‘শহিদ চিকিৎসকদের নামে একটিও মেডিকেল কলেজ হয়নি’
১৭ ডিসেম্বর ২০২০ ২০:৩৭
ঢাকা: স্বাধীন বাংলাদেশ গড়ে তোলার স্বপ্ন নিয়ে নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধ শেষে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের সূর্য দেখা যায় বাংলার আকাশে। নয় মাসের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ শেষে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উড়তে থাকে সবখানে। এই নয় মাসের সশস্ত্র যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল বাংলাদেশের সব শ্রেণি-পেশার মানুষ। মুক্তিযুদ্ধের সময় চিকিৎসকরাও ছিলেন অগ্রণী ভূমিকায়। একইসঙ্গে মেডিক্যাল কলেজের শিক্ষার্থী, কলেজ ও হাসপাতালের নানা শ্রেণির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা নানাভাবে অবদান রেখেছেন মুক্তিযুদ্ধে। এদের মধ্যে কেউ কেউ অস্ত্র হাতে সরাসরি যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন, কেউ কেউ যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসাসেবা দিয়েছেন। আবার অনেকেই মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র সরবরাহে সাহায্য করে এবং তথ্য দিয়েও সহযোগিতা করে ভূমিকা রাখেন। সর্বোপরি যুদ্ধ চলাকালীন নানাভাবে দেশ ও সাধারণ জনগণের পাশে ছিলেন বাংলাদেশের চিকিৎসক সমাজ। কিন্তু জাতি এ পর্যন্ত তাদের যথাযথ সম্মানও দিতে পারেনি। দেশের কোনো একটি মেডিকেল কলেজও তাদের নামে হয়নি।
চতুর্থ জেনেভা কনভেনশনের আর্টিকেল চার অনুযায়ী, চিকিৎসক, নার্স, অ্যাম্বুলেন্স চালকসহ হাসপাতালের কাজে ভূমিকা রাখা স্বাস্থ্যকর্মীরা নিরপেক্ষ হিসেবে বিবেচিত হবেন। তারা কখনোই আক্রমণের শিকার হবেন না। হাসপাতাল বিবেচিত হবে নিরপেক্ষ স্থান হিসেবে। কিন্তু পাকিস্তান সেনাবাহিনী জেনেভা কনভেনশন লঙ্ঘন করে মুক্তিযুদ্ধের সময়ে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করে চিকিৎসকদের। শুধুমাত্র হাসপাতালেই নয়, বাসা থেকে বাইরে ডেকে নিয়ে গিয়েও হত্যা করা চিকিৎসকদের। প্রায় শতাধিক চিকিৎসকসহ অনেক মেডিকেল স্টুডেন্ট ও স্বাস্থ্যকর্মী শহিদ হন মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে।
চক্ষু বিশেষজ্ঞ ডা. আবদুল আলীম চৌধুরীকে ১৯৭১ সালের ১৫ ডিসেম্বর আল-বদর বাহিনী তার বাসা থেকে ধরে নিয়ে রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে নির্মমভাবে হত্যা করে। ডা. ফজলে রাব্বীকেও একইদিন বিকেলে পাকবাহিনীর কয়েকজন সৈন্য ও বদরবাহিনীর সদস্যরাও সিদ্ধেশ্বরীর বাসা থেকে নিয়ে যায়। ১৮ ডিসেম্বর রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে পাওয়া যায় তার ক্ষতবিক্ষত মৃতদেহ। ১৯৭১ সালের ১৫ নভেম্বর বদরবাহিনীর একটি দল ঢাকার ২২ ফ্রি-স্কুল স্ট্রিটের হাকিম হাউজের সামনে থেকে ডা. আজহারুল হককে ধরে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যায়। ১৬ নভেম্বর নটরডেম কলেজের কাছে কালভার্টের নিচে তাঁর চোখ, হাত ও পা বাঁধা বিকৃত মরদেহ পাওয়া যায়।
১৯৭১ সালের ৯ এপ্রিল। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন যুদ্ধাহতদের চিকিৎসাসেবা দেওয়ার অপরাধে পাকবাহিনী হত্যা করে তৎকালীন সিলেট মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের (বর্তমান এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল) প্রধান সার্জারি চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. শামসুদ্দীন আহমদ ও শিক্ষানবিশ চিকিৎসক শ্যামল কান্তি লালাকে। একইসঙ্গে হত্যা করে হাসপাতালের অ্যাম্বুলেন্সচালক কোরবান আলী ও অপারেশন থিয়েটারের নার্স মাহমুদুর রহমানকেও। এ হত্যাকাণ্ডের পরপর ১৪ এপ্রিল ওই মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ ও হাসপাতালের সুপারিনটেনডেন্ট লেফটেন্যান্ট কর্নেল ডা. আবুল ফজল জিয়াউর রহমানকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তুলে নিয়ে যায় পাকিস্তানি বাহিনী। এরপর তার আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। এভাবেই অধ্যাপক ডা. হুমায়ুন কবীর, ডা. আজহারুল হক, ডা. সোলায়মান খান, ডা. আয়েশা বদেরা চৌধুরী, ডা. কসির উদ্দিন তালুকদার, ডা. মনসুর আলী, ডা. মোহাম্মদ মোর্তজা, ডা. মফিজউদ্দীন খান, ডা. জাহাঙ্গীর, ডা. নুরুল ইমাম, ডা. এস কে লালা, ডা. হেমচন্দ্র বসাক, ডা. ওবায়দুল হক, ডা. আসাদুল হক, ডা. মোসাব্বের আহমেদ, ডা. মোহাম্মদ শফীকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয় মুক্তিযুদ্ধে।
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি ও বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. সারওয়ার আলী সারাবাংলাকে বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের সময় অন্যান্য পেশাজীবীদের মতো দেশের চিকিৎসক সমাজ, মেডিকেল শিক্ষার্থী ও হাসপাতালের নানা শ্রেণির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা অবদান রেখেছেন নানাভাবে। সবাই হয়তো অস্ত্র হাতে নিয়ে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারেননি। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র সরবরাহ থেকে শুরু করে তথ্য আদান-প্রদান, ওষুধ বিতরণ ও যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা শুশ্রুষায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিল বাংলার চিকিৎসকরা। পেশাগত দিকে শতাংশ হিসেবে বিবেচনা করলে সবচেয়ে বেশি প্রাণ হারিয়েছিল চিকিৎসকরাই।’
মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট বিষয়ে ডা. সারোয়ার আলী বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধ তো বহুমাত্রিক কর্মযজ্ঞ। এর একটা দীর্ঘ প্রস্তুতি পর্ব ছিল। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ গণহত্যার পরে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। আমাদের আন্দোলন সংগ্রামের শুরুটা কিন্তু ভাষা আন্দোলন দিয়েই হয়। এই আন্দোলনের সময় ঢাকা মেডিকেল কলেজে (ঢামেক) যে ব্যারাকগুলো ছিল সেখানে যে ছাত্রনেতারা উপস্থিত ছিলেন তারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। আমাদের প্রথম যে শহিদ মিনার হয় সেটিও কিন্তু ডা. বদরুল আলমের নকশায় হয়। ২১ ফেব্রুয়ারির পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধিকাংশ সময়েই জমায়েত সম্ভব হতো না। অধিকাংশ সময়েই তাই বৈঠক হতো মেডিকেল কলেজের ব্যারাকগুলোতে। যেখানে ডা. আহমেদ রফিক, ডা. শরফুদ্দিন, ডা. সালামসহ আরও অনেকেই তখন কেন্দ্রীয় অবস্থানে ছিলেন। যদিও তখন তারা শিক্ষার্থী ছিলেন।’
তিনি বলেন, ‘এরপর পূর্ব-পাকিস্তানে সামরিক শাসন পরবর্তী সময়ে ও ১৯৬২ সালের ছাত্র আন্দোলনেও চিকিৎসকদের একটা বড় ভূমিকা দেখা যায়। এ সময় এখানে যারা নেতৃত্বে ছিলেন তাদের একটা বড় ভূমিকা ছিল। ৬২-এর ছাত্র আন্দোলনে ছাত্র সংসদের সহ-সভাপতি ছিলেন ডা. নুরুল আলম ও সাধারণ সম্পাদক ছিলেন ডা. জাফরউল্লাহ চৌধুরী। ৬৩ ও ৬৪ সালের দিকে ডা. মির্জা সোবহান সহ-সভাপতি ও আমি সাধারণ সম্পাদক ছিলাম। আমরা যারা মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র ছিলাম তারা কিন্তু সকল আন্দোলনেরই অংশ নিয়েছিলাম ঐতিহাসিকভাবেই।’
মুক্তিযুদ্ধের পূর্বে চিকিৎসকদের সংগঠন বিষয়ে জানিয়ে ডা. সারোয়ার আলী বলেন, ‘বিশ্বের সকল দেশেই চিকিৎসকদের আলাদা একটি কেন্দ্রীয় সংগঠন থাকে। যেমন- বাংলাদেশে এখন বিএমএ। সে সময় পাকিস্তানেও ছিল। পাকিস্তান মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের দুইটি শাখা ছিল। এর একটি পশ্চিমাঞ্চল ও অপরটি পূর্বাঞ্চল শাখা। এই পূর্বাঞ্চল শাখাটিই পরে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন হয়, যা বিএমএ নামে পরিচিত। এই পূর্বাঞ্চল ও পশ্চিমাঞ্চলের মধ্যে প্রথম থেকেই একটা বিরোধ ছিল গঠনতন্ত্র নিয়ে। এই গঠনতন্ত্রে উল্লেখ ছিল, স্বাস্থ্যগত কোনো বিষয়ে যদি রাজনৈতিক কোনো অবস্থান নেয় সরকার তখন তার পক্ষে অবস্থান নেবে মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন। কিন্তু সেক্ষেত্রে পশ্চিমাঞ্চলের শাখার এতে আপত্তি ছিল। যেহেতু সামরিক চিকিৎসকদের অংশগ্রহণ চেয়েছিল তারা। তখন মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের ডা. এস এম জি মান্নান, ডা. টি আলী, ডা. কাশেমসহ আরও অনেকেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। পরবর্তী সময়ে পাকিস্তান মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের যুগ্ম আহবায়ক হয়েছিলেন ডা. আবদুল আলীম চৌধুরী। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়েই এটির নাম হয়ে যায় বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন, যার সভাপতি ছিলেন ডা. তৈয়ব আলী ও সাধারণ সম্পাদক ছিলাম আমি।’
তিনি বলেন, ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের দুইজন ছাত্র অভিযুক্ত হিসেবে ছিলেন। ১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে পাকিস্তান মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের পূর্বাঞ্চল শাখার সম্মেলন হয়। সেখানে আমি সাধারণ সম্পাদক হয়েছিলাম। মার্চ মাসে যখন অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয় তখন পাকিস্তান মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের পূর্বাঞ্চল শাখা সরাসরি অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দিয়েছিল।’
মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতির নিয়ে ডা. সারোয়ার আলী বলেন, ‘১৯৭১ সালের ২২ মার্চ কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে চিকিৎসকদের একটি সভা আয়োজন করা হয়। এই আয়োজনে মূল ভূমিকা পালন করেন ১৯৭১ এর ১৪ ডিসেম্বর শহিদ হওয়া ডা. আলিম চৌধুরী। তখন তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজের চক্ষু বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ছিলেন। ২৫ মার্চ সন্ধ্যার সময় ডা. আলিম চৌধুরীর সঙ্গে কথা হয় আমাদের। তখনও আসলে আমাদের ধারণা ছিল না যে, রাতেই মর্টার, ট্যাংক নিয়ে হত্যাযজ্ঞে নেমে যাবে পাকিস্তান সেনাবাহিনী। আমাদের ধারণা ছিল যে, হয়তোবা আগের মতো অতিমাত্রায় গুলিবর্ষণ হতে পারে। আর তাই আমরা সেইভাবে পরিকল্পনা করি। ঢাকা শহরের বিভিন্ন এলাকায় কীভাবে ফার্স্ট এইড নেওয়া যায় সেগুলো নিয়ে সকলকে কিছু দায় দায়িত্ব দেওয়া হয়। সেসময় সর্বোচ্চ প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসার বিষয়ে। একইসঙ্গে যাতে কোনোভাবেই সাধারণ জনগণের ক্ষতি না হয়। এ সময় নয়টি উইংয়ে ভাগ করা হয়। এর দায়িত্বে ছিলেন ডা. আলীম চৌধুরী এবং ডা. ফজলে রাব্বী।’
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পরবর্তী সময়ের স্মৃতিচারণ করে ডা. সারোয়ার আলী বলেন, ‘সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পরে বিভিন্ন প্রেক্ষাপট সামনে আসে; যার প্রথমটিই হলো সরাসরি অস্ত্র হাতে নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করা। ডা. শাহ্ আলমসহ অনেক চিকিৎসক সে সময় সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। এ সময় শুধুমাত্র পুরুষ চিকিৎসকই নয়, নারী চিকিৎসকরাও কিন্তু যোগ দিয়েছিলেন। কেউ দেশের অভ্যন্তরে, আবার কেউ বা বর্ডার পার হয়ে ট্রেনিং ক্যাম্পে অংশ নেন। তারা সেখানে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা দেন নিরলসভাবে। মুজিবনগর সরকারের সময় স্বাস্থ্য সচিব ছিলেন ডা. টি হোসেন। তার অধীনে মেডিকেল অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন ডা. কাজী তামান্না।’
তিনি বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন যে বাংলাদেশ হাসপাতাল হয়েছিল সেখানে ডা. সেতারাসহ আরও অনেকে অংশ নেন। এটি ডা. জাফরউল্লাহ চৌধুরী, ডা. কামরুজ্জামান ও ডা. মবিন খান চালাতেন। যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছেন তারা। এছাড়াও শরণার্থী শিবিরে অন্যান্য চিকিৎসকরাও অংশ নেন। এ সময় আমরা বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে ভারতীয় মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের কাছে একটা পত্র লিখেছিলাম। এর পর ভারতীয় মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা থেকে ওষুধ নিয়ে আমাদের শরণার্থী শিবিরে সরবরাহ করে। কূটনৈতিকভাবেও কিন্তু চিকিৎসকরা কাজ করেছে মুক্তিযুদ্ধের সময়ে।’
ডা. সারোয়ার আলী বলেন, ‘দেশের অভ্যন্তরে নানাভাবে চিকিৎসা কার্যক্রম চালিয়ে যুদ্ধাহতদের সেবা দেওয়ার কারণে নানাভাবে নজরবন্দি ছিলেন চিকিৎসকরা। তবে এই নজরবন্দি যতটা না করেছে পাকিস্তান সেনাবাহিনী তার চেয়ে বেশি করেছে আমাদের দেশে থাকা রাজাকার, আলবদর, আল শামস বাহিনীর সদস্যরা। ডা. ফজলে রাব্বির বাসা ছিল ভিকারুন্নেসা স্কুলের পেছনের দিকে। যদি নজরদারি না থাকতো তবে এত সহজে তাদের ধরা যেত না। ডা. আলিম চৌধুরীর ক্ষেত্রে দেখা গেছে মাওলানা মান্নান নিজেই পাকিস্তানিদের কাছে তথ্য দিয়েছে।’
গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী সারাবাংলাকে বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের সময় আমরা চিকিৎসকরা মূলত তিনভাবে কাজ করেছি। যতগুলো শরণার্থী শিবির ছিল সেখানে সাহায্য করি। মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে সেবা প্রদান করে চিকিৎসকরা। প্রায় পাঁচ হাজার চিকিৎসক মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন গঠন করে টাকা পয়সা দিয়ে সাহায্য করে। তাদের অর্থায়নে আমরা তৈরি করি বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতাল। তারা প্রতিনিয়ত আমাদের ওষুধ পাঠাতেন। এমনকি সামরিক যন্ত্রাদিও কিনে পাঠাতেন।
তিনি বলেন, ‘যদি পাকিস্তান আমলের কথা বলা হয় তবে সেই সময়ে দেশের অবস্থা পরিবর্তনের জন্য সব আন্দোলনে সোচ্চার ভূমিকা পালন করেছে চিকিৎসকরা। আমরা মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন এপ্রিল মাসেই বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন করে ফেলেছিলাম। প্রবাসী সরকার গঠন হওয়ার আগেই আমরা এটি করি।’
তিনি আরও বলেন, ‘তুলনামূলকভাবে তখনকার দিনে কিন্তু দেশে রোগ বেশি ছিল। কলেরা, ম্যালেরিয়াসহ নানারকম রোগ মহামারী আকারে আসতো। সে কারণে আমাদের চিকিৎসকদের সাধারণ মানুষের সঙ্গে বেশি কাজ করার সুযোগ ঘটতো। আর তাই তাদের সঙ্গে আমাদের সংযোগটা বেশি ছিল। আমাদের চিকিৎসকদের একটা বড় অংশ কিন্তু ভারতে যাননি। দেশের অভ্যন্তরেই যুক্ত ছিলেন নানাভাবে মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে। ডা. আজিজুর রহমান, ডা. আহমেদ রবি, ডা. জোহরা কাজী, আলী আজগর, ফজলে রাব্বি, ডা. এস আলম, আলীম চৌধুরীসহ আরও অনেকে দেশের অভ্যন্তরে থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য সহযোগিতা করেছেন।’
ডা. জাফরউল্লাহ বলেন, ‘প্রবাসী সরকারকে সাহায্যের সময়েও কিন্তু চিকিৎসকরা ভূমিকা রেখেছে। ডা. সৈয়দ মোদাসসের আলী, ডা. সৈয়দ টি হোসেনরা সরাসরি সরকারকে সাহায্য করেছেন। সামরিক বাহিনীতে থাকা কিছু চিকিৎসকও কিন্তু মুক্তিযুদ্ধে আমাদের পক্ষে ভূমিকা রেখেছিলেন। বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী বিলেতের যে আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তাকে সবচাইতে বেশি সাহায্য করেছেন সেখানকার চিকিৎসকরা।’
তিনি বলেন, ‘বিপদে কাউকে যখন কেউ সাহায্য করে তখন সেটা সারাজীবন মনে রাখতে হয়। আর যেখানে বিষয়টা রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে হয় তখন রাষ্ট্রেরই দায়িত্ব যারা তার জন্য কাজ করছে তাদের সম্মানিত করা। আমরা বঙ্গবন্ধুকে জাতির পিতা হিসেবে সব সময়ই স্মরণে রাখব। কিন্তু অন্যরাও যারা বঙ্গবন্ধুকেও জীবিত রেখেছেন তারই আদর্শ ধারণ করেন, নির্দেশনা মেনে চলেন তাদের নামে কিছু না করাটা দুর্ভাগ্যজনক ও খারাপ।’
ডা. জাফরুল্লাহ শহিদ চিকিৎসকদের স্মরণ করে বলেন, ‘দুর্ভাগ্যক্রমে উনাদের একজনের নামেও বাংলাদেশে কোনো প্রতিষ্ঠান নেই। যে কারণে নতুন প্রজন্মের অনেক চিকিৎসক জানে না তাদের পূর্বসূরিদের গৌরবময় লড়াকু ইতিহাস। বঙ্গবন্ধু আমাকে বলেছিলেন, ডা. ফজলে রাব্বি ও ডা. আলীম চৌধুরীদের নামে কিছু একটা করেন। কিন্তু আমি বলেছিলাম, ব্যক্তিকে সম্মানিত করা সরকারের দায়িত্ব। এটা আমি করব না, আপনিই করেন। দুর্ভাগ্যবশত এর পরে বঙ্গবন্ধু মারা যান। তারপর থেকে এখন পর্যন্ত চিকিৎসকদের নামে কোনো মেডিকেল কলেজ হয়নি। ফরিদপুর মেডিকেল কলেজের নাম ডা. জোহরা কাজীর নামে ও ডা. ফজলে রাব্বির নামে পাবনা মেডিকেল কলেজ নামকরণ করার প্রস্তাবও উঠেছিল। কিন্তু আমরা কোনোটাই করিনি, সম্মানও দিইনি।