মাইম্যান বৃত্তেই বন্দি থাকছে তৃণমূল আ.লীগ!
২১ ডিসেম্বর ২০২০ ১০:৩৭
ঢাকা: কেন্দ্রের কঠোর অবস্থানের পরেও বিভিন্ন ফাঁকফোকর গলে মাইম্যান বৃত্তেই বন্দি হয়ে পড়ছে তৃণমূল আওয়ামী লীগ। সম্প্রতি অনুমোদিত জেলার পূর্ণাঙ্গ কমিটিগুলো অনুমোদন দেওয়ার পর তৃণমূল থেকে এই অভিযোগ উঠে এসেছে। কমিটিতে ঠাঁই পেয়েছে তৃণমূলের বিভিন্ন প্রভাবশালী বলয়ের নেতারা। এতে তৃণমূলে মাইম্যান নেতাদের পাল্লাই ভারি হয়ে উঠেছে। তৃণমূলে বিভিন্ন স্তরের কমিটিতে মাইম্যানদের বাদ দিয়ে দুর্দিন-দুঃসময়ের ত্যাগীদের কমিটিতে স্থান দিতে আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনা থাকলেও তা পুরোপুরি বাস্তবায়ন হচ্ছে না।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এস এম কামাল হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, ‘কমিটি করার ক্ষেত্রে আমাদের নেত্রীর গাইডলাইনগুলো দেখা হয়। সততা, দক্ষতা, সংগঠনের প্রতি আস্থা এবং সংগঠন করার ক্ষেত্রে একজন নেতার যে গ্রহণযোগ্যতা- এগুলো বিবেচনা নিয়েই কমিটিগুলো করা হয়। আমাদের নেত্রী এবং দলের সাধারণ সম্পাদকও বলেছেন যাদের দিয়ে দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হবে তাদের এবার কোনো কমিটিতে নেতা বানানো হবে না। তবে সহযোগী সংগঠনগুলোর যে কমিটি হয়েছে আমি মনে করি না যে, হান্ড্রেড পার্সেন্ট স্বচ্ছ হয়েছে। বলা যায়, প্রায় স্বচ্ছ হয়েছে। দুয়েকটা নিয়ে প্রশ্ন থাকতে পারে। জেলা কমিটিগুলো যাচাই-বাছাই করে স্বচ্ছ লোকদের দলের রাখার চেষ্টা করা হয়েছে। দুয়েকজনের নামে বিভিন্ন রকমের কমপ্লেইন দিয়েছে অনেকে। কিন্তু তদন্ত সাপেক্ষে দেখা যাচ্ছে, আদৌ তাদের বিরুদ্ধে এ ধরনের কোনো কর্মকাণ্ড নেই। স্বচ্ছতা দেখেই এই কমিটিগুলো অনুমোদন দিয়েছেন আমাদের নেত্রী।’
এসএম কামাল আরও বলেন, ‘জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ এখন বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ বড় দল। দলের ভেতর প্রতিযোগিতা থাকবে, প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকবে। এত বড় দল, ঐতিহ্যবাহী দল, মুক্তিযুদ্ধের দল। সেজন্য প্রতিযোগিতা-প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে ব্যক্তিগতভাবে আমিও পছন্দ করি। এতে দল গতিশীল হয় এবং দলকে এগিয়ে নিয়ে যায়। প্রতিযোগিতা হবে ভালোয় ভালোয়। খারাপের সঙ্গে ভালোর প্রতিযোগিতা হবে না। আমরা মনে করি, প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে দলটা এগিয়ে যাবে এবং দল জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ ।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দলের কয়েকজন নেতা বলেন, আমরা দীর্ঘদিন ক্ষমতায় আছি এ কারণে দেখা যাচ্ছে, দুভার্গ্যজনকভাবে তৃণমূলে ক্ষমতার বলয় সৃষ্টি হয়েছে। একই দল করলেও সেখানে মতের অমিল হচ্ছে, বিরোধ সৃষ্টি হচ্ছে। অনেক জায়গায় সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়েছে, বিভিন্ন বলয়, উপবলয় তৈরি হয়েছে। এ কারণে অনেক জায়গায় অনেক কিছু চাইলেও কেন্দ্র থেকে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা যাচ্ছে না। তবে আমাদের চেষ্টার কমতি নেই।
এর আগে তৃণমূলের পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠনে অনেক স্থানে ‘মাইম্যান’ ও অনুপ্রবেশকারীদের স্থান না দিতে নির্দেশ দেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গণভবনে আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকে শেখ হাসিনা এ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। বৈঠকে শেখ হাসিনা বলেন, ‘তৃণমূলে পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে দলের দুর্দিন-দুঃসময়ের ত্যাগী-পরীক্ষিত নেতাদের ঠাঁই দিতে হবে। কোনো নেতা বা এমপির প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে কমিটি গঠন করা যাবে না। ছাত্রদল-যুবদল, শিবির, ফ্রিডম পার্টি করা লোকজন আওয়ামী লীগের কমিটিতে ঢুকবে আর আমার দলের জন্য যারা ঝুঁকি নিয়েছেন, ত্যাগ স্বীকার করেছেন তারা জায়গা পাবেন না- তা হবে না।’ সেদিন করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতির কারণে সীমিত পরিসরে এ সভা অনুষ্ঠিত হয়। দলের ৩২ জন নেতা এতে উপস্থিত ছিলেন। এদিন আট বিভাগে আওয়ামী লীগের আটটি সাংগঠনিক টিমও গঠন করা হয়। এই টিমগুলোর জন্য বিভাগের সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডের সার্বিক তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব সুনির্দিষ্ট করা হয়।
সম্প্রতি কেন্দ্র থেকে কয়েকটি সাংগঠনিক জেলার পূর্ণাঙ্গ কমিটি অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এসব কমিটিতে অনেক বিতর্কিত ব্যক্তির ঠাঁই হয়েছে। অতীতে ছাত্রদল-ছাত্রশিবিরের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত থেকেও কমিটিতে ঠাঁই পেয়েছেন। ছাত্রলীগ, যুবলীগসহ অন্য সংগঠনের রাজনীতিতে অতীতে কোনো পদে না থেকেও অনেকে এক লাফে জেলা আওয়ামী লীগের মতো হাইপ্রোফাইল কমিটিতে ঠাঁই করে নিয়েছেন।
সম্প্রতি ফেনী, রংপুর জেলা, মহানগর, রাজশাহী মহানগর, বগুড়া, বান্দরবান ও কুমিল্লা উত্তর, চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা কমিটি অনুমোদন হয়েছে। চলতি ডিসেম্বরের ১ তারিখে অনুমোদন দেওয়া হয় কুমিল্লা উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের কমিটি। এ কমিটিতে বড় দুটি পদ যুদ্ধাপরাধী পরিবারের সদস্যরা বাগিয়ে নিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা কমিটিও অনুমোদন দেওয়া হয়েছে সম্প্রতি। সেখানেও কয়েকজন বিতর্কিত ও লো-প্রোফাইলের লোকজন কমিটিতে ঠাঁই করে নিয়েছেন।
বলয়ের প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে এসব লোকদের জেলা কমিটির মতো গুরুত্বপূর্ণ কমিটিতে জায়গা হয়েছে বলে জোর গুঞ্জন রয়েছে। এছাড়া জেলার এক নেতার পরিবার থেকে একই কমিটিতে ছয়জনকে নেতা বানানো হয়েছে। বগুড়া জেলা কমিটিতেও জীবনে কখনও আওয়ামী লীগ করেনি, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সরকারবিরোধী স্ট্যাটাস দেওয়া লোকসহ মাদকাসক্তরাও ঠাঁই পেয়েছেন। এমনকি রংপুর মহানগর কমিটিতে শিবিরের নেতা ছিলেন এমন দুয়েকজনের ঠাঁই হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
বিতর্কিতদের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর কবির নানক। তিনি বলেন, ‘কেউ যদি কোন ফাঁকফোকর গলিয়ে কমিটিতে ঢুকে পড়ে, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
অনুপ্রবেশকারী জেলা কমিটি পূর্ণাঙ্গ কমিটি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ শেখ হাসিনা