বিজয়ের ৪৯ বছর— স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে
১৬ ডিসেম্বর ২০২০ ২১:৫৮
ঢাকা: উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় ২০২১ সালে স্বাধীনতার ৫০ বছর তথা সুবর্ণজয়ন্তী পালন করবে বাংলাদেশ। একসময়ে ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’র খেতাব পাওয়া বাংলাদেশ আজ বিশ্বের ৪১তম অর্থনীতির দেশ। স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে বের হয়ে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে স্থান করে নিয়েছে বাংলাদেশ। সামাজিক বিভিন্ন সূচকে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশকে ছাড়িয়ে গেছে। এ প্রেক্ষাপটে অর্থনীতিবিদরাই বলছে, ১৯৭১ সালে যে দেশটির প্রায় ৮০ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যপীড়িত ছিল, স্বাধীনতাযুদ্ধে চূড়ান্ত বিজয়ের পর ৪৯ বছর পেরিয়ে বাংলাদেশ আজ সারাবিশ্বের কাছে উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে।
আজ ১৬ ডিসেম্বর। পাকিস্তানি শোষকগোষ্ঠীর কাছ থেকে স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনতে একাত্তরের ২৬ মার্চ যে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়, দীর্ঘ ৯ মাস পর ৪৯ বছর আগের এই দিনে সেই রক্তস্নাত মুক্তিযুদ্ধ শেষ করে মিলেছিল চূড়ান্ত বিজয়। সেই বিজয়ের ৪৯তম বর্ষপূর্তি উদযাপন করছে জাতি। ৩০ লাখ শহিদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে সেদিন যে বিজয় মিলেছিল, তা জাতিকে দিয়েছিল সার্বভৌমত্ব, নিজস্ব রাজনৈতিক পরিচয়।
কেবল রাজনৈতিক নয়, অর্থনৈতিক মুক্তিলাভও ছিল সেই মুক্তিসংগ্রামের অন্যতম অনুপ্রেরণা। কারণ সুজলা-সুফলা এই ভূখণ্ডকে অর্থনৈতিকভাবে চূড়ান্তভাবে শোষণ করেছিল পশ্চিম পাকিস্তানিরা। তাতে করে এ দেশের মানুষের রক্ত-ঘামে যা কিছু অর্থনৈতিক অর্জন ছিল, তার সবই ভোগ করত সেই শোষকগোষ্ঠী। এই জনপদের মানুষের প্রাপ্তি ছিল কেবলই অর্থনৈতিক বৈষম্য আর বঞ্চনা। তাই ১৯৪৭ সালের পর থেকে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার যে সংগ্রাম, তা কেবল পরাধীনতার শৃঙ্খল ভাঙার লড়াই নয়, ছিল র্অথনৈতিক মুক্তির সংগ্রামও।
স্বাধীনতা পূর্ববর্তী সময়ে এই ভূখণ্ডের জনগণ চরম অর্থনৈতিক শোষণ, বঞ্চনা ও বৈষম্যের শিকার ছিল। পাশাপাশি ক্ষুধা, অপুষ্টি, স্বাস্থ্যহীনতাসহ নানা কারণে মানুষের আয়ুষ্কালও ছিল অনেক কম। শিক্ষার হার ছিল নিম্ন পর্যায়ে। পর্যাপ্ত কর্মসংস্থানও ছিল না। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় লাভের পর সেই বাংলাদেশ গত ৪৯ বছরে পাহাড়সম নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে উন্নয়নের মহাসড়কে স্থান করে নেওয়া এক বিস্ময়ে পরিণত হয়েছে। এই প্রায় পাঁচ দশক সময়ে দারিদ্র্য বিমোচন, মাথাপিছু আয়, মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভসহ অর্থনৈতিক প্রায় প্রতিটি খাতেই অগ্রগতি দেখাতে সমর্থ হয়েছে। একই সময়ে উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে মাতৃমৃত্যু ও শিশুমৃত্যুর হার। বেড়েছে দেশের মানুষের গড় আয়ু। ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ নামে বিশ্বব্যাপী পরিচিতি দিয়েছে পোশাক খাত।
অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে পাওয়া তথ্য বলছে, স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে ৩০ জুন বাংলাদেশের প্রথম বাজেট উত্থাপন করা হয় জাতীয় সংসদে। সেই বাজেটের আকার ছিল মাত্র ৭৮৬ কোটি টাকা। ৪৯ বছর পেরিয়ে এসে চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরে বাজেটের আকার ৭২২ গুণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকায়। এছাড়াও বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) ১৯৭২ সালে ছিল ৫০১ কোটি টাকার, যা ২০২০ সালে এসে বেড়ে দাঁড়িয়েছে দুই লাখ পাঁচ হাজার কোটি টাকায়।
স্বাধীনতার ৪৯ বছর পর দেশের মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ৮ দশমিক ১৫ শতাংশ পর্যন্ত পৌঁছেছে। রেকর্ড এই জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছিল ২০১৮-২০ অর্থবছরে। সবশেষ ২০১৯-২০ অর্থবছরে অবশ্য এর পরিমাণ ছিল ৫ দশমিক ২৪ শতাংশ। তবে এর পেছনে ছিল বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাস সংক্রমণ পরিস্থিতি। এই মহামারিতে বিশ্বের অনেক দেশই যেখানে জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে নেতিবাচক ধারায় ছিল, সেখানে বাংলাদেশের ৫ দশমিক ২৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধিও অনেকের কাছেই বিস্ময়কর। করোনার অভিঘাত কাটিয়ে চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরেও ৮ দশমিক ২০ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি আশা করছে সরকার।
এদিকে, স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু গড় আয় ছিল মাত্র ১২৯ ডলার। বিদায়ী ২০১৯-২০ অর্থবছর শেষে বার্ষিক মাথাপিছু গড় আয় দুই হাজার ডলারের সীমা ছাড়িয়েছে— সুনির্দিষ্টভাবে বলছে তা ২ হাজার ৬৪ ডলার। অর্থাৎ ৪৯ বছরে দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় বেড়েছে প্রায় ১৬ গুণ। উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে আগে শতভাগ অর্থ বরাদ্দ করা হতো বৈদেশিক অনুদান থেকে। এখন প্রায় ৬৬ শতাংশ বরাদ্দই করা হয় দেশীয় সম্পদের উৎস থেকে। শুধু তাই নয়, ৩০ হাজার কোটি টাকারও বেশি অর্থের প্রকল্প স্বপ্নের পদ্মাসেতু পর্যন্ত নিজস্ব অর্থায়নে নির্মাণের সক্ষমতা অর্জন করেছে বাংলাদেশ।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, স্বাধীনতার পর ৪৯ বছরে আশানুরূপ অর্জন এসেছে রফতানি বাণিজ্যেও। ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে বাংলাদেশের রফতানি আয় হয় মাত্র ৩৪ কোটি মার্কিন ডলার। সবশেষে ২০১৯-২০ অর্থবছরে এর পরিমাণ ছিল ৪০ দশমিক ৬ বিলিয়ন বা চার হাজার ৬০ কোটি মার্কিন ডলার। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশেন মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) ছিল ৮ বিলিয়ন ৭৫ লাখ ডলার বা ৮০০ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। বর্তমানে জিডিপি‘র আকার ৩১ লাখ ৭১ হাজার ৮০০ কোটি টাকা।
অন্যদিকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভেও বাংলাদেশের অগ্রগতি ঈর্ষণীয়। মঙ্গলবারের (১৫ ডিসেম্বর) সবশেষ তথ্য বলছে, ৪২ বিলিয়ন বা ৪ হাজার ২০০ কোটি ডলারের সীমা পেরিয়ে গেছে এই রিজার্ভ। আবার ১৯৭১ সালে যেখানে দেশে প্রায় ৮০ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করত, সেখানে চলতি বছরের শুরুতে এর পরিমাণ ছিল ২০ দশমিক ৫০ শতাংশ। ১৯৭১ সালে মানুষের গড় আয়ু ছিল ৪৭ বছরের একটু বেশি। বর্তমানে গড় আয়ু ৭২ দশমিক ৬ বছর।
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক এমন অগ্রগতির বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, স্বাধীনতার ৪৯ বছরে দেশের আর্থসামাজিক ও অর্থনীতিতে অভূতপূর্ব উন্নয়ন হয়েছে। সামষ্টিক অর্থনীতির আকার বহু গুণে বেড়েছে। শিক্ষার হার, মাথাপিছু আয় ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বেড়েছে। দারিদ্র্য বিমোচনেও উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে বের হয়ে বাংলাদেশ এখন নিম্নমধ্যবিত্ত আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছে।
মির্জ্জা আজিজ বলেন, বর্তমানে বিশ্ববাজারের সঙ্গে আমাদের সম্পৃক্ততা বেড়েছে। রফতানি খাতে বেশ ভালো অগ্রগতি হয়েছে। একসময় জিডিপির অনুপাত হিসাবে রফতানি ছিল ৫ শতাংশ। বর্তমানে তা বেড়ে ১৫ থেকে ১৬ শতাংশে উন্নীত হয়েছে।
তবে বাংলাদেশের এই অগ্রগতি নিয়েও পুরোপুরি সন্তুষ্টি নেই মির্জ্জা আজিজের, যদিও এর পেছনে যৌক্তিক কারণ আছে বলেও মনে করেন তিনি। মির্জ্জা আজিজ বলেন, বাংলাদেশ যথেষ্ট উন্নতি লাভ করলেও বাংলাদেশের সমসাময়িক সময়ে যে দেশগুলো স্বাধীন হয়েছে, সেই দেশগুলোর অর্থনীতির অগ্রগতির তুলনায় আমাদের অর্জন কিছুটা মলিন। থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, মালয়শিয়া, দক্ষিণ কোরিয়ার মতো দেশগুলো থেকে আমরা কিছুটা পিছিয়ে রয়েছি। এর যথেষ্ট কারণও রয়েছে। তাদের সম্পদ অনেক বেশি, বিপরীতে জনসংখ্যা কম। অন্যদিকে আমাদের সম্পদ কম, জনসংখ্যা বেশি। আমরা ছিলাম সম্পূর্ণ কৃষিনির্ভর একটি দেশ। ফলে আমাদের তুলনায় তারা বেশি এগিয়েছে।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গর্ভনর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ সারাবাংলাকে বলেন, স্বাধীনতার ৪৯ বছরে বাংলাদেশের অর্থনীতির যথেষ্ট অগ্রগতি হয়েছে। স্বাধীনতার পর মাত্র ৭৮৬ কোটি টাকা দিয়ে আমাদের বাজেট শুরু করেছিলাম। বর্তমানে বাজেটের আকার সাড়ে পাঁচ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। আমাদের জিডিপি কয়েক হাজার গুণ বেড়েছে। এসব কিছু নিয়ে আমরা বলতেই পারি, আমাদের অর্থনীতির অগ্রগতি প্রশংসনীয়।
তিনি বলেন, আমাদের অর্থনীতি এই অগ্রযাত্রার প্রধান কারণ হলো ১ লাখ ৪৭ হাজার ৫৭০ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এই দেশটিতে বসবাসকারী জনগণ একসঙ্গে থাকি, এক ভাষায় কথা বলি, চালচলন, চিন্তাভাবনা এবং সামাজিক আচার আচরণ একই রকম। এটা বজায় রাখতে পারলে এবং কিছু রাজনৈতিক বিভাজন কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হলেও আমরা আরও এগিয়ে যাব।
বাংলাদেশের অর্থনীতির অগ্রগতিতে দুর্নীতিকে একটি বড় প্রতিবন্ধকতা বলে মনে করেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক এই ডেপুটি গভর্নর। তিনি বলেন, দুর্নীতি আমাদের অর্থনীতির অগ্রযাত্রাকে কিছুটা বাধাগ্রস্ত করেছে। দুর্নীতি যদি কমিয়ে আনা যেত, তাহলে আমাদের কর আদায় বেড়ে যেত। দেশের আর্থসামাজিক আরও উন্নতি হতো।
অর্থনৈতিক অগ্রগতি জিডিপি প্রবৃদ্ধি দারিদ্র্য বিমোচন বিজয় দিবস বিজয়ের ৪৯ বছর বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ মাথাপিছু আয় মুক্তিযুদ্ধ