হয়নি বুদ্ধিজীবীর সংজ্ঞা নির্ধারণ, তালিকা প্রকাশে দীর্ঘসূত্রিতা!
১৪ ডিসেম্বর ২০২০ ২১:০০
ঢাকা: মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসের সশস্ত্র সংগ্রামের সময় পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও তাদের দোসররা যে গণহত্যা ও নৃশংসতা চালিয়েছিল তা ইতিহাসে নজিরবিহীন। ডিসেম্বরের শেষদিকে এসে পরাজয় নিশ্চিত জেনে পাকিস্তান হানাদারবাহিনী পরিকল্পনা করে জাতির সূর্য-সন্তানদের হত্যা করার। স্বাধীনতার ঊষালগ্নে হত্যা করা হয় দেশ বিনির্মাণে ভূমিকা রাখতে পারেন এমন চিকিৎসক, লেখক, শিক্ষক, সাংবাদিক, শিক্ষাবিদ, প্রকৌশলীসহ নানা শ্রেণিপেশার বুদ্ধিজীবীদের।
২০২১ সালের ২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্ণ হবে। সম্প্রতি দেশে শহিদ বুদ্ধিজীবীদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা করার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। ১৯ নভেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবীদের তালিকা প্রণয়নের জন্য যাচাই-বাছাই কমিটি গঠন করা হয়। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব তপন কান্তি ঘোষকে এ কমিটির সভাপতি করা হয়েছে। কমিটিতে সদস্য হিসেবে রয়েছেন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. শহীদুল হক ভূঁঞা। কমিটিতে সদস্য সচিব হিসেবে রয়েছেন উপ-সচিব রথীন্দ্র নাথ দত্ত।
কমিটিতে গবেষক সদস্যদের মধ্যে রয়েছেন- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের সাবেক অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন, ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মেজবাহ কামাল, গণহত্যা-নির্যাতন আর্কাইভ ও জাদুঘরের ট্রাস্টি চৌধুরী শহীদ কাদের, জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের (নিপসম) পরিচালক বায়েজিদ খুরশীদ রিয়াজ এবং গণহত্যা-নির্যাতন আর্কাইভ ও জাদুঘরের গবেষক গাজী সালাউদ্দিন। এই কমিটিতে বীর মুক্তিযোদ্ধা সদস্যদের মধ্যে রয়েছেন- চলচ্চিত্র নির্মাতা ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব বীর মুক্তিযোদ্ধা নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু, বীর মুক্তিযোদ্ধা ও গবেষক লে. কর্নেল কাজী সাজ্জাদ জহির (বীরপ্রতীক)।
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ১৩ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবীদের তালিকা প্রণয়নের জন্য করা যাচাই-বাছাই কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে বুদ্ধিজীবী সংজ্ঞার পূর্ণাঙ্গ ব্যাখ্যা নিয়ে প্রাথমিকভাবে আলোচনা হয়। এ বিষয়ে পরবর্তী বৈঠকে সিদ্ধান্ত আসতে পারে। মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বুদ্ধিজীবীদের আলাদাভাবে স্বীকৃতির পাশাপাশি তাদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া নিয়েও আলোচনা হয়েছে।
শহীদ বুদ্ধিজীবীদের তালিকা প্রণয়নের জন্য যাচাই-বাছাই কমিটির গবেষক সদস্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মেজবাহ কামাল সারাবাংলাকে বলেন, ‘বুদ্ধিজীবী যারা শহিদ হয়েছেন তাদের অনেকেই গণহত্যার শিকার। কিন্তু সারাবছর ধরেই কিন্তু দেশের বিভিন্ন স্থানে বুদ্ধিজীবীদের টার্গেট করে হত্যা করা হয়েছে। আমাদের দেশকে মেধাশূন্য করার প্রচেষ্টা নানাভাবে অব্যাহত ছিল। এক্ষেত্রে যারা সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন তারা তো টার্গেট হয়েছেন-ই, একইসঙ্গে যারা স্বাধীন বাংলাদেশে বুদ্ধিজীবী হিসেবে দেশ ও জাতি গঠনে ভূমিকা রাখতে পারতেন তাদেরও টার্গেট করা হয়।’
তিনি বলেন, ‘স্থানীয় পর্যায়ে স্বাধীনতার চেতনা নির্মাণের পাশাপাশি যারা ভাষা-সংস্কৃতি লালনের ক্ষেত্রে কাজ করেছেন বা ভূমিকা রেখেছেন এরকম মানুষগুলোই কিন্তু বুদ্ধিজীবী। এটা বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে হতে পারে। তাই সকলকেই এই তালিকাভুক্ত করতে হবে। বুদ্ধিজীবীর সংজ্ঞাটা নিরূপন করার জন্য বৈঠকে আলোচনা হয়েছে। আগামী বৈঠকে হয়তোবা এ নিয়ে কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছা যাবে।’
অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন সারাবাংলাকে বলেন, ‘বিভিন্ন বুদ্ধিজীবী কোষ, ডাকটিকিটসহ বিভিন্ন সরকারি তালিকায় বুদ্ধিজীবীদের নাম আছে। এই নাম কম থাকতে পারে। তবে সেটি অন্য বিষয়। বর্তমানে মন্ত্রণালয় বুদ্ধিজীবীদের তালিকা প্রকাশের উদ্যোগ নিয়েছে। সেকারণে আমরা বৈঠক করেছি। বুদ্ধিজীবীর মোটামুটি একটি সংজ্ঞা তৈরি করা যায় কি-না সেটি নিয়ে বৈঠকে আলোচনা হয়েছে। আগামী বৈঠকে সেটি নির্ধারণ করা হবে। তবে প্রাথমিক পর্যায়ে সরকার এক হাজার ২২২ জনের যে তালিকা করেছে আমরা মনে করি, সেটি ঠিক থাকবে। আমরা সকলের কাছে নাম পাঠাতে আবেদন জানাব। সেগুলো যাচাই-বাছাই হবে। এক্ষেত্রে কিছুটা সময় তো লাগবেই। তবে এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া। যেহেতু এটি শুরু হয়েছে তাই একে আমি ইতিবাচকভাবে দেখি।’
বুদ্ধিজীবীদের তালিকা প্রণয়ন বিষয়ে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির সারাবাংলাকে বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর সময় থেকে বুদ্ধিজীবীদের তালিকা তৈরির প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল। সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে করা গবেষণাগুলো আমাদের সংগ্রহে আনতে হবে। সরকারি তালিকা মন্ত্রণালয়ে আছে। বেসরকারি পর্যায়ে অনেকগুলো কাজ হয়েছে। সেই তালিকাগুলো হাতে পেতে হবে।’
বুদ্ধিজীবীদের সংজ্ঞা বিষয়ে তিনি বলেন, ‘প্রাথমিকভাবে যে এক হাজার ২২২ জনের নাম আছে সেগুলো হয়তো গেজেট আকারে প্রকাশ করবে সরকার। কিন্তু এর বাইরেও যারা স্থানীয় পর্যায়ে বিভিন্নভাবে ভূমিকা রেখেছেন তাদের নামও অন্তর্ভুক্ত করা হবে। এক্ষেত্রে বুদ্ধিজীবী সংজ্ঞা নিয়ে কাজ করা হচ্ছে। যেমন- শহিদ আলতাম মাহমুদ কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিলেন। আবার দেখা গেছে, দেশে একটা সময় ইতিহাস বিকৃতি করে বলা হয়েছে, জহির রায়হানকে আওয়ামী লীগ হত্যা করেছে। তাই জহির রায়হানকে বিএনপি-জামায়াত সরকার কোনো তালিকায় রাখেনি। কারণ তিনি ১৬ই ডিসেম্বরের পর শহীদ হন। মিরপুর মুক্ত দিবস অন্তর্ভুক্ত না করলে জহির রায়হান সেখানে থাকেন না। এটা তো বাস্তব যে, ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত মিরপুর শত্রু কবলিত ছিল। মিরপুর ছিল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের শেষ রণাঙ্গন। এছাড়াও দেখা গেছে, মুজিববাহিনী, হেমায়েত বাহিনীর অনেক সদস্যের মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতি নেই এখনও। তার মানে কী তারা মুক্তিযোদ্ধা না? বিষয়টা কিন্তু মোটেও তা নয়।’
তিনি বলেন, ‘আমরা প্রাথমিকভাবে বুদ্ধিজীবীদের তালিকা নিয়ে কাজ করব। এর পর আমরা সেখান থেকে কারা কীভাবে মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি ভূমিকা রেখেছে তাদের আলাদা করব। এভাবে কাজ করলে কিছুটা সহজ হবে সবার জন্য।’
শাহরিয়ার কবির বলেন, ‘বুদ্ধিজীবীদের তালিকা প্রকাশ আমলানির্ভর কাজ হবে না, যেভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা করা হয়েছিল। জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে যারা গবেষণা করেছেন, আঞ্চলিক ইতিহাস লিখেছেন, আমরা সবার সহযোগিতা নেবো। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ডকুমেন্ট, বাংলা একাডেমির বুদ্ধিজীবী কোষ, বাংলাপিডিয়া, ডাক বিভাগ ছাড়াও বাইরে যেসব তালিকা আছে সেগুলোও হিসেবে নেবো আমরা।’
শহিদ বুদ্ধিজীবী শহীদুল্লাহ কায়সারের সন্তান শমী কায়সার সারাবাংলাকে বলেন, ‘বুদ্ধিজীবীদের তালিকা কিন্তু বঙ্গবন্ধুর সময়েই ছিল। কিন্তু পরবর্তী সময়ে এটি আর গেজেট আকারে প্রকাশ করা হয়নি। আগে বুদ্ধিজীবীর সংজ্ঞা ঠিক করা দরকার। যেমন- শহিদ আলতাফ মাহমুদ কিন্তু বুদ্ধিজীবী তালিকায় ছিলেন না। একইভাবে ছিলেন না জহির রায়হানও। কিন্তু উনাদের অবদান তো অস্বীকার করা যাবে না। কেউ মেধা দিয়ে দেশের মুক্তিযুদ্ধে ভূমিকা রেখেছেন, আবার কেউ বর্ডার পার হলেও ক্যাম্পে বিভিন্নভাবে সাহায্য করেছেন। এসব কিছু বিবেচনায় রেখে বুদ্ধিজীবীর সংজ্ঞা নির্ধারণ করা উচিত।’
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক সারাবাংলাকে বলেন, ‘এই মাসের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রকাশ করা সম্ভব হবে না, সময় লাগবে। আজ প্রাথমিকভাবে এক হাজার ২২২ জন শহিদ বুদ্ধিজীবীর একটি তালিকা অনুমোদন করা হয়েছে। শহীদ বুদ্ধিজীবীদের তালিকা প্রণয়নে গঠিত কমিটির প্রথম সভায় এ তালিকা অনুমোদন দেওয়া হয়। আগামী সভায় কারা শহীদ বুদ্ধিজীবী হিসেবে স্বীকৃতি পাবেন সেই সংজ্ঞা লিখিত আকারে উপস্থাপন হওয়ার পর সেটিও অনুমোদন দেওয়া হবে। এ বিষয়ে আলোচনা করে আউটলাইন ঠিক করা হবে। এটি নিয়ে সাব কমিটি করে দেওয়া হয়েছে। পরবর্তী সময়ে সেই সংজ্ঞা অনুযায়ী আবেদনপত্রগুলো যাচাই-বাছাই করা হবে। এসব কাজে হয়তোবা কয়েক মাস সময় লাগতে পারে।’
তিনি বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের পর ১৯৭২ সালে প্রাথমিকভাবে এক হাজার ৭০ জন শহীদ বুদ্ধিজীবীর একটি তালিকা হয়েছিল। পরে ডাক বিভাগ আরও ১৫২ জন শহীদের ডাকটিকিট প্রকাশ করে। সব মিলিয়ে আমরা মোট এক হাজার ২২২ জনের তালিকা অনুমোদন দিয়েছি। ভবিষ্যতে হয়তো আরও আবেদন আসবে, সেখান থেকে বুদ্ধিজীবীর সংজ্ঞার সঙ্গে তুলনা করে যাচাই-বাছাই করে অনুমোদন দেওয়া হবে। এক্ষেত্রে যাচাই-বাছাই কীভাবে করা হবে সেটি নিয়েও আলোচনা হবে। এছাড়া আমাদের বর্তমান কমিটি বাদে জেলা-উপজেলাভিত্তিক কমিটির প্রয়োজন হতে পারে। যেগুলো নিয়ে পরবর্তী বৈঠকে আলোচনা হবে।’
আলবদর তালিকা দীর্ঘসূত্রিতা পাকবাহিনী বুদ্ধিজীবী হত্যা মুক্তিযুদ্ধ সংজ্ঞা নির্ধারণ