বিজয় একাত্তর; একটি ঋণপত্র
১৬ ডিসেম্বর ২০২০ ১৩:০২
ডিসেম্বর। বিজয় ও গৌরবের মাস। পূর্তির ৪৯ তম বছর। কালের চাকা ঘুরে দেখতে দেখতে কেটে গেছে বছরগুলো। আমরা বাঙালিরা ২৪ বছরের পাকিস্তানি পরাধীনতার জিঞ্জির ভেঙেছি একাত্তরে। দখলদার পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে ৯ মাসের সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে অর্জন করেছি মহান বিজয়।
এভাবে বদলে যায় বিশ্বমানচিত্র। উদিত হয় ‘বাংলাদেশ’ নামে আরেকটি নতুন রাষ্ট্র। আমরা পেয়েছি ৫৬ হাজার বর্গমাইলের ভৌগোলিক সীমা। অবশ্য তার জন্য আমাদের দিতে হয়েছে চড়া মূল্য। স্বাধীনতা ও মুক্তি সংগ্রামের ডাক দেন যিনি, তিনি হলেন বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। নেতৃত্বে ছিল তাঁরই রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ। আর তত্ত্বাবধানে ছিল প্রবাসী মুজিবনগর সরকার। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশেই বাংলার দামাল ছেলেরা সেদিন ঘর ছেড়ে ও আপনজন ফেলে গিয়েছিল পাক শত্রুর বিরুদ্ধে লড়তে, বুলেট হয়ে মুক্তির নেশায়।
১৬ ডিসেম্বর, আমাদের মহান বিজয় দিবস। দেশ এদিন শত্রুমুক্ত হয়। স্যালুট দেই সেইসব বীর বাঙালি শহীদদের, যাঁরা জীবন উৎসর্গ করেছেন মুক্তিযুদ্ধে। আমাদের আজকের স্বাধীকার চেতনায় সমৃদ্ধ নতুন প্রজন্মের পক্ষ থেকে লাখো-কোটি সালাম সেইসব অগ্রপথিকদের, যাঁরা আমাদের দিয়েছেন এমন একটি গৌরবের উপলক্ষ। কিন্তু শঙ্কা জাগে মনে একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত প্রেত্মাত্বা না আবার উগ্র জঙ্গিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের আছরে প্রাণ ফিরে পায়।
গোড়ার কথা
১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণার পর থেকে দীর্ঘ ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধের সফল পরিসমাপ্তি ঘটে ১৬ ডিসেম্বর ঢাকায়, হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে। ওই ৯ মাসের যুদ্ধে চরম মূল্য দিতে হয়েছে আমাদের। মুক্তিযুদ্ধে প্রাণ দিয়েছেন ৩০ লাখ মানুষ, সম্ভ্রম হারিয়েছেন ৩ লাখ মা-বোন; আর লাখ লাখ লোক হয়েছেন বাস্তুচ্যুত। বসতবাড়ি পোড়ানো, লুটপাট ও নিগ্রহের কারণে উদ্বাস্তু হয়ে এক কোটি নিরীহ-নিরস্ত্র শান্তিপ্রিয় মানুষ বাধ্য হয়ে আশ্রয় নেন ভারতে। পাকিস্তানি বাহিনী এবং তাদের এ দেশীয় দোসররা শুধু ইতিহাসের জঘন্যতম গণহত্যাই ঘটায়নি তারা ধ্বংস করেছে যোগাযোগ ব্যবস্থা, জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দিয়েছে শিল্পকারখানাসহ মূল্যবান সব স্থাপনা আর মাইলের পর মাইল জনপদ পরিণত করেছে শশ্মানে। পাকিস্তানি সেনারা যখন নিশ্চিতভাবে জেনে যায় তাদের আত্মসমর্পণ করা ছাড়া সামনে দ্বিতীয় কোনো পথ খোলা নেই এবং দেশটি শীঘ্রই স্বাধীন হতে চলেছে ঠিক তখনই তারা রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস, জামায়াত ইসলাম ও তাদের সহযোগীদের সহায়তায় দেশের বুদ্ধিজীবীদের তথা যাঁরা স্বাধীন বাংলাদেশ গড়তে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেন, এমনসব শত শত ব্যক্তিকে পরিকল্পিতভাবে ধরে নিয় গিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে।
এতকিছুর পরও পাকিস্তানি বাহিনী পারেনি মুক্তিযুদ্ধে বাঙালির বিজয়কে ঠেকিয়ে রাখতে। কৃষক-শ্রমিক, ছাত্র-শিক্ষক, সাংবাদিক, চিকিৎসক, সরকারি চাকুরে, বুদ্ধিজীবী, বাঙালি সৈনিক, নাবিক-বৈমানিক, ইপিআর, পুলিশ তথা দেশপ্রেমিক বাঙালি নর-নারীর সম্মিলিত প্রবল প্রতিরোধের মুখে পরাজিত হয়ে লেজ গোটাতে হয়েছিল পাকিস্তানি বাহিনীকে। ১৬ ডিসেম্বর অপরাহ্নে তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর যৌথ কমান্ডের কাছে লাখখানেক সৈন্যসহ অস্ত্র সমর্পণ করেন পাক বাহিনীর ইস্টার্ন ফ্রন্টের প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল আমীর আব্দুল্লাহ খান নিয়াজী। সই করে আত্মসমর্পণ দলিলে।
ফিরে দেখা
পাকিস্তানি জাতীয় পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর এবং প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন ১৭ ডিসেম্বর। এতে আওয়ামী লীগ ভোট পায় শতকরা ৯৮ ভাগ। ফলে পাকিস্তানি শাসনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেন দলনেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তৎপ্রেক্ষিতে ঢাকায় ডাকা হয় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন। বঙ্গবন্ধুও পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণে প্রস্তুত। কিন্তু বাধ সাধেন ক্ষমতালোভী প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভূট্টো। ২০ ডিসেম্বর সাফ ঘোষণা দেন, বিরোধীদলে বসবেন না তিনি- কোনো অবস্থাতেই না।
এদিকে নির্বাচিত জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের মাননীয় সদস্যদের শপথ অনুষ্ঠিত হয় একাত্তরের ৩ জানুয়ারি রেসকোর্স ময়দানে। শপথ পরিচালনা করেন পাকিস্তানি প্রধানমন্ত্রী ডিজেগনেট বঙ্গবন্ধু। ৩ মার্চে ঢাকাতে ডাকা হয় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ও তাঁর সংসদীয় দল ৬ দফার ভিত্তিতে প্রণয়ন করেন পাকিস্তানি সংবিধান। খসড়া এ সংবিধানটি প্রকাশিত হয় ঢাকার দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায়। ১ মার্চ হোটেল পূর্বানী ইন্টারন্যাশনালে আওয়ামী লীগের সাংসদীয় দলের বৈঠক বসে। সিদ্ধান্তে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের প্রধানমন্ত্রী এবং ক্যাপ্টেন মনসুর আলীকে পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক পরিষদের মূখ্যমন্ত্রী হিসেবে অনুমোদন দেয়া হলেও ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে ওই দিনই রেডিও পাকিস্তানে আকস্মিক এক ঘোষণায় বলা হয়, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদ অধিবেশন ২৫ মার্চ পর্যন্ত মুলতবি ঘোষণা করেছেন- যা অনুষ্ঠিত হবার কথা ছিল ৩ মার্চে। এ ঘোষণায় বদলে যায় সব। প্রতিবাদ-বিক্ষোভে সারা ঢাকা হয়ে ওঠে মিছিলের নগরীতে।
পটভূমি
১৯৪৭ সালে ব্রিটিশদের কবল থেকে ভারতবর্ষ স্বাধীনতা পেলে বিভক্ত হয়ে যায় দুটি রাষ্ট্র্র। একটি ভারত, অন্যটি পাকিস্তান। ভারতের পশ্চিমাঞ্চল এবং পূর্বদিকের পূর্ববাংলা নিয়ে পাকিস্তানের সৃষ্টি। আর পাকিস্তান গঠিত হয় দুটি অঞ্চল নিয়ে- পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তান, যার দূরত্ব প্রায় ২ হাজার কিলোমিটার। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকেই পশ্চিমারা বিমাতাসুলভ আচরণ শুরু করে পূর্ববাংলার প্রতি। অথচ পশ্চিম পাকিস্তানের চেয়ে পূর্ব পাকিস্তানের লোকসংখ্যা ছিল বেশি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ভাষায়- ‘আমরা পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ, অথচ আমরা যখনই ক্ষমতায় যাওয়ার চেষ্টা করেছি, তখনি তারা অন্যায়ভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েছে আমাদের ওপর’। ফলে রাষ্ট্র্র পরিচালনা হতে লাগলো দুই অঞ্চলের ভেতর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক চরম বৈষম্যের মধ্য দিয়ে। এমনকি আঘাত আনতে শুরু করল বাঙালিদের জন্মগত অধিকারের ওপরও। মাতৃভাষা বাংলাকে বাদ দিয়ে উর্দুকে এদেশের রাষ্ট্র্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দেবার চেষ্টা করলে বাঙালিরা আর পারেনি নিশ্চুপ থাকতে- গর্জে ওঠ। মায়ের ভাষায় কথা বলার অধিকার প্রতিষ্ঠা করে বুকের তাজা রক্ত দিয়ে। বাঙালিদের মনে রোপিত হয় স্বাধীকার চিন্তার বীজ। এরপরে অধিকার আদায়ে বিভিন্ন সময়ে এদেশের মানুষ সোচ্চার হয়ে উঠল।
১৯৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানই জানান দেয় বাঙালিরা জেগেছে। ‘৭০ এর সাধারণ নির্বাচনে এদেশের আওয়ামী লীগ পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনে শঙ্কিত হয়ে ওঠে পশ্চিমারা। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে তালবাহানা করতে থাকলে শুরু হয় গণআন্দোলন।
৯ মাসব্যাপী সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের আগে ছিল আরো অনেক দিনের আন্দোলন, অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষা। ১৯৪৮ ও ‘৫২ এর ভাষা আন্দোলন, ‘৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন, ‘৬২ সালের ৬ দফা আন্দোলন, ‘৬৯-‘৭০ সালে ব্যাপক রাজনৈতিক গণআন্দোলন এবং ‘৭১ সালের প্রথম দিনগুলোতে অভূতপূর্ব শান্তিপূর্ণ সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলন- এসবই বাঙালিকে প্রস্তুত করে তুলেছিল তাঁর মুক্তিযুদ্ধের জন্য।
স্বাধীনতার ডাক ও মুক্তিযুদ্ধে বাঙালির প্রস্তুতি
দীর্ঘদিনের ঐতিহ্যমন্ডিত সমৃদ্ধ বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রতি সুগভীর অনুরাগ, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, অসাম্প্রদায়িক ধর্মনিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ, সামাজিক-অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সমতাভিত্তিক বৈষম্যমূলক সমাজ প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষা, আমলাতান্ত্রিক জিম্মি থেকে মুক্তি লাভের ইচ্ছা ইত্যাদি কারণে মুক্তিযুদ্ধ হয়ে পড়ে অবশ্যম্ভাবী।
সমগ্র পাকিস্তানে এক ব্যক্তির এক ভোটের মাধ্যমে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করার পরও বাঙালিদের শাসন করতে দেওয়া হয়নি। বরং উল্টো বাঙালি জনগোষ্ঠীকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে ইতিহাতের জঘন্যতম গণহত্যা, লুণ্ঠন, ধর্ষণ ও নির্মম অত্যাচার চালানো হয়েছে। এমনি অগ্নিগর্ভ বাংলায় সেদিন সমগ্র জাতি একই মোহনায় মিলিত হয় শত-শতাব্দীর ইতিহাসের মহানায়ক জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে। ২৬ মার্চ ঘোষণা করেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা।
এর আরও আগে রেসকোর্স ময়দানে লাখো জনতার মহাসমুদ্রে উচ্চকিত তর্জনির বজ্র নির্ঘোষে জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের সেই মহাস্মরণীয় রাষ্ট্রনায়কোচিত ও কর্তৃত্বব্যঞ্জন ভাষণ, যা গৃহযুদ্ধ বিধ্বস্ত আমেরিকার প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিঙ্কনের ১৮৬৩ সালের বিখ্যাত গেটিসবার্গ বক্তৃতার সঙ্গে তুল্য শুধু নয়, এটি এখন বিশ্বের শ্রেষ্ঠভাষণ হিসেবে স্বীকৃত। বঙ্গবন্ধু তাঁর নাতিদীর্ঘ ভাষণে পাকিস্তানি রাষ্ট্রের সঙ্গে বাঙালিদের দ্বন্দ্বের স্বরূপ ব্যাখ্যা, অসহযোগ আন্দোলনের বিস্তারিত কর্মসূচি ঘোষণা, সারা বাংলায় প্রতিরোধ গড়ে তোলার নির্দেশ, প্রতিরোধ সংগ্রাম মুক্তিযুদ্ধে রূপ নেয়ার স্পষ্ট ইঙ্গিত, শত্রুর মোকাবিলায় গেরিলা যুদ্ধের কৌশল অবলম্বন, যেকোন উস্কানির মুখে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখার এসব পরামর্শের পর ঘোষণা করেন- ‘ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল। তোমাদের যা কিছু আছে, তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে… এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম- জয় বাংলা’। মূলত বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণই ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা।
২৫ মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের পোষ্য টিক্কা খান, রাও ফরমান আলী এবং জেনারেল খাদিমের ‘অপারেশন সার্চলাইট’-এর পরিপ্রেক্ষিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তাঁরই সই করা স্বাধীনতার ঘোষণা গুঁজে দেন একেএম মোশাররফ হোসেনের হাতে (বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী)। তিনি বঙ্গবন্ধুর ঘোষণা রাতের প্রথম প্রহরে পাঠান বলধা গার্ডেনে স্থাপিত ওয়্যারলেসের মাধ্যমে। আরেকটি পাঠান রাত ২ টার দিকে। এতে তিনি বলেন, ‘এটাই তাঁর শেষ নির্দেশ- যুদ্ধু চালিয়ে যাও। যুদ্ধ চলবে বাংলার মাটি থেকে একজন শত্রু নির্মূলের আগ পর্যন্ত’। এ ঘোষণা চট্টগ্রামে পৌঁছে ওয়্যারলেসে। অপারেটররা এ ঘোষণা পৌঁছে দেন এমআর সিদ্দিকীর স্ত্রী কোহিনূর এবং জহুর আহমেদ চৌধুরীর স্ত্রী নূরুন্নাহার জহুরের কাছে। পরে বেতার ঘোষণা পাঠ করেন আওয়ামী লীগ নেতা এম এ হান্নান এবং রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের পরদিন ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধুর নামে ফের ঘোষণাটি পাঠ করানো হয় জেড ফোর্সের অধিনায়ক মেজর জিয়াউর রহমানকে দিয়ে। বাঙালি জাতিকে মুক্তি ও স্বাধীনতা অর্জনে যত নির্দেশ দেওয়া দরকার সবই দিলেন। সেদিনই আনুষ্ঠানিকভাবে অনুমোদিত হলো কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। পূর্ববাংলার প্রশাসন চলতে থাকে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে। তিনি জেনারেল ওসমানী ও জেনারেল মাজিদের হাতে তুলে দেন যুদ্ধ ঘোষণার প্রতীক- তলোয়ার।
এর আগে ৩ মার্চ ঢাকার পল্টনে ছাত্রলীগের আহূত জনসভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে তুলে দেওয়া হয় জাতীয় পতাকা ও স্বাধীনতার ইশতেহার – ‘জয় বাংলা’। সভায় ঘোষিত হয় ১০টি সিদ্ধান্ত। এর মধ্যে দ্বিতীয় সিদ্ধান্তটি হচ্ছে – বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ‘বাঙালি জাতির পিতা’।
মুক্তির চেতনা
পাক সরকারি নির্যাতন-নিষ্পেষণ যতই বাড়তে থাকে, ততই বঙ্গবন্ধু কর্তৃক ৬ দফা কর্মসূচি দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এর সঙ্গে ছাত্র সমাজের ১১ দফা কর্মসূচি সংযুক্তিতে বাঙালির মুক্তি সংগ্রামে নতুন মাত্রা পায়। এতে আন্দোলন দমনে আইয়ুব সরকার বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’র (১৯৬৮ খ্রি.) স্কেপগোট বানানোর পদক্ষেপ নিলে বিস্ফোরণোম্মুখ পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটার মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতির মুক্তির চেতনায় আসে গণজোয়ার- ‘জেলের তালা ভাঙবো, শেখ মুজিবকে আনবো, তোমার নেতা আমার নেতা শেখ মুজিব-শেখ মুজিব, বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর, তোমার আমার ঠিকানা পদ্মা-মেঘনা-যমুনা, জেগেছে বাঙালি জেগেছে, জয় বাংলা’- এসব শাণিত উচ্চারণে শুধু বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনাই নয়, বাঙালি সংস্কৃতির একটি সংগ্রামী চরিত্রও দানা বাঁধে। সেদিন আমাদের অন্যকোন পরিচয় ছিল না, ছিলাম বাঙালি। আমাদের অন্যকোন কাজ ছিল না, একমাত্র লক্ষ্য ছিল স্বাধীনতা।
বাংলাদেশ তার নাম
১৯৭০ সালের জুন মাসে পল্টন ময়দানে স্বাধীনতার লক্ষে গড়ে তোলা ‘জয় বাংলা বাহিনী’র নেতা আ স ম আব্দুর রবের হাতে বঙ্গবন্ধু তুলে দেন যে পতাকাটি, সেটিই পরবর্তীতে চিহ্নিত হয় জাতীয় পতাকা হিসেবে এবং ৩ মার্চ ঘোষিত হয় ‘পতাকা দিবস’ হিসেবে।
ইতোমধ্যে যে জাতির উত্থান ঘটেছে, সেটি বাঙালি জাতি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর জনক। স্বাধীন এ দেশটির নাম কী হবে তা আগেই ঠিক করা ছিল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ ঢাকার পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত এক জনসভা লাখো জনতার উপস্থিতিতে ইশতেহারে ঘোষণা করেন, স্বাধীন সার্বভৌম ‘বাংলাদেশ’ ঘোষণা করা হয়েছে (সূত্র: দৈনিক পাকিস্তান, ইত্তেফাক, সংবাদ ৪ মার্চ ১৯৭১ খ্রি.)। ১৯৭০ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত পাকিস্তানের নির্বাচনে বিজয়ী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে ১৯৭১ সালের ৩ জানুয়ারি তিনি ঘোষণা করেছিলেন- দেশটি যদি স্বাধীন হয়, তাহলে দেশের জাতীয় সংগীত হবে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আমার সোনার বাংলা/আমি তোমায় ভালোবাসি’ (সূত্র: দৈনিক পাকিস্তান, ইত্তেফাক ৪ জানুয়ারি ১৯৭১ খ্রি.)। তাছাড়া দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বিশেষ ক্ষেত্রে আমরা এর প্রতিফলন দেখতে পাই তা হলো- আমাদের জাতীয় ফুল শাপলা, জাতীয় পাখি দোয়েল, টেলিভিশনের প্রারম্ভিক সুর মূর্ছনা দ্বিজেন্দ্র লাল রায়ের বিখ্যাত দেশাত্মবোধক গান- ‘ধন ধান্যে, পুষ্পে ভরা’ এবং ‘জয় বাংলা’ ‘জিন্দাবাদ’ এর সমার্থক বা প্রতিশব্দ নয়; এটি হচ্ছে বাঙালি জাতির সার্বিক মুক্তির ধ্বনি।
আশা ছিল…
স্বৈরশাসনের স্টিমরোলার নয়, অবাধ দলনিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে দায়িত্ব, আস্থা ও ক্ষমতাপ্রাপ্ত দেশপ্রেমিক জনপ্রতিনিধিদের দ্বারা গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে দেশ শাসিত হবে, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারি প্রকৃত অর্থেই জনগণের সেবক হবেন- প্রভু নয়। দেশে ধনী-দরিদ্রের শ্রেণি বৈষম্য দূর হবে এবং পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে অনুসৃত হবে জোট নিরপেক্ষ স্বাধীননীতি।
যা চাইলাম তা পাইলাম না
আজ ৪৯ বছর পেছনে ফেলে এসে উপলব্ধি করতে হচ্ছে, দেশ শত্রুমুক্ত হলেও আমাদের মনের মুক্তি ঘটেনি আজও। পুরনো ধ্যান-ধারণা, আদর্শ ও বিশ্বাস অলক্ষে জাতীয় চরিত্রকে ক্রমাগত কলুষিত করছে। তাই স্বাধীনতার ৪৯ বছরেও আমাদের মৌলিক অর্থনৈতিক উন্নতির সূচক বাড়লেও থামেনি দুর্নীতি ও অর্থ পাচার। কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন ঘটেনি ঔপনিবেশিক আমলের ‘প্রভূ-ভৃত্য’ আচরণিক বৈশিষ্ট্যের। রাজনীতির নীতি এবং সামাজিক ও নৈতিক মূল্যবোধের চরম অবক্ষয়ে অধোগতি সামাজিক নিরাপত্তা সূচকে। যৌন ও নারী সহিংসতার প্রাবাল্যতা এবং ‘ইগো-সেন্ট্রিক পলিটিক্স’ এবং সালিশী বিচার ব্যবস্থাকে আবর্তিত করে গড়ে ওঠা ‘ভিলেজ পলিটিক্স’, যা নতুন প্রজন্মের অগ্রগতিকে কেবল নয়, জাতীয় রাজনীতিকেও দিচ্ছে স্থবির করে। যে আগামীর স্বপ্ন দেখে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছিলেন আমাদের পূর্বসূরিরা, তার দশা কী? তা আজ মূল্যায়নের সময় এসেছে। আমাদের নতুন প্রজন্ম নিশ্চয়ই শহিদের কাঙ্ক্ষিত বাংলাদেশ গড়তে অর্থনৈতিক স্বয়ংসম্পূর্ণতার পাশাপাশি তারা সম্মান করবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে, ঘৃণা করবে সাম্প্রদায়িক আত্মপ্রবঞ্চকদের। সেদিন উচ্চস্বরে বলা যাবে আমরা স্বাধীন, বিজয়ী।
তবুও আশা
তবুও এসব নির্মম সত্যের প্রতি চোখ ফিরিয়ে রেখে সবুজ জমিনে রক্তে আঁকা পতাকায় সুশোভিত হবে গৃহ ও অফিস। এ বছর মুজিববর্ষে বিজয় দিবস উদযাপিত হবে এক ভিন্নতর মানবিক পরিবেশে। অমানবিক জীবনযাপন ও ভিক্ষাবৃত্তি করতে হবে না যুদ্ধাহত কোনো মুক্তিযোদ্ধাকে। থাকবে না গৃহহীন ও সরকারি সহায়তা থেকে বঞ্চিত কোনো অভাবী মানুষ। জঙ্গি কিংবা সন্ত্রাসীদের হাতে অকালে প্রাণ দিতে হবে না কাউকে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ও মাকাল নেতৃত্বের পাগলা ঘোড়ারও লাগাম টেনে ধরা হবে শক্ত হাতে। একাত্তরের মতো কোনো নারী শিকার হবে না বুনো-পাশবিকতার ও যাবতীয় যৌন হয়রানির। তাছাড়া প্রগতিশীল শক্তিগুলোকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে ফ্যাসিস্ট উগ্র ধর্মান্ধ চক্র ও প্রতিক্রিয়াশীল শিবিরগুলো ধ্বংস করে দিতে হবে সত্যের প্রোপাগান্ডার লড়াইয়ে। সর্বোপরি জনকল্যাণে নিরলসভাবে কাজ করতে হবে দিন বদলে অঙ্গীকারাবদ্ধ আওয়ামী লীগ সরকারকে- সেই বিশ্বাসে বাঙালি জাতি এখনও অটল।
ঋণপত্র
বিজয় দিবস বিশ্বের বুকে বাঙালির একটি অহঙ্কারের নাম। বিশ্বের প্রতিটি জাতির জীবনে কিছু দিন আছে- যা সংশ্লিষ্ট দেশ ও জাতির মানুষের কাছে উপস্থিত হয় অন্যরকম এক অনুভূতি নিয়ে। যেসব দিনের স্মৃতি তাদের সব সময় উজ্জীবিত করে এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে প্রেরণা দেয়, শক্তি জোগায় দেশ ও জাতিকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার। যেমন- ফ্রান্সের বাস্তিল কারাগারের পতন দিবস ১৪ জুলাই (১৭৮৯ খ্রি.), রাশিয়ার সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব শুরু হওয়ার দিবস ৭ নভেম্বর (১৯১৭ খ্রি.)।
ঠিক তেমনিভাবে বাংলাদেশের মানুষের কাছে ১৬ ডিসেম্বর (১৯৭১ খ্রি.) একটি পরম গৌরবের, আনন্দের, অবিস্মরণীয় ও অনন্য সাধারণ দিন। এছাড়া ২৬ মার্চ আমাদের জাতীয় ও স্বাধীনতা দিবস। এরকম দিবস আছে সব দেশেরই। কিন্তু শতকরা ৯৫ ভাগ দেশেরই বিজয় দিবস নেই, আছে বাংলাদেশের। জিন্নাহ্ আর মহাত্মা গান্ধী মানচিত্র কেটে ব্রিটিশের সঙ্গে হ্যান্ডশেক করে স্বাধীনতার সনদ নিয়েছেন। সেই সুযোগ ছিল না আমাদের। আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে। আমাদের এই অর্জিত স্বাধীনতাকে ছিনিয়ে আনতে হয়েছে বুকের তপ্ত রক্ত ভিজিয়ে।
স্বাধীন বাংলাদেশের বয়স ৪৯ বছর হলেও আসলে সুসংঘবদ্ধ সমাজ হিসেবে আমাদের বয়স সাড়ে ৪ হাজার বছরের ওপরে। পরাধীন একটি জাতি, যাদের ইতিহাস হচ্ছে অবহেলা, বঞ্চনা আর শোষণের। এর কবর রচনা করে বাঙালি জাতিকে বিশ্বের বুকে নিজস্ব সত্তা নিয়ে ও স্বাধীনভাবে মাথা উঁচিয়ে বেঁচে থাকতে ‘বাংলাদেশ’ নামে নতুন একটি রাষ্ট্র্র দিয়ে গেছেন যে বিশাল রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, তিনি অন্য কেউ নন- জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁর কাছে বাঙালি জাতির শত-শতাব্দীর ঋণপত্র পরিশোধের নয়। দাসত্বের শৃঙ্খল হতে মুক্তি হতো না বঙ্গবন্ধুর জন্ম না হলে এবং তাঁর দু’বার মৃত্যুর রুজু ও যৌবনের ১৪টি বছর কারাগারের প্রহসন মাড়িয়ে আপসহীন নেতৃত্ব না পেলে।
লেখক: সহযোগী সম্পাদক, আজকের সূর্যোদয়, ঢাকা।