বিস্ময়-বৈচিত্র্যে অনন্য পদ্মাসেতু
১০ ডিসেম্বর ২০২০ ১১:৫৩
পদ্মাসেতু প্রকল্প এলাকা থেকে: শেষ স্প্যানটি বসানোর কাজ প্রায় শেষ। এখন পূর্ণাঙ্গ দৈর্ঘ্য নিয়ে অনেকটাই দৃশ্যমান পদ্মাসেতু। দেশের দক্ষিণাঞ্চল তো বটেই, সারাদেশের মানুষের স্বপ্নই যেন মাথা তুলে দাঁড়িয়ে গেছে প্রমত্ত পদ্মার বুকে। না, সেতুটি এখনই উন্মুক্ত হচ্ছে না যানচলাচলের জন্য। তবে সেতু উন্মুক্ত হওয়ার জন্য মূল যে কাঠামোটি প্রয়োজন, সেই কাঠামোটিই এখন প্রায় সম্পূর্ণ রূপ পেয়েছে।
দীর্ঘ তিন বছর তিন মাস ধরে পদ্মায় বসেছে এই ৪১টি স্প্যান। এরও প্রায় দেড় বছর আগে থেকে শুরু হয়েছে পাইলিং। ছয় দশমিক ১৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের একটি সেতুর কাঠামো গড়তে যে এই দীর্ঘ পাঁচ বছর সময় লেগেছে, তার পেছনেও রয়েছে কারণ। কারণ পদ্মাকে বাগে এনে এর বুকে একটি সেতুকে দাঁড় করানোই ছিল বড় চ্যালেঞ্জ। সেই চ্যালেঞ্জের কারণে দেশের ইতিহাসের বৃহত্তম, এমনকি সমসাময়িক বিশ্বের অন্যতম বড় এই অবকাঠামো নির্মাণে ব্যয় হয় দীর্ঘ সময়।
গবেষকরা বলেন, বিশ্বের সবচেয়ে খরস্রোতা নদীগুলো হিসেবে বিবেচনা করা হয় অ্যামাজনকে। আর খরস্রোতা হিসেবে তার পরের স্থানটিই পদ্মা নদীর। এমন একটি নদীর বুকে সেতু গড়ে তোলার ধারণাটিই ছিল বিস্ময়কর। কেননা পদ্মার নদীগর্ভের মাটি এতটাই পরিবর্তনশীল যে মুহূর্তের মধ্যে যেকোনো স্থান থেকে যে পরিমাণ মাটি সরে যায়, তাতে করে ২১ তলা ভবনের যে উচ্চতা সেই উচ্চতার সমপরিমাণ গভীরতার খাদ তৈরি হয়ে যায়।
এমন একটি স্থানে পাইলিংয়ের মাধ্যমে খুঁটি স্থাপনের মতো বিশাল এক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়েছে পদ্মাসেতুর সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীদের। সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে গিয়ে প্রচলিত ধারার পদ্ধতিগুলো আসেনি কাজে। বিশেষ পদ্ধতিতেই শেষ পর্যন্ত পাইলিং করতে হয়েছে এই সেতুর জন্য। ছয় দশমিক ১৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের পদ্মাসেতু গড়তে গিয়ে এমন অনেক বিস্ময়কর বৈচিত্র্য ও অনন্য অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হয়েছে দেশি-বিদেশি প্রকৌশলীদের।
সেসব প্রকৌশলীদের দেওয়া তথ্য থেকে জানা যায়, নদীর পানির প্রায় ৪০ মিটার বা প্রায় ১৩১ ফুট গভীরে গেলে পাওয়া যায় তলদেশ। সাধারণত কোনো ভবনের একেকটি তলার উচ্চতা হয় ১০ ফুট। সে হিসাবে পদ্মার তলদেশ থেকে উপরিতল পর্যন্ত উচ্চতা একটি ১৩ তলা ভবনের সমান। আর নদী তলদেশে হঠাৎ খরস্রোতে মাটি আরও ৬০ থেকে ৬৫ মিটার সরে গিয়ে তৈরি হয় গভীর খাদ। সেই খাদের গভীরতাই দাঁড়ায় ২০০ ফুটের বেশি, যা একটি ২০ তলা ভবনের উচ্চতার সমান।
পদ্মাসেতুর আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী প্যানেলের প্রধান হিসেবে আমৃত্যু দায়িত্ব পালন করে গেছেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন প্রকৌশলী ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী। জীবদ্দশাতেই তার সঙ্গে পদ্মাসেতু নিয়ে একাধিকবার কথা হয়েছে সারাবাংলার। ড. জামিলুর জানিয়েছিলেন, পদ্মা নদীর পানির উপরিতল থেকে শুরু করে সেই খাদ পর্যন্ত সম্পূর্ণ গভীরতাটি দাঁড়ায় শেষ পর্যন্ত ৩৪০ ফুটেরও বেশি, অর্থাৎ প্রায় ৩৪ তলা উচ্চতার একটি ভবনের সমান। সেই গভীরতায় পাইলিংয়ের কাজ করার চ্যালেঞ্জটি ছিল প্রকৌশলীদের জন্য। সবকিছু মিলিয়ে প্রকৌশলীদের অঙ্ক কষে শেষ পর্যন্ত পদ্মাসেতুর পাইলিংকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে ১২৮ মিটার গভীরতায়, যা ফুটের হিসাবে ৪২০ ফুট। অর্থাৎ পদ্মাসেতুর একেকটি খুঁটির উচ্চতা ৪২ তলা ভবনের সমান। অর্থাৎ ধূসর রঙে যে পদ্মাসেতু দাঁড়িয়ে গেছে, তার তলদেশে এই ৪২ তলা উচ্চতার ভবন সমান কাঠামো রয়েছে।
ড. জামিলুরের দেওয়া তথ্য— পদ্মা নদীর শুধু মাওয়া পয়েন্টে মাত্র ২০ সেকেন্ডে যে পানি প্রবাহিত হয়, তা রাজধানী ঢাকার দেড় কোটি মানুষের সারাদিনের প্রয়োজনীয় পানির সমান। হিসাব বলছে, পদ্মা নদীতে পানিপ্রবাহের গতি সেকেন্ডে ১ লাখ ৪০ হাজার ঘনমিটার। সেকেন্ডে এর চেয়ে বেশি পানি প্রবাহিত হয় কেবল অ্যামাজন নদীতে।
এরকম খরস্রোতা নদীতে বসানো খুঁটি বা পিলারের (পিয়ার) শক্তিমত্তাও গড়ে তোলা হয়েছে সেভাবেই। প্রতিটি পাইলের লোড ৮ হাজার ২০০ টন, আর প্রতিটি পিলার (পিয়ার) লোড ৫০ হাজার টনের। পৃথিবীর অন্য কোনো সেতুর খুঁটিতে এত লোড দেওয়া হয়নি।
এদিকে, এরকম ভারী লোড দেওয়া এসব পাইল নদীগর্ভে নিয়ে যাওয়ার জন্য যেরকম শক্তিশালী হ্যামার প্রয়োজন, তা পৃথিবীতে এর আগে কখনোই ছিল না। ৪০০ কোটি টাকা দিয়ে নেদারল্যান্ডসের একটি কোম্পানি থেকে বিশেষ অর্ডারের মাধ্যমে জার্মান প্রযুক্তির এই হ্যামার তৈরি করে আনতে হয়েছে। এরকম মোট পাঁচটি হ্যামার ববহৃত হয়েছে পদ্মাসেতু গড়তে।
কেবল যন্ত্রপাতি নয়, পদ্মাসেতু গড়তে গিয়ে অন্য আরও যেসব উপকরণ ব্যবহার করতে হয়েছে, সেগুলোও অনন্য বলা চলে। পদ্মাসেতু তৈরিতে যে পাথর ব্যবহৃত হচ্ছে, তার একেকটির ওজন এক টন! এই পাথর ভারতের ঝাড়খণ্ড রাজ্যের পাকুর নামক স্থান থেকে আমদানি করে আনা হয়েছে। এসব পাথর এত ভারি যে একটি ট্রাকে করে আনা যায় মাত্র ১৫টি টুকরো।
পদ্মাসেতু নির্মাণে যে ওয়ার্কশপ ব্যবহৃত হয়েছে, এটিও বিশ্বের সবচেয়ে বড় নির্মাণ ওয়ার্কশপ। এর আগে কোনো সেতু তৈরিতে এত বড় কর্মযজ্ঞ প্রয়োজন হয়নি। এখানে অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি দিয়ে রিমোট কন্ট্রোল পদ্ধতিতে ভারি বস্তু ওঠানামা করানো হয়। পদ্মার পাড়ে মুন্সীগঞ্জের মাওয়া প্রান্তে অবস্থিত এই এই পাইল ও স্প্যান ফেব্রিকেশন ইয়ার্ড (ওয়ার্কশপ)। সেখানেই তৈরি হয়েছে সেতুর একের পর এক পাইল আর স্প্যান। এই ইয়ার্ডের আয়তন ৩০০ একর।
এদিকে, পদ্মায় আজ বসলো ৪১তম স্প্যান। প্রায় সাড়ে তিন বছর ধরে এই যে স্প্যানগুলো একের পর এক বসছে, তার একেকটির দৈর্ঘ্য ১৫০ মিটার। আর এসব স্প্যানের একেকটির ওজন দুই হাজার আটশ টন! এরকম একটি স্প্যান বহন করার জন্য যে ক্রেনের প্রয়োজন, সেটিও দশাসই আকৃতির বটেই। তার ধারণক্ষমতা তিন হাজার ৬০০ টন।
এরকম বৈচিত্র্যময় আর বিস্ময়কর সব যন্ত্রপাতি আর উপকরণে আজ দৃশ্যমান হচ্ছে পূর্ণাঙ্গ পদ্মাসেতু। সরকারের পরিকল্পনা অনুযায়ী আর বছরখানেকের মধ্যেই স্বপ্নের এই সেতুটি খুলে দেওয়া সম্ভব হবে সাধারণ মানুষের জন্য।
৪১টি স্প্যান ৪২ তলা ভবন ৪২টি খুঁটি নদীর গভীরতা পদ্মাসেতু পাইলিং পানিপ্রবাহ প্রমত্ত পদ্মা বৃহত্তম অবকাঠামো স্প্যান