‘জাহানারা ইমাম এসে আমাকে স্যালুট দিলেন’
১৬ ডিসেম্বর ২০২০ ২২:২৫
১৯৭২ সালের ৪ জানুয়ারি। পাকিস্তানি বাহিনীকে পরাজিত করে চূড়ান্ত বিজয় অর্জনের ১৯ দিন পরের কথা। ভারত থেকে শত্রুমুক্ত দেশে ফিরলেন মিনু বিল্লাহ। ছুটে গেলেন রাজারবাগের বাড়িতে। কিন্তু সেখানে পরিবারের কেউ নেই! হতচকিত মিনুকে বাড়িওয়ালি বুবু ছুটে এসে জানালেন, বাসা বদলে মগবাজার চলে গেছে পুরো পরিবার। মিনুকে সঙ্গে নিয়ে গেলেন সেখানে। বাড়ির গৃহ সহকারী দরজা খুলে দেয়। কিন্তু চিনতে না পেরে বাসায় ঢুকতে দেয় না কিছুতেই। মেয়েটির কাছ থেকে জানা গেল— ভাগ্নি শাওন মাহমুদকে নিয়ে মা ও বড় বোন গেছেন কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে। ভাইয়েরা সবাই বাইরে!
শেষ পর্যন্ত বাড়িওয়ালি বুবু’র কথায় মিনুকে বাসায় ঢুকতে দেয় মেয়েটি। সন্ধ্যার দিকে একে একে ফিরতে থাকেন ভাইয়েরা। বোনকে বুকে নিয়ে সে কী কান্নাকাটি! মিনু জীবিত অবস্থায় বাড়িতে থেকে ফিরে আসবেন— এমন আশাই যে ছেড়ে দিয়েছিলেন সবাই। এর মধ্যেই মা আমিনা বিল্লাহ, বড় বোন সারাহ মাহমুদ ও ভাগ্নি শাওন ফিরলেন কুমিল্লা থেকে। চলে আরেক দফা কান্নাকাটি। যুদ্ধদিনে যে মেয়েটিকে পরিবার-পরিজন ছাড়তে হয়েছে, থাকতে হয়েছে যুদ্ধের ময়দানে, চলে যেতে হয়েছে ভিনদেশে, সেই মেয়েটিই যে ফিরে এসেছে স্বাধীন বাংলার মাটিতে! আবেগ তাই সেদিন আটকে রাখতে পারেননি কেউ।
শিল্পকলায় অনন্য অবদান রাখার স্বীকৃতি হিসেবে রাষ্ট্রের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা ‘একুশে পদক‘ পাওয়া নৃত্যশিল্পী, কোরিওগ্রাফার মিনু বিল্লাহ এভাবেই যুদ্ধ শেষে পরিবারের কাছে ফিরে আসার দিনটির কথা বর্ণনা করছিলেন সারাবাংলার কাছে। মহান মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত এই মানুষটি একে একে তুলে ধরেন যুদ্ধদিনের কথা, বর্ণনা করেন কিভাবে ঘর ছেড়ে মুক্তিযুদ্ধে যুক্ত হয়ে পড়লেন— সেইসব কথা।
মিনু বিল্লাহ জানালেন, একাত্তরের ২৫ মার্চ যে তাণ্ডব শুরু করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী, এরপর তারা কোনোরকমে টিকে ছিলেন। মিনু তখন তরুণী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছেন। নাচের জন্য বেশ পরিচিত। প্রায়ই পাকিস্তানি বাহিনীর পক্ষ থেকে বাড়িতে লোকজন আসছিল মিনুকে ক্যান্টনমেন্টে গিয়ে নাচ দেখানোর অনুরোধ নিয়ে। একবার মা বলে দিলেন, মেয়ে গ্রামের বাড়ি।
এবার মিনুর পরিচিত নৃত্যশিল্পীদের নিয়ে আসা হলো। ততক্ষণে বিশ্বাসঘাতকের দল পাকিস্তানি বাহিনীকে বলে দিয়েছে, মিনুর পরিবার ‘মুক্তি’ করে। আর মিনুও ঢাকাতেই আছে। এবার আর উপায় পেলেন না মা আমিনা বিল্লাহ। বড় বোনের স্বামী সংগীতকার আলতাফ মাহমুদ বুদ্ধি করে মিনুর পায়ে ব্যান্ডেজ করে নিয়ে এলেন। বলা হলো, পা ভেঙে যাওয়ায় মিনু ক্যান্টনমেন্ট যেতে পারবেন না। তাও বুঝি শেষ রক্ষা হয় না। একপর্যায়ে মিনুকে পাঁজাকোলা করে রেখে আসা হল ধানমন্ডি ৩২-এ সুফিয়া কামালের বাড়ি। যে নাচ তাকে দিয়েছিল খ্যাতি আর মানুষের ভালোবাসা, সেই নাচের জন্যই মিনু ছিলেন পাকবাহিনীর নজরে। আর হলো না ঢাকায় থাকা। পরিবারকে ছেড়ে পথে নামতে হলো।
মেজ ভাইয়ের সঙ্গে অজানার পথে পাড়ি জমানো কিশোরী মিনু বিল্লাহ এসব কিছু ভাবতেই পারছিলেন না। তিনি শুধু জানতেন, বাঁচার জন্য যেতে হবে। মা, ভাই-বোন, আজন্ম পরিচিত ভালবাসার শহর ছেড়ে যাচ্ছেন। কোনোদিন ফিরতে পারবেন কি না, জানেন না। মুক্তিযোদ্ধা শাহাদাত চৌধুরীর ভরসায় ছাড়ছেন পরিবার। কোথায় যাচ্ছেন, কেন যাচ্ছেন, কিভাবে যাবেন— কিছুই জানেন না। শুধু জানেন, কেবল পরিবার নয়, দেশও ছাড়তে হচ্ছে। যাওয়ার সময় আমিনা বিল্লাহ মেয়ে মিনুকে বললেন— ‘আল্লাহ বাঁচায় রাখলে হাশরের ময়দানে দেখা হবে।’
আলতাফ মাহমুদ, সারাহ মাহমুদ, শিশু শাওন মাহমুদসহ সবাই মিলেই যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু শেষ মুহূর্তে আলতাফ মাহমুদ আর যাননি। ঢাকায় মুক্তিবাহিনীকে সাহায্য করতে থেকে যান। শাশুড়িকে বুঝিয়ে মিনুকে তার মেজ ভাইয়ের সঙ্গে পাঠিয়ে দেন শাহাদাত চৌধুরীর জিম্মায়।
একদিন লুকিয়ে গাড়ি নিয়ে শাহাদাত চৌধুরী এসে নিয়ে যান তাদের। কুমিল্লায় সীমান্ত পেরিয়ে চলে যান ভারতের আগরতলার বিশ্রামগঞ্জে (ফিল্ড সেক্টর ২)। পথেই দেখা হয় মিনুর জীবনের আরেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি কেকা করিমের সঙ্গে। সে সময় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্য কর্মকর্তা জাওয়াদুল করিম তার স্ত্রী কেকা ও দুই সন্তান নিয়ে যাচ্ছিলেন কলকাতার অস্থায়ী সরকারের কার্যালয়ে যোগ দিতে। কেকা করিমের ভালোবাসা আজও শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন মিনু হক। অনিশ্চিতের পথে পাড়ি দেওয়া ১৮ বছরের মিনু কিছুটা স্বস্তি ফিরে পান তাদের সান্নিধ্যে।
বিশ্রামগঞ্জ যাওয়ার পথটুকুর স্মৃতিচারণ করলেন মিনু। বললেন, পথের নানা বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে তারা প্রথমে পৌঁছান কুমিল্লা। মাথার ওপর উড়ে যেত তীব্রগতির বুলেট। সারাক্ষণ প্রাণের ভয়। প্রাণে বাঁচবেন কি না, নিশ্চিত ছিলেন না। মিনু বলছিলেন, ‘হলিউডের সিনেমায় যেরকম যুদ্ধের দৃশ্য দেখায়, সেসব আমরা চোখের সামনে দেখেছি।’ সেই অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়েই কোনোক্রমে প্রাণটা হাতে নিয়ে প্রথমে কুমিল্লা, পরে সেখান থেকে সীমান্ত পেরিয়ে বিশ্রামগঞ্জ পৌঁছান। সেখানকার হাসপাতালে যোগ দেন সেবিকা হিসেবে। সুলতানা কামালরাও তখন সেখানে। বন্ধুদের পেয়ে যেন প্রাণ ফিরে পান মিনু। শুরু হলো নতুন এক অধ্যায়।
অল্প কিছুদিনের প্রশিক্ষণ শেষে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা দিতে শুরু করেন মিনু। একসময় ক্ষত, আঘাত, রক্ত— সব চোখ সয়ে যায়। আহত মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে গল্প করতেন, তাদের ওষুধ দিতেন, খাইয়ে দিতেন। সেসব দিনের স্মৃতি যেন এখনো চোখে ভাসে তার। খাবার বলতে সবজি আর কাঁকরওয়ালা চালের নরম খিচুড়ি। পাত পেড়ে বসে তাই খেতেন দলবেঁধে। কিন্তু কষ্টের থেকেও মিনুর স্মৃতিতে ভাসে সেখানে কাটানো ভালো সময়টুকু।
বিশ্রামগঞ্জ হাসপাতাল আর আর্মি ক্যাম্প বিশাল এলাকাজুড়ে। জমি দিয়েছিলেন এক বাঙালি ভদ্রলোক। মিনু বলেন, ওখানে গাছভর্তি ছিল পেয়ারা। সারাদিন সেগুলো খেয়েই পেট থাকত ভরা। পেছনে একটা পুকুরে সাঁতার কেটে গোসল করতাম বাকি মেয়েদের সঙ্গে। মাঝে মধ্যে লাল কাঁকড় বিছানো পথে হেঁটে যেতাম সুলতানা কামালদের সঙ্গে। এর মধ্যেই শুনতাম দুঃসহ সব খবর। অনিশ্চিত ভবিষ্যত কবে শেষ হবে— কিছুই জানতাম না।’ যুদ্ধের ডামাডোলে অষ্টাদশী তরুণী জীবন নিয়ে স্বপ্ন দেখতেও যেন ভুলে গিয়েছিলেন। কোথায় মা-ভাই-বোন, কোথায় স্মৃতির শহর, কোথায়ই বা তার নাচের মঞ্চ!
অথচ কিছুদিন আগেও সবকিছু কত সুন্দর ছিল! রাজনৈতিক অস্থিরতা আঁচ করতে পেরেছিলেন যদিও। কিন্তু দেশছাড়া হতে হবে, যে কথা স্বপ্নেও ভাবেননি। মিনু বলেন, সত্তর সালের ডিসেম্বরে নাচ করতে গেলাম জাকার্তা। সেখানে পাকিস্তানিদের আচরণে কিছুটা অস্বাভাবিকতা দেখতে পাই। ৭ মার্চের ভাষণের দিনও বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছিলাম প্র্যাকটিকাল খাতা আনতে। আসা-যাওয়ার পথেই শুনলাম বঙ্গবন্ধুর সেই রক্তে কাঁপনতোলা গর্জন। কিছু একটা হবে, বুঝতে পারছিলাম। কিন্তু এমন বিধ্বংসী যুদ্ধের কথা ভাবতেও পারিনি আমরা। বাড়ি ছাড়ার পর তো কঠিন সব সময়। বাড়ির কথা ভেবে ভীষণ কষ্ট হতো। তবে বিশ্রামগঞ্জে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের কষ্ট অনুভব করে সব ভুলে থাকার চেষ্টা করতাম।
আবারও ফিরে যাই পাকিস্তান আমলে। তখনকার পূর্ব-পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকায় এক মধ্যবিত্ত মুসলিম পরিবারে জন্ম মিনু বিল্লাহর। বাবা মেহতের বিল্লাহ ছিলেন কমলাপুর এলাকার একজন সংগীতশিল্পী। তিন বোনের মধ্যে মিনু মেজ। বড় বোন সারাহ মাহমুদের সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল বিখ্যাত সংগীতকার আলতাফ মাহমুদের। ছোট বোন বিখ্যাত নাট্যব্যক্তিত্ব শিমুল ইউসুফ। তিন বোন ছাড়াও ছিল আরও পাঁচ ভাই। পুরো পরিবারটিই ছিল শিল্পমনা। বিল্লাহ পরিবারের ছেলেমেয়েরা ধর্মীয় আচার-আচরণ শিখেছেন, পালন করেছেন। আবার নাচগানেও ছিল না কোনো বাঁধা। আর ছোট্ট মিনু যেন ছিলেন প্রজাপতির মতো। হাসতে হাসতে বলছিলেন, ‘আমি ছিলাম একদম টমবয়। সেসময় ঢাকা তো আর এখনকার মতো ছিল না। বাড়ির চারদিকে গাছপালা, পুকুর আর খোলামেলা জায়গা। প্রজাপতির মতো ছুটে বেড়াতাম সারাদিন।’ এভাবেই হাসতে হাসতে, গাইতে গাইতে নাচের সঙ্গে জুড়ে যান মিনু হক।
পাঁচ বছর বয়সে প্রতিবেশী দুলাল তালুকদারের কাছেই নাচের শুরু। বাংলাদেশে তখন নাচের জগতে পুরুষ নৃত্যশিল্পীদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন দুলাল। তার হাত ধরেই পরবর্তী সময়ে বুলবুল ললিতকলা একাডেমিতে যাতায়াত শুরু। কাকে দেখেননি সেখানে! চোখ বড় বড় করে বলছিলেন মিনু— ওই সময়ে বাংলাদেশের এমন কোনো বড় মানুষ ছিলেন না যারা বুলবুল ললিতকলা একাডেমিতে যেতেন না। চিত্রশিল্পী, সংগীতশিল্পী, লেখক, সাংবাদিক, কবি থেকে শুরু করে শিল্প-সাহিত্য জগতের সব রথী-মহারথীই যেতেন সেখানে।
বাসাবো বৌদ্ধ মন্দিরের পাশে তাদের বাসার সেই স্মৃতি এখনো ভুলতে পারেন না বাংলাদেশ নৃত্যশিল্পী সংস্থার সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা মিনু হক। নৃত্যশিল্পী মিনু হক নন, আমাদের আজকের জানা ও চেনার চেষ্টা মুক্তিযোদ্ধা মিনু হককে। যদিও নাচের জন্যই দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন। তাই নাচ থেকে কিছুতেই আলাদা করা যায় না মুক্তিযোদ্ধা মিনু হককে। ঘুরেফিরেই আসে খেলাঘর, বুলবুল তালুকদার, রোকনুজ্জামান দাদাভাইদের কথা। আর যার কথা বারবার আসে, তিনি সুফিয়া কামাল। সুফিয়া কামালের দুই মেয়ে সুলতানা কামাল আর সাইদা কামাল জড়িয়ে আছেন মিনু হকের জীবনের পরতে পরতে। সাইদা কামালের সঙ্গে বন্ধুত্বের সুবাদেই সেই বাড়িতে ছিল তার অবাধ যাতায়াত।
‘সেই সময়ের ঢাকা যে কী সুন্দর ছিল, এখন শুনলে বিশ্বাস করবে না! ঢাকা মেডিকেল, মিন্টু রোড, ধানমন্ডি ৩২ নম্বর অসাধারণ সুন্দর ছিল। কৃষ্ণচূড়া আর জারুল ফুটে থাকত থরে থরে। আমরা সেসব দেখতে যেতাম। আমি আর সাইদা ফুলশোভিত ৩২ ধরে হেঁটে বেড়াতাম। অদ্ভুত ভালো লাগত’,— স্বপ্নালু চোখে বলে চলেন মিনু।
বললেন, বঙ্গবন্ধুর বাড়িও গিয়েছেন কয়েকবার। নিজ চোখে দেখেছেন জাতির জনককে। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার বোন শেখ রেহানার সঙ্গেও ছিল পরিচয়। ‘সেই ঢাকাকে কী বানিয়ে ছাড়ল পশ্চিম পাকিস্তানিরা,’— আফসোস ঝরে পড়ে তার কণ্ঠে। মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পর ১৯৭২ সালের ৪ জানুয়ারি ঢাকায় ফিরে ভাঙাচোরা রাস্তাঘাট আর ঘরাবড়ি দেখে হারিয়ে ফেলেন সমস্ত বোধশক্তি। বাড়ি ফিরে কাউকে জীবিত দেখবেন কি না— সেই চিন্তাও যেন করার সাহস পাচ্ছিলেন না।
১৯৫৩ সালে সংস্কৃতিমনা বিল্লাহ পরিবারে জন্ম মিনু বিল্লাহর। মতিঝিল সেন্ট্রাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে ১৯৬৮ সালে ম্যাট্রিকুলেশন (এখনকার এসএসসি), ১৯৭০ সালে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন। তারপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন মনোবিজ্ঞানে। স্কুল আর কলেজ জীবনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে মুখে হাসির রেখা ফুটে উঠছিল তার। বড় খেলার মাঠ, সংস্কৃতি চর্চা, বান্ধবীদের সঙ্গে কাটানো মধুর সময় গল্প যেন ফুরোয় না। সেসময়ে পাকিস্তানি বান্ধবীদের চেহারা আজও স্পষ্ট চোখে ভাসে মিনুর। সেই তারাই যে এমন দূরের হয়ে যাবে, বাঙালিদের সঙ্গে এমন করবে— তখন চিন্তাও করেননি।
মুক্তিযুদ্ধের সময় বিল্লাহ পরিবার ছিল রাজারবাগ পুলিশ ফাঁড়ির খুব কাছেই। ২৫ মার্চের কালো রাতে যেন প্রলয় নেমে আসে ঢাকা শহরে। অপারেশন সার্চলাইটের প্রথম হামলা হয় রাজারবাগের সেই পুলিশ ফাঁড়িতেই। কোনোমতে প্রাণ নিয়ে পালাতে থাকা এক রিকশাওয়ালা তাদের জানান, কীভাবে পাকিস্তানিরা হামলা করেছে, কীভাবে নির্বিচারে খুন করছে বাঙালিদের দেখলেই। মিনুরা দেখেন— রাজারবাগ পুলিশের জওয়ানরা লুঙ্গিতে গিট্টু দিয়ে অস্ত্র হাতে পালাচ্ছেন একটা নিরাপদ আশ্রয় খুঁজে পালটা জবাব দেওয়ার আশায়। হামলার শিকার রাজারবাগ থেকেই অবশ্য গড়ে ওঠে প্রথম প্রতিরোধ।
যুদ্ধ শেষে দেশে ফিরে আসার যাত্রাটাও সহজ ছিল না। ১৬ই ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হলে বিশ্রামগঞ্জ থেকে কলকাতা চলে যান সুলতানা কামালদের সঙ্গে। ওঠেন কেকা করিম আর জাওয়াদুল করিমের আস্তানায়। জাওয়াদুল করিমের চাচার বাড়ির ঠিকানা ছিল ৫/২, লোয়ার সার্কুলার রোড, কলকাতা-১৬। সেখানেই উঠেছিলেন তারা। আর সেই বাড়িতেই আশ্রয় মেলে মিনু হকদের।
রাস্তার উল্টোপাশেই মাদার তেরেসার বাড়ি। মাদার তেরেসা তাদের দেখলেই নাকি বলতেন, ‘স্বাধীন হবে। স্বাধীন হবে।’ কেকা বুবুর স্নেহে দুঃসহ সেসব দিন ভুলে থাকতে চেষ্টা করতেন মিনু হক, সুলতানা কামালরা। এদিকে বাংলাদেশে ফেরার জন্য যে রিফিউজি ট্রেন চালু হয়, সেখান মাত্র দুই জনকে একসঙ্গে টিকেট দেওয়া হতো। এদিকে মিনুকে রেখে সুলতানা কামালরা দুই বোনও ফিরবে না। পরে ডিসেম্বরের শেষের দিকে কেকা করিমদের সঙ্গে রওনা দেন দেশে। রাস্তাঘাট নেই, ভাঙাচোরা রেলপথ— সব পার হয়েই জানুয়ারির ৪ তারিখ মুক্ত স্বাধীন বাংলাদেশে পৌঁছালেন তারা। কেকা করিম নিজে সঙ্গে করে সবাইকে যার যার ঠিকানায় পৌঁছে দেন। মিনুকে ছাড়তে এসে দেখেন সেখানে কেউ নাই। তারপর তো ফিরে পান পরিবারের সবাইকে। মেয়েকে মায়ের হাতে বুঝিয়ে দিয়ে নিজ বাড়ি ফেরেন কেকা করিম।
সেই রাতে তাকে দেখতে, একজন নারী মুক্তিযোদ্ধাকে নিজ চোখে দেখতে নিজে গাড়ি চালিয়ে জামিকে নিয়ে এসেছিলেন স্বয়ং জাহানারা ইমাম। মিনুর কথায়, ‘উনি এসে আমাকে রীতিমতো স্যালুট দিলেন। সেই অনুভূতি কখনোই ভোলার মতো নয়।’ জাহানারা ইমাম চান মিনুকে সঙ্গে করে নিয়ে যেতে। কিন্তু মা ছাড়েন না। পরে অবশ্য আমিনা সন্তানদের নিয়ে আসামে তার বাবার বাড়ি বেড়াতে যান। থাকেন দু’মাস। সেই দু’মাস জাহানারা ইমামের কাছে ছিলেন মিনু। আজ এই পড়ন্ত বেলাতেও মহীয়সী সেই নারীর কথা ভেবে চোখ আর্দ্র হয়ে ওঠে মিনুর। সময়ের ফেরে আজ মিনু হক গুলশানের যে বাড়িতে থাকেন, সেটির মালিক ইমাম পরিবার। এভাবেই যেন ইতিহাসের সঙ্গে মিশে আছেন মিনু হক।
ইতিহাসের স্বাক্ষী মিনু বিল্লাহ স্বাধীন দেশে ফিরে এসে ১৯৭২ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি ফের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাসে ফিরে যান। নতুন স্বদেশ। সেই সাজানো সুন্দর ঢাকা হয়তো নেই, কিন্তু তবুও নিজের দেশ। মুক্ত বাতাসে প্রাণ খুলে নিঃশ্বাস নেওয়ার সেই আনন্দ ভাষায় প্রকাশ করতে পারেন না মিনু। ১৯৭৪ সালে অনার্স আর ১৯৭৬ সালে মাস্টার্স শেষ করেন। ওই বছরই প্রকৌশলী শহিদুল হকের সঙ্গে বিয়ে হয়। ওই সময় থেকে মিনু হক নামে পরিচিতি হতে থাকেন। মনোবিজ্ঞানে পড়াশোনা করলেও নাচ ঘিরেই আবর্তিত হতে থাকে তার জীবন। দুই সন্তানের জননী মিনু হক এখন বাংলাদেশ নৃত্যশিল্পী সংস্থার সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন।
দেশের বর্তমান পরিস্থিতি কষ্ট দেয় বলে জানালেন মুক্তিযোদ্ধা মিনু। এত হিংসা, বিদ্বেষ আর সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্পে ভরা এই দেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে দীর্ঘশ্বাস বের হয়। তবে তার আশা— তরুণরাই বদলে দেবে দেশের চেহারা। তিনি যেমন ১৮ বছর বয়সে কিছু না ভেবে দেশের জন্য নেমেছিলেন যুদ্ধের ময়দানে, পাড়ি দিয়েছিলেন সীমান্ত, তেমনি এখনকার তরুণরাও দেশের টানে সময়কে ঘুরিয়ে দেবে বলেই তার বিশ্বাস। বিশেষ করে মেয়েদের প্রতি তার অগাধ বিশ্বাস। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যেমন একা হাতে দক্ষ নেতৃত্বে এগিয়ে নিচ্ছেন দেশকে, তার মতো অন্য নারীরা যার যার জায়গা থেকে এগিয়ে এসেছেন সংস্কৃতি ও স্বাধীনতার চেতনাকে সমুন্নত রাখতে, তেমনিভাবেই নারীরা এগিয়ে নেবে এই দেশ। বদলে দেবে আগামীর বাংলাদেশকে— আশা এই বীর বাঙালি নারীর।
২০১৮ সালে সংস্কৃতিতে অবদানের জন্য একুশে পদক পেয়েছেন মিনু বিল্লাহ। পেয়েছেন মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতিও। তবে রাষ্ট্রীয় কোনো সম্মাননা পাননি। তবে তাকে সবচেয়ে কষ্ট দেয় নারীদের আলাদা করে দেখার সংস্কৃতি। এখনো কোনো অনুষ্ঠানের একটি কোণায় নারী মুক্তিযোদ্ধাদের বসার জায়গা আলাদা রাখা হয়। মিনু বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধা তো মুক্তিযোদ্ধাই। কোনো মুক্তিযোদ্ধার অবদানকেই ছোট করে দেখার সুযোগ নেই। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্মের ইতিহাসে প্রতিটি মুক্তিযোদ্ধার অবদানই অনন্য।’ নারী-পুরুষের সেই সাম্য শুধু নয়, অর্থনৈতিক মুক্তি ও সামাজিক ন্যায় বিচারের যে বোধ নিয়ে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়তে মুক্তিযুদ্ধে ঝঁপিয়ে পড়েছিলেন— সেই বাংলাদেশ দেখে যেতে চান মিনু।
ছবি কৃতজ্ঞতা: মিনু হক ও শাওন মাহমুদ
আলতাফ মাহমুদ জাহানারা ইমাম নারী মুক্তিযোদ্ধা বিশ্রামগঞ্জ মিনু বিল্লাহ মুক্তিযোদ্ধা শাওন মাহমুদ সেবিকা