Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

‘চট্টলবীর’ ছাড়া চট্টলার ৩ বছর


১৫ ডিসেম্বর ২০২০ ০৮:৩০

চট্টগ্রাম ব্যুরো: সফেদ পাঞ্জাবির ওপর কালো মুজিব কোট, দিনরাত ২৪ ঘণ্টা। জীবনের দীর্ঘসময় বঙ্গবন্ধুর ভাবশিষ্য এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরীকে এমন পোশাক ছাড়া কেউ দেখেননি। বঙ্গবন্ধু আর আওয়ামী লীগ অন্তঃপ্রাণ মহিউদ্দিনকে অবশ্য চট্টগ্রামবাসী আমৃত্যু দেখেছেন আরও একরূপে— তিনি চট্টগ্রামের জন্য নিবেদিত। নেতাকর্মীর ভালোবাসার বিশেষণ ‘চট্টলবীর’ উঠে এসেছিল চট্টগ্রামের সাধারণ মানুষের মুখেও। সেই ‘চট্টলবীর’কে ছাড়া তিন বছর পার করছে চট্টগ্রাম।

বিজ্ঞাপন

বর্ষীয়ান এই রাজনীতিকের হুঙ্কার নেই, তর্জন-গর্জন নেই, নেতাকর্মীদের জন্য ভালোবাসা-শাসন নেই। ঘরের বৈঠকখানার আড্ডায় নেই, সামাজিক অনুষ্ঠানেও নেই তার উপস্থিতি। ‘চট্টলবীর’কে ছাড়া কেমন আছেন তার ভাবশিষ্যরা, কেমন আছেন চট্টগ্রামের মানুষ? প্রয়াণের তিন বছরে এসে সারাবাংলা চট্টগ্রামের বিভিন্নজনের কাছে এই বিষয়ে জানতে চেয়েছে।

একুশে পদকপ্রাপ্ত বরেণ্য শিক্ষাবিদ ড. অনুপম সেনের ছাত্র ছিলেন মহিউদ্দিন। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র থাকাকালে মহিউদ্দিনের ব্যক্তিগত উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত প্রিমিয়ার ইউনিভার্সিটির উপাচার্য হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে দায়িত্ব পালন করছেন তিনি।

অনুপম সেনের মতে, এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী জনগণের মাঝ থেকে উঠে আসা নেতা। চট্টগ্রামের দীর্ঘ রাজনৈতিক ইতিহাসে মহিউদ্দিনের চেয়ে বেশি জনগণকে ধারণ করতে পারেন— এমন নেতা নেই।

ড. অনুপম সারাবাংলাকে বলেন, ‘মহিউদ্দিন চৌধুরী ছিলেন জনগণের মাঝ থেকে গড়ে ওঠা জনগণের নেতা। উনার জীবনের দু’টো অধ্যায় আছে— একটি ছাত্র রাজনীতির পথ ধরে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ, সেখানে তিনি দুইবার মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েও ঝাঁপিয়ে পড়েছেন যুদ্ধে; অন্যটি পঁচাত্তর পরবর্তী সময়ে সামরিক স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে লড়াই-সংগ্রাম করে জনগণের নেতায় পরিণত হওয়া, যার ফলশ্রুতিতে তিনিই প্রথম চট্টগ্রামের মেয়র নির্বাচিত হন।’

তিনি বলেন, ‘মহিউদ্দিন সিটি কলেজ ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে দুই দফায় আমার ছাত্র ছিলেন। তখন তাকে আমি সেভাবে উপলব্ধি করতে পারিনি। কিন্তু ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ের পর মানুষের জন্য মহিউদ্দিন চৌধুরী যেভাবে কাজ করেছেন, সেটার পর আমি অনুধাবন করতে পারি যে চট্টগ্রামে জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা, দুঃখ-বেদনা ধারণ করার মতো একজন নেতা গড়ে উঠেছেন। মেয়র হয়ে তিনি শিক্ষা-স্বাস্থ্যখাতে যে উন্নয়ন করেছেন, সেটি দৃষ্টান্ত হয়ে আছে। মহিউদ্দিন চৌধুরী আজ নেই, কিন্তু জনগণের নেতা জনগণের মাঝে বেঁচে থাকবেন।’

বিজ্ঞাপন

এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরীর ছায়াসঙ্গী ছিলেন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের বর্তমান প্রশাসক ও নগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি খোরশেদ আলম সুজন। নগরীর আন্দরকিল্লায় পুরাতন নগর ভবনে বসতেন মেয়র মহিউদ্দিন। সোমবার (১৪ ডিসেম্বর) বাটালি হিলের নতুন কার্যালয় ছেড়ে সুজন যান পুরনো কার্যালয়ে। মহিউদ্দিনের বসার কক্ষে কিছুক্ষণ নীরবে সময় কাটান। স্মৃতি হাতড়ে আবেগাক্রান্ত হন।

খোরশেদ আলম সুজন সারাবাংলাকে বলেন, ‘এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরীর রাজনৈতিক জীবন এবং মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পরও আমি অন্তঃত ১৮ ঘণ্টা উনার সঙ্গে থাকতাম। এমন চট্টগ্রামপ্রেমী মানুষ শতাব্দীর মধ্যে আর আসবে কি না, আমি জানি না। মহিউদ্দিন ভাই চট্টগ্রামের উন্নয়নে ২৮ দফা দিয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেটাকেই উন্নয়নের রোডম্যাপ ধরে চট্টগ্রামকে এগিয়ে নিচ্ছেন। চট্টগ্রামকে বাদ দিয়ে মহিউদ্দিন চৌধুরীর ইতিহাস লেখা যাবে না, আবার মহিউদ্দিন চৌধুরীকে বাদ দিয়ে চট্টগ্রামের ইতিহাস লেখা যাবে না।’

সুজন বলেন, ‘আমি এখন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের দায়িত্বে আছি। আমার সময় কম, মাত্র ছয় মাস। আমার প্রতিটি পদক্ষেপ, প্রতিটি কাজে আমি মহিউদ্দিন ভাইকে অনুসরণ করেছি। আমার সবসময় মনে হয়, উনি আড়াল থেকে আমাকে উপদেশ-পরামর্শ, দিকনির্দেশনা দিচ্ছেন। মহিউদ্দিন ভাইয়ের শারিরী উপস্থিতি না থাকলেও ‍উনার আত্মা চট্টগ্রামজুড়ে বিরাজ করছে। আমরা মহিউদ্দিন ভাইয়ের পথ ধরেই চলব আজীবন।’

কথা হয় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. শিরীন আখতারের সঙ্গে। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘মহিউদ্দিন ভাই প্রকৃত অর্থেই চট্টগ্রামের অবিসংবাদিত নেতায় পরিণত হয়েছিলেন। উনার অভাব আমরা প্রতিক্ষণ অনুভব করি। চট্টগ্রামের অনেক উন্নয়ন হচ্ছে। চট্টগ্রাম বন্দর এগিয়ে যাচ্ছে। দেশে আরও বন্দর হচ্ছে। কিন্তু মহিউদ্দিন চৌধুরীর পরে চট্টগ্রামবাসীর কথা আরও উচ্চকণ্ঠে তোলার মতো একজন অকুতোভয় নেতা কি গড়ে উঠেছে, যিনি সাহসের সঙ্গে সত্যিটা বলতে পারেন? প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও চট্টগ্রামবাসীর মতো মহিউদ্দিন চৌধুরীকে অনুভব করেন। সেটা করেন বলেই উনার সুযোগ্য সন্তান মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলকে রাজনীতিতে এনেছেন, এমনকি মন্ত্রিসভাতেও ঠাঁই দিয়েছেন।’

মহিউদ্দিনের অনুসারী চট্টগ্রাম মহানগর যুবলীগের আহ্বায়ক মহিউদ্দীন বাচ্চু সারাবাংলাকে বলেন, ‘অনুপস্থিতির ভেতরেও মহিউদ্দিন ভাইয়ের উপস্থিতি আমরা আরও বেশি অনুভব করি। তবে আমরা স্বীকার করি বা না করি, দলের রাজনীতিতে অন্তর্গত সংকট আছে। মহিউদ্দিন ভাই বেঁচে থাকলে এই সংকটের মধ্যে সঠিক সিদ্ধান্তটা দিতেন। যেমন মামুনুল হকের মতো একজন ধর্ম ব্যবসায়ী বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাঙার হুমকি দেওয়ার পর চট্টগ্রাম থেকে রাজনৈতিক ও সাংগঠনিকভাবে যেভাবে গর্জে ওঠার কথা ছিল, সেভাবে কিন্তু হয়নি। প্রতিবাদ হয়েছে, কিন্তু মহিউদ্দিন ভাইয়ের মতো কেউ ভূমিকা রাখতে পারলে এটা আরও ব্যাপকতা পেত। এই প্রেক্ষাপটে মহিউদ্দিন ভাইয়ের অভাব আমাদের বেশি অনুভূত হয়েছে।’

নগর যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক ফরিদ মাহমুদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘রাজনীতির মাধ্যমে মহিউদ্দিন ভাই অতীত-বর্তমানের সব নেতাকে ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন। উনার রাজনৈতিক দক্ষতার কাছে টিকতে না পেরে অনেকে উনাকে প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবতেন, বিরোধিতা করতেন। কিন্তু মহিউদ্দিন ভাই সেখানেই সফল যে তার বিরোধিতাকারীরাও তাকে আদর্শিক নেতা মানতে বাধ্য হচ্ছেন। যারা বিরোধিতা করতেন, এখন তারাও বলছেন— আমাদের আদর্শ মহিউদ্দিন চৌধুরী। বঙ্গবন্ধু ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পর এই জনপদে আওয়ামী লীগের মধ্যে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য নেতা হচ্ছেন মহিউদ্দিন ভাই। শুধু দল কেন, দলের বাইরেও সর্বজনশ্রদ্ধেয় নেতা হিসেবে উনাকে সবাই মানেন।’

চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক নুরুল আজিম রনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘চট্টগ্রামের স্বার্থের বিষয় এলেই মহিউদ্দিন ভাইয়ের শূন্যতা-প্রয়োজনীয়তা অনুভব করি। উনি মারা যাওয়ার পর নগর আওয়ামী লীগে শূন্যতা বিরাজ করছে, এটা অস্বীকার করার উপায় নেই। গত তিন বছরে লালদিঘীর ময়দানে একটি সমাবেশও হয়নি নগর আওয়ামী লীগের ব্যানারে। চট্টগ্রাম যখন সংকটে পড়ে, তখন আমাদের মনে একটাই ছবি ভেসে আসে— তিনি মহিউদ্দিন চৌধুরী। মহিউদ্দিন চৌধুরী একজন বীর। বীরের কখনো মৃত্যু হয় না। আর মৃত্যু হয় না বলেই তিনি ছবি হয়ে আমাদের মাঝে ভেসে আসেন।’

নগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক জাকারিয়া দস্তগীর সারাবাংলাকে বলেন, ‘আন্দোলন-সংগ্রামের সংকটময় মুহূর্তে মহিউদ্দিন ভাইয়ের কথা খুব মনে পড়ে। মৌলবাদী মামুনুল হক যখন বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাঙার হুমকি দেয়, তখন মনে হয়েছিল যদি মহিউদ্দিন ভাই বেঁচে থাকতেন, হুঙ্কার দিতেন। ২০১৩ সালে হেফাজতে ইসলামের তাণ্ডবের সময়, বিএনপি-জামায়াতের পেট্রোল বোমার আন্দোলনের সময় সারা শহরকে বিভিন্ন পয়েন্টে ভাগ করে তিনি আমাদের নামিয়ে দিয়েছিলেন। সেজন্য সারাদেশের পরিস্থিতি ছিল একরকম, আর চট্টগ্রাম শহরের পরিস্থিতি ছিল ভিন্ন। তিনি সবসময় আমাদের মাথার ওপর থাকবেন।’

২০১৭ সালের ১৫ ডিসেম্বর জীবনাবসান হয় এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরীর। ছাত্রলীগের রাজনীতি থেকে উঠে আসা মহিউদ্দিন মুক্তিযুদ্ধ করেছেন, পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার প্রতিবাদে অস্ত্র হাতে নিয়েছিলেন। টানা ১৭ বছর চট্টগ্রামের মেয়রের দায়িত্ব পালন করেছেন। আমৃত্যু চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন।

আওয়ামী লীগ বঙ্গবন্ধুর ভাবশিষ্য মহিউদ্দিন মহিউদ্দিন চৌধুরী

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর