Thursday 21 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১— কাঁপা কাঁপা হাতে নিয়াজীর রিভালবার হস্তান্তর


১৬ ডিসেম্বর ২০২০ ০৮:৪৫

ঢাকা: বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে বিজয় অর্জিত হয় ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর। অধিকার আদায়ে বাঙালির সংগ্রাম ও লড়াইয়ের সোনালি ফসল ঘরে ওঠে এদিন।  লাল-সবুজ পতাকার জয় হয়। এদিন বাঙালির বাঁধনহারা উল্লাসের দিন।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে ভাষণে এই ভূখণ্ডে মানুষের হৃদয়ে দিয়েছিলেন বিজয় মন্ত্রের দীক্ষা। এর পর ২৫ মার্চ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী শুরু করে বর্বরোচিত হামলা। তারপর নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে স্বাধীন হয় বাংলাদেশ।

বিজ্ঞাপন

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর— কেমন ছিল সেদিনের ঢাকা? সেদিনের বীর নায়কদের স্মৃতিচারণ ও বইয়ের পাতা থেকে উঠে এসেছে সেই রোমাঞ্চগাঁথা। সেদিন ঢাকায় দুপুরের পর বিজয়ের আনন্দে উল্লসিত মানুষের স্রোত আসতে শুরু করে। সাধারণ মানুষ বিজয় আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে ওঠে। ঘরে ফেরা মুক্তিযোদ্ধাদের জড়িয়ে ধরে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করতে থাকে তারা।

১৬ ডিসেম্বর ভারতীয় সেনাবাহিনীর মেজর জেনারেল জ্যাকব আত্মসমর্পণের দলিল নিয়ে আলোচনার জন্য দুপুর ১টার দিকে হেলিকপ্টারযোগে তেজগাঁও বিমানবন্দরে অবতরণ করেন। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের চিফ অব স্টাফ ব্রিগেডিয়ার বাকের সিদ্দিকী এবং জাতিসংঘের ঢাকা প্রতিনিধি জন কেলি তাকে বিমানবন্দরে অভ্যর্থনা জানান। ব্রিগেডিয়ার বাকের জেনারেল জ্যাকব ও কর্নেল খারাকে (ভারতীয়) নিয়ে পূর্বাঞ্চল (পাকিস্তান) বাহিনীর সদর দফতরে পৌঁছান। এয়ার কমোডর পুরুষোত্তম বিমানবন্দরে থেকে যান জেনারেল আরোরাসহ অন্যদের অভ্যর্থনার আয়োজন করতে।

জেনারেল নিয়াজীর অফিসে এসে জেনারেল জ্যাকব লক্ষ্য করেন যে নিয়াজী আর জেনারেল নাগরা পাঞ্জাবী ভাষায় পরস্পরকে একটার পর একটা স্থুল ও আদি রসাত্মক কৌতুক উপহার দিচ্ছেন। সেখানে আরও উপস্থিত ছিলেন জেনারেল রাও ফরমান আলী, জেনারেল মোহাম্মদ জামসেদ খান, রিয়ার অ্যাডমিরাল শরিফ ও এয়ার ভাইস মার্শাল ইনাম উল হক।

বিজ্ঞাপন

নিয়াজীর সঙ্গে আলোচনার আগে জ্যাকব জেনারেল জি সি নাগরাকে আলাদাভাবে ডেকে নিয়ে প্রয়োজনীয় সংখ্যক ভারতীয় সৈনিক ঢাকায় আনার নির্দেশ দেন এবং ঢাকার নিরাপত্তা, আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানের খুঁটিনাটি— যেমন গার্ড অব অনার, টেবিল-চেয়ার ইত্যাদির ব্যবস্থা করতে পাঠিয়ে দেন।

এরপর দুই পক্ষের মধ্যে আত্মসমর্পণ নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। পিনপতন নীরবতার মধ্যে কর্নেল খারা আত্মসমর্পণের শর্তগুলো পড়ে শোনান এবং খসড়া কপিটি জেনারেল নিয়াজীকে দেন। পাকিস্তানিরা ধারণা করেছিলেন যে আত্মসমর্পণ নয়, যুদ্ধবিরতি হবে। আত্মসমর্পণের সংবাদ পেয়ে তারা বেশ হতাশ হয়ে পড়ে। জেনারেল ফরমান আলী যৌথ বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণের বিরোধিতা করেন। তিনি ভারতীয় বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণের পক্ষে মত দেন। জেনারেল নিয়াজী দলিলটি অন্যদের দেখার জন্য দেন। কেউ কেউ কিছু পরিবর্তনের কথা বলেন।

দলিলে পাকিস্তানিদের পক্ষে বেশকিছু শর্ত ছিল। যেমন— পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী আচরণ করা হবে এবং সার্বিক নিরাপত্তাও নিশ্চিত করা। এমনকি পাকিস্তানপন্থী সব বেসামরিক জনগণের নিরাপত্তার বিষয়ও দলিলে উল্লেখ ছিল, যা আগে কখনো কোনো আত্মসমর্পণের দলিলে অন্তর্ভুক্ত হয়নি। পাকিস্তানিরা আরও কিছু সময় নেওয়ার পর আত্মসমর্পণের দলিলে সম্মতি দেয়। এরপর আত্মসমর্পণের পদ্ধতি নিয়ে আলাপ শুরু হয়।

জেনারেল জ্যাকব জানান, আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠান হবে রেসকোর্স ময়দানে। সেখানে প্রথমে ভারত ও পাকিস্তানি বাহিনীর সম্মিলিত দল জেনারেল আরোরাকে গার্ড অব অনার প্রদান করবে। এরপর আত্মসমর্পণের দলিল সই হবে এবং জেনারেল নিয়াজী তার অস্ত্র ও পদবির ব্যাজ খুলে জেনারেল আরোরার কাছে হস্তান্তর করবেন।

আত্মসমর্পণের পদ্ধতির কিছু কিছু ব্যবস্থায় জেনারেল নিয়াজী গররাজি ছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন আত্মসমর্পণের অনুষ্ঠান তার অফিসেই হোক। শর্তগুলোর বিষয়ে জেনারেল জ্যাকবের অনড় অবস্থানের কারণে শেষে জেনারেল নিয়াজী সবই মেনে নেন। তবে আত্মসমর্পণের পরও নিরাপত্তার জন্য তার অফিসার ও সৈনিকদের ব্যক্তিগত অস্ত্র নিজেদের কাছে রাখার অনুমতি চান।

সাধারণত বিজিত সেনাপতি বিজয়ী সেনাপতির সদর দফতরে গিয়ে আত্মসমর্পণের দলিলে সই দেন ও অস্ত্র  সমর্পণ করেন। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে এর ব্যতিক্রম ঘটানো হয়। এখানে বিজয়ী সেনাপতি বিজিত সেনাপতির এলাকায় গিয়ে জনসমক্ষে অত্মসমর্পণের আনুষ্ঠানিকতা শেষ করেন।

হেলিকপ্টারে করে পড়ন্ত বিকেলে জেনারেল আরোরাসহ মুক্তিযুদ্ধের উপসেনাপতি আবদুল করিম (এ কে) খন্দকার বীরউত্তম তেজগাঁও বিমানবন্দরে এসে অবতরণ করেন। অবতরণ করার পর তারা দেখেন, সেখানে হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে। তেজগাঁও বিমানবন্দরে জেনারেল নিয়াজী, জেনারেল জ্যাকব এবং আরও কিছু পাকিস্তানি ও মিত্রবাহিনীর কর্মকর্তা তাদের অভ্যর্থনা জানান। এরপর জিপে করে  তারা রমনা রেসকোর্স ময়দানে রওনা হন। সে সময় রমনার চারপাশে ছিল মানুষের ব্যাপক ভিড়। এমন পরিস্থিতিতে ভিড় ঠেলে তারা উপস্থিত হন রেসকোর্স ময়দানের সেই নির্দিষ্ট স্থানটিতে। অনুষ্ঠানটি ছিল অনাড়ম্বর এবং এটি অল্পসময়ে শেষ হয়।

অনুষ্ঠানস্থলে মাত্র দু’টি চেয়ার আর একটি টেবিল ছিল। একটি চেয়ারে বসেন জেনারেল নিয়াজী, অন্যটিতে আরোরা। আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানটি খুব সুশৃঙ্খলভাবে হয়নি। মানুষের ভিড়ে অতিথিদের দাঁড়িয়ে থাকাটা কঠিন ছিল। আবদুল করিম (এ কে) খন্দকার বীরউত্তম, ভারতীয় নৌবাহিনীর প্রধান রিয়ার অ্যাডমিরাল এস এম নন্দ ও পূর্বাঞ্চল বিমানবাহিনীর কমান্ডার এয়ার মার্শাল হরি চান্দ দেওয়ান পাশাপাশি দাঁড়িয়েছিলেন। পাশেই ছিলেন পূর্বাঞ্চল সেনাবাহিনীর চিফ অব স্টাফ মেজর জেনারেল এফ আর জ্যাকব। জেনারেল আরোরার ঠিক পেছনে দাঁড়িয়েছিলেন এ কে খন্দকার। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অশোক রায় ছিলেন তার পেছনে। যদিও ভিড়ের চাপে তারা তাদের অবস্থান ধরে রাখতে পারছিলেন না।

আত্মসমর্পণের দলিল নিয়ে আসার পর প্রথমে পাকিস্তানি বাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় প্রধান জেনারেল নিয়াজী ও পরে ভারতীয় বাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল আরোরা দলিলে সই করলেন। সইয়ের জন্য নিয়াজীকে কলম এগিয়ে দেন আরোরা। প্রথমে কলমটি দিয়ে লেখা যাচ্ছিল না। আরোরা কলমটি নিয়ে ঝাড়াঝাড়ি করে পুনরায় নিয়াজীকে দেন। এ দফায় কলমটি আর ঝামেলা করেনি। সই শেষ হলে উভয়ই উঠে দাঁড়ান। তারপর আত্মসমর্পণের রীতি অনুযায়ী জেনারেল নিয়াজী নিজের রিভালবারটি কাঁপা কাঁপা হাতে অত্যন্ত বিষণ্ণতার সঙ্গে জেনারেল আরোরার কাছে হস্তান্তর করেন।

এরপর মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর সদস্যরা পাকিস্তানি সৈন্য ও কর্মকর্তাদের কর্ডন করে ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যান। এভাবে বাঙালি জাতির বিজয় সূচিত হয় ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১!

পরবর্তী সময় বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘সকাল ৮টায় ঢাকা শহরের প্রান্তসীমায় ছোট মিরপুর সড়কের হেমায়েতপুর সেতুর কাছে মেজর জেনারেল নাগরা এক টুকরো কাগজ জিপের বনেটে রেখে শত্রু পক্ষের কমান্ডার আমির আব্দুল্লাহ নিয়াজীকে যৌথবাহিনীর পক্ষ থেকে আত্মসমর্পণের জন্য লিখেছেন— প্রিয় আব্দুল্লাহ, আমরা এসে গেছি। তোমার সব ভেলকি খতম হয়ে গিয়েছে। আমরা তোমাকে চারপাশ থেকে ঘিরে ফেলেছি। বুদ্ধিমানের মতো আত্মসমর্পণ কনো। না হলে তোমার ধ্বংস অনিবার্য। আমরা কথা দিচ্ছি, আত্মসমর্পণ করলে জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী তোমাদের সঙ্গে আচরণ করা হবে। তোমাকে বিশেষভাবে লিখছি— আত্মসমর্পণ করলে তোমার জীবনের নিশ্চয়তা দেওয়া হবে। তোমারই মেজর জেনারেল নাগরা।’

কাদের সিদ্দিকী বলেন, আত্মসমর্পণের প্রথম সামরিক পর্ব সারতে ঢাকার দিক থেকে একটি মার্সিডিজ বেঞ্জ ও দু’টি জিপে দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীর একজন মেজর জেনারেল, দুজন লেফটেন্যান্ট কর্নেল, একজন মেজর, দু’জন ক্যাপ্টেন ও কয়েকজন সিপাহি আত্মসমর্পণের আনুষ্ঠানিক পর্ব সারতে এলো। পাকিস্তানি হানাদারদের পক্ষ থেকে বাংলাদেশে দখলদার বাহিনীর সিএএফ প্রধান মেজর জেনারেল জামশেদ আত্মসমর্পণের প্রথম পর্ব সারতে এসেছেন। আমরা যথারীতি সারিবদ্ধভাবে দাঁড়ালাম। মেজর জেনারেল নাগরার বামে ব্রিগেডিয়ার সানসিং, তার বামে ব্রিগেডিয়ার ক্লে ও সর্বশেষে আমি কাদের সিদ্দিকী।

তিনি বলেন, ‘মেজর জেনারেল জামশেদ যৌথবাহিনীর সেনানায়কদের সামনে দাঁড়িয়ে সামরিক কায়দায় অভিবাদন করার পর নাগরার সামনে এসে কোমর থেকে রিভলবার বের করে প্রসারিত দু’হাতে নাগরার সামনে বাড়িয়ে দিলেন। মেজর জেনারেল নাগরা ছ’টি বুলেট খুলে রেখে রিভলবারটি আবার জামশেদের কাছে ফেরত দিলেন।’

সকাল ১০টা ১০মিনিটে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ইস্টার্ন কমান্ডের সেনাপতি লে. জেনারেল নিয়াজীর অফিসে যাওয়ার স্মৃতিচারণ করে বঙ্গবীর বলেন, ‘সকাল ১০টা ১০ মিনিট। নিয়াজী তার অফিস ঘরে এলেন। অফিস ঘরে ঢুকে তার চেয়ারের পাশে দাঁড়িয়ে বিজয়ী সেনাপতিদের সামরিক অভিবাদন জানালেন। আত্মসমর্পণ করার জন্য মেজর জেনারেল নাগরা প্রথমে নিয়াজীকে ধন্যবাদ জানালেন এবং তাকে বুদ্ধিমান সেনাপতি হিসেবে উল্লেখ করে প্রশংসা করলেন।’

বাঙালির বিজয় মুহূর্তটির স্মৃতিচারণ করে বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বলেন, ‘নিয়াজী হাত বাড়িয়ে দিলেও আমার দিক থেকে কোনো সাড়া ছিল না। মুহূর্তে আমার কপাল ও হাতে বিন্দু বিন্দু ঘাম ফুটে উঠল। আমার মনে হচ্ছিল, লাখ লাখ বাঙালির হত্যাকারী পাপীষ্ঠের সঙ্গে হাত মেলাব কোন প্রয়োজনে?’

তিনি বলেন, ‘হানাদাররা আত্মসমর্পণ করেছে— এই খবর যেন কী করে সারা ঢাকায় বিদ্যুতের মতো ছড়িয়ে গেল। তখন রেডিও-টিভি সব বন্ধ ছিল। তবুও খবর জানতে ঢাকাবাসীর দেরি হলো না। ঢাকার ৮০ ভাগ লোকই তখন শহরের বাইরে। অবরুদ্ধ নগরীর বিষণ্ন পরিবেশ বদলে গিয়ে মুক্তির উল্লাসে ভরে উঠল। অন্তরের সর্বস্ব বজ্রকণ্ঠে বারবার উল্লসিত হচ্ছিল জাতীয় অনুভূতি— জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।’

সেদিনের স্মৃতি সম্পর্কে জানতে চাইলে ‘অভিমানী’ বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীর উত্তম মঙ্গলবার (১৫ ডিসেম্বর) সন্ধ্যায় সারাবাংলাকে বলেন, ‘এ মাসে (বিজয়ের মাস) আমি কোনো কথা বলব না। বিজয়ের মাস যাক, তার পর এসো।’

সূত্র: ১৯৭১: ভেতরে বাইরে, এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) আবদুল করিম (এ কে) খন্দকার বীরউত্তম, মুক্তিযুদ্ধের উপসেনাপতি

১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ আত্মসমর্পণ নয় মাস নিয়াজী পাকবাহিনী বাংলাদেশ বিজয় দিবস যুদ্ধ রেসকোর্স ময়দান সংগ্রাম

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর