কবির, যুবনেতা ইলিয়াস হাসান প্রমুখ।