Sunday 08 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

বিলুপ্তির পথে পলো দিয়ে মাছ ধরা উৎসব


১০ ডিসেম্বর ২০২০ ১০:৪৩

নেত্রকোনা: বিলুপ্তির পথে এক সময়ের চিরচেনা গ্রামবাংলার জনপ্রিয় ‘পলো’ দিয়ে মাছ ধরার উৎসব। তলাবিহীন কলসির আদলে বাঁশ ও বেতের সংমিশ্রণে ছোট ছোট ছিদ্র রেখে শৈল্পিকভাবে মাছ ধরার এই যন্ত্রটি তৈরি করা হয়।

আহবমানন বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলের মতো নেত্রকোনার হাওর অঞ্চলেও অন্যতম উৎসব পলো দিয়ে মাছ ধরা। শীতের শুরুতেই শুরু হত এই উৎসব। অন্যান্য অঞ্চলের মত মোহনগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে বিলে গ্রামবাসী ঐক্যবদ্ধ হয়ে পল দিয়ে মাছ ধরার উৎসবের আয়োজন করত। এ সময় হরিদাখলসী গ্রামসহ আশেপাশের ইউনিয়নের প্রত্যন্ত এলাকার প্রায় শতাধিক মানুষ উৎসবে মেতে উঠত। কুড়িল বিলে পলসহ বিভিন্ন উপকরণ দিয়ে দল বেঁধে মাছ ধরার দৃশ্য ছিল দেখার মতো।

পরনের লুঙ্গি আটঘাট করে ‘কাছা’ দিয়ে বিলের এক প্রান্ত থেকে সকলে একইসঙ্গে লাইন ধরে নান্দনিক ছন্দে ঝপ ঝপাঝপ শব্দে পলো দিয়ে মাছ ধরা শুরু হতো। সারিবদ্ধভাবে এগিয়ে যেতে থাকতো সামনের দিকে। অনেকেরই মাথায় থাকতো গামছা বাঁধা। চলে পলো দিয়ে পানিতে একের পর এক চাপ দেওয়া আর হৈ হুল্লোড় করে সামনের দিকে অঘোষিত ছন্দের তালে তালে এগিয়ে যাওয়া। যেন এক নিজস্ব চিরচেনা গ্রামবাংলার অপরূপ সৌন্দর্যময় দৃশ্য।

দলবদ্ধভাবে মাছ শিকারের এ দৃশ্য দেখতে বিলের দুই তীরে ভিড় জমায় উৎসুক হাজারো মানুষ। উৎসবে অংশ নেওয়া লোকদের হাততালি দিয়ে উৎসাহ দেন তীরে অবস্থানরত জনতা।

প্রবীণ মাছ শিকারি আলী বলেন, বছরের এই দিনের জন্য অধীর আগ্রহে থাকি। সবাই মিলে একসঙ্গে মাছ ধরার আনন্দটাই আলাদা। দিন দিন পরিবেশ ও আবহাওয়ার কারণে নদী-নালা, খাল-বিল, ভরাট হয়ে যাওয়ায় পানি হ্রাস এবং অধিকাংশ জলাশয় ইজারা দেয়ায় পলই বাওয়া উৎসব এখন অনেকটাই ভাটা পড়েছে। এছাড়া অভাব-অনটন ক্রমশ গ্রাস করে ফেলছে চিরাচরিত এই গ্রামীণ উৎসবের অতীত ঐতিহ্যকে।

আগে প্রত্যেক গৃহস্থের বাড়িতেই থাকতো দু-একটি পলো। পলো মাছ ধরার কাজ ছাড়াও হাঁস-মুরগী ধরে রাখার কাজেও ব্যবহার হতো। শুকনো মৌসুমে বিশেষ করে পৌষ মাস থেকে শুরু করে চৈত্র মাস পর্যন্ত শুরু হয়ে যেত পলো দিয়ে মাছ ধরার মহড়া। মাছ পড়লেই পলোর ভেতর নাড়া দেয়। এতে বুঝা যায় শিকার এবার হাতের মুঠোয়। তখন পলোটিকে কাদা মাটির সাথে ভালোভাবে চাপ দিয়ে ধরে রাখা হয়, যাতে নিচের কোন দিকে ফাঁক না থাকে। এরপর ওপরের খোলা মুখ দিয়ে হাত ঢুকিয়ে মনের আনন্দে ধরে আনা হতো সেই শিকার।

পুরনো মাছ শিকারিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, পলোয় সাধারণত দেশি মাছই বেশি ধরা পরে। রুই, কাতলা, মৃগেল, চিতল, আইড়, কালিবাউস, বোয়াল, শোল, চিতল, টাকি ও গজার প্রভৃতি মাছও ধরা পড়তো। মাছ দিয়ে মালার মতো তৈরি করে কাঁধে ঝুলিয়ে খুশিতে বাগবাগ হয়ে বাড়ি ফিরতেন।

চাষী পলাশ, সুমন বলেন, বর্তমানে অনেক খাল বিল ও উন্মুক্ত জলাশয় ভরাট কিংবা বিলুপ্ত হয়ে গেছে। বিভিন্ন নদী-নালা হাওর-বাওর খাল-বিল ভরাট করে গড়ে উঠেছে বসত বাড়ি ও বাজার। কোথাও কোথাও কিছুটা জলাশয় থাকলেও আগের মতো মাছ পাওয়া যায়না এবং আগের অনেক প্রজাতির মাছ বর্তমানে বিলুপ্ত প্রায়। বর্তমানে যেটুকু অবশিষ্ট আছে এর বেশির ভাগের অস্তিত্ব হুমকির মুখে। সে দিন বেশি দূরে নয় হয়তো উন্মুক্ত জলাশয়ে পলো দিয়ে মাছ ধরা শুধু স্মৃতি হয়েই রবে।

এ বিষয়ে মো. জাহাঙ্গীর আলম শাহ বলেন, পলো ছাড়া ও সাকই, ঠ্যালা জাল, হারকি, খলসুন, চ্যাই, ডাকুন, নলসহ বিভিন্ন সরঞ্জাম রয়েছে। ঐতিহ্য সংরক্ষণ ও গবেষনার জন্য বিভিন্ন স্থানে তথ্য সংগ্রহশালা গড়ে তোলা প্রয়োজন।

পলো দিয়ে মাছ ধরা


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর