করোনা ‘নিরাপদ’ দেশের তালিকায় বাংলাদেশ ২০তম, দ. এশিয়ায় সেরা
২৩ ডিসেম্বর ২০২০ ১৭:১৫
ঢাকা: বিশ্বে নভেল করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) সংক্রমণসহ অর্থনীতিতে করোনার অভিঘাত মোকাবিলায় কার্যকর ভূমিকা রাখা দেশগুলোর র্যাংকিং করেছে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম ব্লুমবার্গ। বিশ্বব্যাপী করোনা সংক্রমণ শুরুর পর থেকে বিশ্বের ৫৩টি দেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক মানদণ্ডে মহামারি মোকাবিলার সক্ষমতা নিয়ে ১০টি সূচকের ওপর ভিত্তি করে এই র্যাংকিং করা হয়। তালিকায় করোনার সার্বিক অভিঘাত মোকাবিলার সক্ষমতা বিবেচনায় বিশ্বে বসবাস উপযোগী নিরাপদ দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ২০তম। দক্ষিণ এশিয়ার আর কোনো দেশ এই তালিকায় বাংলাদেশের ওপরে নেই। এমনকি জার্মানি, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের মতো দেশগুলোও রয়েছে এই তালিকায় বাংলাদেশের পেছনে। প্রতিমাসের তথ্য নিয়ে করা এই জরিপ তালিকায় শীর্ষস্থানে রয়েছে নিউজিল্যান্ড।
ব্লুমবার্গে প্রকাশিত তথ্যে বলা হয়, সামাজিক, অর্থনৈতিক বিভিন্ন দিক এবং কোভিড-১৯ সংক্রমণ ও মৃত্যুহার বিবেচনা করে এই ‘কোভিড রেজিলিয়েন্স র্যাংকিং’টি করা হয়। সংক্রমণ ও মৃত্যুহার নিয়ন্ত্রণে রেখে সামাজিক অগ্রগতির বিভিন্ন সূচক পরিমাপে জরিপে ৮৫ দশমিক ৬০ স্কোর নিয়ে শীর্ষস্থানে রয়েছে নিউজিল্যান্ড। দেশটিতে গত মাসে প্রতি লাখে আক্রান্তের সংখ্যা মাত্র ২ জন। আর প্রতি ১০ লাখে মৃত্যু ৫। এছাড়াও টিকার আওতায় রয়েছে ২৪৬ শতাংশ মানুষ। তালিকার দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে তাইওয়ান। তাদের আক্রান্ত সংখ্যা প্রতি লাখে আরও কম— মাত্র একজন। প্রতি ১০ লাখে মৃত্যু শূন্য। টিকার আওতায় রয়েছেন ২৬ দশমিক ২ শতাংশ নাগরিক। সব মিলিয়ে দেশটির স্কোর ৮২ দশমিক ৪০।
ব্লুমবার্গে প্রকাশিত জরিপের তালিকায় তৃতীয় স্থানে আছে অস্ট্রেলিয়া (স্কোর ৮১)। শীর্ষ দলের বাকি দেশগুলো হলো— নরওয়ে (৭৭), সিঙ্গাপুর (৭৬.২), ফিনল্যান্ড (৭৫.৮), জাপান (৭৪.৫), দক্ষিণ কোরিয়া (৭৩.৩), চীন (৭২) ও ডেনমার্ক (৭০.৮)। এর পরের অবস্থানগুলোতে থাকা দেশগুলো হলো— কানাডা (৭০), ভিয়েতনাম (৬৯.৭), হংকং (৬৮.৫), থাইল্যান্ড (৬৮.৫), আয়ারল্যান্ড (৬৭.৩), সংযুক্ত আরব আমিরাত (৬৫.৬), ইসরায়েল (৬২.৪), রাশিয়া (৬১.৭), নেদারল্যান্ডস (৬১.৩) ও বাংলাদেশ (৫৯.২)।
ব্লুমবার্গে প্রকাশিত জরিপে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে ৫৯ দশমিক ২ স্কোর নিয়ে শীর্ষে (তালিকার ২০তম অবস্থানে) আছে বাংলাদেশ। তবে মহামারির সূচকে আক্রান্তের সংখ্যা ও মৃত্যুহার নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ এগিয়ে থাকলেও টিকাপ্রাপ্তির সম্ভাবনার সূচকে পিছিয়ে আছে। ব্লুমবার্গের আগের মাসের র্যাংকিংয়ে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ২৪। অর্থাৎ এ মাসে চার ধাপ এগিয়েছে বাংলাদেশ।
জরিপের ফলাফলে দেখা যায়, বাংলাদেশে প্রতি লাখে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা ৩৪ জন। মাসে মৃত্যুহার ১ দশমিক ৬ শতাংশ। প্রতি ১০ লাখে ৪৪ জন মারা গেছেন বাংলাদেশে। তবে টিকার আওতায় রয়েছে মাত্র ৫ শতাংশ জনগণ। জীবনযাত্রার মান নির্ণায়ক সূচকগুলোর মধ্যে জিডিপি আর যোগাযোগ ব্যবস্থার গতির দিক থেকে এগিয়ে থাকলেও বাংলাদেশ এখনো পিছিয়ে রয়েছে জনজীবনে লকডাউনের প্রভাব আর স্বাস্থ্যসেবার মানের দিক থেকে।
জরিপে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের মধ্যে পাকিস্তানের অবস্থান ২৯-এ। দেশটিতে প্রতি লাখে আক্রান্তের হার ৩৮ জন। আর ১০ লাখে মৃত্যুর হার ৪২ জন। টিকার আওতায় রয়েছেন ২৬ শতাংশেরও বেশি মানুষ। ব্লুমবার্গের সূচক অনুযায়ী তাদের মোট স্কোর ৫৪ দশমিক ৪। তালিকায় ৩৯তম অবস্থানে থাকা ভারতের স্কোর ৫০। দেশটিতে প্রতি লাখে আক্রান্তের হার ৬৯ জন। আর ১০ লাখে মৃত্যুর হার ১০৫ জন। টিকার আওতায় রয়েছেন ৮৫ শতাংশেরও বেশি মানুষ।
তালিকায় যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান যথাক্রমে ৩০তম ও ৩৭তম। ৩৫ দশমিক ৩ পয়েন্ট নিয়ে তালিকার সবার পেছনে ৫৩তম অবস্থানে আছে মেক্সিকো।
যা বলছেন সংশ্লিষ্টরা
দেশে করোনা সংক্রমণ ও মৃত্যুহার কম থাকা বিষয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) অধ্যাপক ডা. কনক কান্তি বড়ুয়া সারাবাংলাকে বলেন, আমাদের দেশে কোভিড-১৯-এর যে স্ট্রেইন দেখা গেছে, সেটি হয়তো তুলনামূলকভাবে দুর্বল। সে কারণে আমাদের দেশে সংক্রমণের মাত্রা কম হওয়ার সম্ভাবনা আছে। একইসঙ্গে মৃত্যুহারও কম। এক্ষেত্রে আসলে বলা যায় তিনটি কারণে আমাদের দেশে কোভিড-১৯ সংক্রমণ মাত্রা কম। প্রথমত, ভিরুলেন্স অব দ্য ভাইরাস। দেখা যায় ভিরুলেন্স কমলে তার বিস্তার লাভের ক্ষমতা বাড়ে, এটা প্রায় সব ভাইরাসের ক্ষেত্রেই সত্য। এখানেও তাই হয়েছে। দ্বিতীয়ত, কী পরিমাণ ভাইরাল লোড আছে, তার ওপরও নির্ভর করতে পারে। তৃতীয়ত, যারা সংক্রমিত হচ্ছেন, তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কেমন? সবকিছু মিলিয়েই আসলে রোগীর ওপরে রোগের প্রভাব বোঝা যায়।
তিনি বলেন, আমাদের দেশে যে ভাইরাসটি এসেছে, সেটির ভিরুলেন্স হয়তো তেমন বেশি নেই বলেই সংক্রমণ ও মৃত্যুহার কম। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে ইমিউনিটি বা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কেমন। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশে হয়তো মানুষদের মধ্যে এই ইমিউনিটি শক্তিশালী ছিল।
করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলা করে দেশের অর্থনীতিতে গতিশীল রাখার ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী সিদ্ধান্তের প্রশংসা করেন অধ্যাপক ডা. কনক কান্তি বড়ুয়া। তিনি বলেন, আমাদের এখানে সংক্রমণ ও মৃত্যুহার নিয়ন্ত্রণে রেখে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ধরে রাখার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বগুণের অবদান রয়েছে। শুরুর দিকেই বিভিন্ন রকমের প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করা ও কল-কারখানা সময়মতো খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্তগুলো কাজে লেগেছে। দেখা গেছে, আমরাও কিন্তু কল-কারখানা খোলার সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছিলাম। এখন মনে হচ্ছে যে প্রধানমন্ত্রী সিদ্ধান্ত নিয়ে যদি সেই সময় কল-কারখানা না খুলতেন, তাহলে মানুষ দুর্ভিক্ষেই হয়তো মারা যেত।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের মুখপাত্র ও এমআইএস শাখার পরিচালক ডা. মো. হাবিবুর রহমান সারাবাংলাকে বলেন, বাংলাদেশ এখনো কোভিড-১৯ পরিস্থিতি সামলে অনেক ভালো অবস্থানে আছে। আমরা মনে করি আমাদের দেশে সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার কম থাকার অন্যতম কারণ হলো সকলের সম্মিলিত উদ্যোগ। দেশে হিসেবে আমরা এখনো মধ্য আয়ের দেশ হয়ে উঠতে পারিনি। তারপরও আমরা আমাদের দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে পেরেছি। পাশাপাশি আমরা কিন্তু করোনাভাইরাসকেও নিয়ন্ত্রণে রেখেছি। একদিকে ভাইরাসকে নিয়ন্ত্রণে রেখে অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে পারার কারণে বাংলাদেশ বর্তমানে ভারত, ইরানসহ অন্যান্য বিভিন্ন দেশের চাইতে ভালো অবস্থানে আছে। এক্ষেত্রে এটি খুব স্বাভাবিক বিষয়।
তিনি বলেন, করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণে আমাদের যে সফলতা, তাতে চিকিৎসক-নার্স-স্বাস্থ্যকর্মীসহ আপনাদের গণমাধ্যমকর্মীদেরও বিশাল ভূমিকা আছে। গণমাধ্যমকর্মীরা আমাদের বিভিন্ন বিষয়ে সংবাদ সংগ্রহ করেছেন এবং একইসঙ্গে জনগণের কাছে আমাদের সচেতনতামূলক বার্তাগুলোও পৌঁছে দিয়েছেন। এছাড়াও প্রশাসন, পুলিশসহ অন্যান্য বিভাগের সবাই আমাদের সাহায্য করেছেন। বলা যায়, গোটা জাতিই একটা বিশাল ভূমিকা রেখেছে করোনা নিয়ন্ত্রণে। পাশাপাশি যথাসময়ে লকডাউন দেওয়া ও উঠিয়ে নেওয়াসহ গণপরিবহন খুলে দেওয়ার মতো সিদ্ধান্ত নেওয়ার কারণেও আমাদের পরিস্থিতি এখন অনেক ভালো অবস্থায় আছে। আমাদের জিডিপির হার যে বেড়েছে, এর অন্যতম কারণ হলো আমাদের সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টা।
স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব মো. আবদুল মান্নান সারাবাংলাকে বলেন, বাংলাদেশের এই অবস্থান আসলে এক ধরনের বড় স্বীকৃতি। এর কৃতিত্ব প্রধানমন্ত্রীর, যিনি আমাদের সার্বক্ষণিকভাবে পরামর্শ দিয়ে গাইড করে যাচ্ছেন। একইসঙ্গে প্রেরণা দিয়ে তিনি প্রতিদিন সাহায্য করে যাচ্ছেন হতাশ না হওয়ার জন্য। বাংলাদেশে করোনার সফলতার মূল চালিকাশক্তি হলেন প্রধানমন্ত্রী। প্রতিদিনই তিনি যেসব গাইডলাইন দিয়ে যাচ্ছেন, তার জন্যই বাংলাদেশের অবস্থান এখনও ভালো।
করোনা নিরাপদ দেশ করোনা মোকাবিলা করোনাভাইরাস কোভিড-১৯ বাংলাদেশ ২০তম ব্লুমবার্গ র্যাংকিং