Friday 27 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

‘আইডিয়াল’ ব্র্যান্ড নিয়ে চলছে ব্যবসা!


১১ ডিসেম্বর ২০১৭ ১৩:৫৫

মেসবাহ শিমুল, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট

বেসরকারি শিক্ষাখাতের সবচেয়ে বড় সমস্য মানসম্পন্ন অবকাঠামো। পর্যাপ্ত ক্লাসরুম কিংবা লাইব্রেরি কক্ষ যেখানে নেই সেখানে খেলার মাঠতো কেবল স্বপ্ন! ভাড়া করা বাড়ি কিংবা কোনো ভবনের কয়েকটি কক্ষ কিংবা দুয়েকটি ফ্লোর নিয়ে গড়ে উঠছে এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। যাদের কেউ কেউ একই কক্ষে চালিয়ে নিচ্ছেন নার্সারি থেকে একাদশ শ্রেণির পাঠদান। তাদের নামের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে স্কুল অ্যান্ড কলেজ। তবে নাম যাই হোক তাদের আগে পিছে থাকছে ব্র্যান্ড ‘আইডিয়াল’।

বিজ্ঞাপন

আকর্ষণ সৃষ্টিই লক্ষ্য
রাজধানীর মতিঝিল এজিবি কলোনির শিক্ষানুরাগী বাসিন্দাদের উদ্যোগে ১৯৬৫ সালের ১৫ মার্চ ঢাকার প্রাণকেন্দ্র মতিঝিলে আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। ১৯৬৮ সালে জুনিয়র স্কুল এবং স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে এটি পূর্ণাঙ্গ হাই স্কুলে উন্নীত হয়। ১৯৭৩ সালে এই স্কুলের শিক্ষার্থীরা প্রথমবারের মত এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে ঈর্ষণীয় ফলাফল অর্জন করে। এরপরই বেসরকারি শিক্ষাখাতে আইডিয়াল একক ব্র্যান্ডে পরিণত হয়। সাম্প্রতিক সময়ে আডিয়ালের ধারাবাহিকতায় একে একে ন্যাশনাল আইডিয়াল, যাত্রাবাড়ী আইডিয়াল, রাজধানী আইডিয়াল, সিটি আইডিয়াল, ডেমরা আইডিয়ালসহ এমন অসংখ্য প্রতিষ্ঠান নিজেদের নামের সঙ্গে আইডিয়াল যুক্ত করে ব্যবসায়িকভাবে সাফল্য পেয়েছেন। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান শিক্ষাখাতেও সফলতা দেখিয়েছেন আশানুরুপ।

তবে ‘আইডিয়াল ব্র্যান্ড’ এখন কেবল রাজধানীই নয় দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়েছে। উদ্যোক্তারা বলছেন, মতিঝিল আইডিয়ালের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে প্রতিষ্ঠানের নাম রাখায় তারাও ব্যবসায় ভালো করছেন। এমনকী সিলেবাস প্রণয়ন এবং শিক্ষা ক্যারিকুলামে তারা উক্ত প্রতিষ্ঠানকেও কোনো কোনো ক্ষেত্রে অনুসরণ করে থাকেন।

বিজ্ঞাপন

এ বিষয়ে সিলেট আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের চেয়ারম্যান নুরুর রহমান সারাবাংলাকে বলেন, ২০০৮ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে শিক্ষাসেবায় মূল আইডিয়ালকে অনুসরণ করে সাফল্য পেয়েছেন। এতে অভিভাবকদের মধ্যেও ব্যাপক সাড়া পড়েছে।

এ বিষয়ে ওই বিদ্যালয়টির অভিভাবক মোখলেসুর রহমান জানান, ঢাকায় আইডিয়াল স্কুলের অনেক সুনাম রয়েছে। সিলেটে ওই নামে স্কুল প্রতিষ্ঠার পর প্রথমে তারা ভেবেছিলেন এটি মূল আইডিয়ালেরই অংশ। তবে এখন তারা এটাকে একটি স্বতন্ত্র শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবেই জানেন। শিক্ষার মানের দিক থেকে মোটামুটি সন্তুষ্টও বলে জানান।

রাজধানীতে প্রতিবছরই হচ্ছে নতুন প্রতিষ্ঠান
ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাপকে ইতিবাচক হিসেবেই দেখছেন এ খাতের উদ্যোক্তারা। জনসংখ্যার ঘনত্ব দেখে তাই প্রতিবছরই শহরের বিভিন্ন এলাকায় গড়ে উঠছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। তবে নতুন এসব প্রতিষ্ঠানের নামের সঙ্গে কোনো না কোনো ভাবে যুক্ত হচ্ছে আইডিয়াল ব্র্যান্ডটি। তবে যারা স্বতন্ত্র নামে আসছেন তাদের প্রতিষ্ঠা পেতে অপেক্ষাকৃত বেশি সময় লাগছে বলে জানা গেছে।

এ বিষয়ে, ২০১৮ সালে কার্যক্রম শুরু হওয়া রাজধানীর মেরুল এলাকার নিউ নেশন আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ মাহবুবুর রহমান সারাবাংলাকে বলেন, আইডিয়াল নামটি শিক্ষাক্ষেত্রে নিঃসন্দেহে একটি ব্র্যান্ড। স্বাভাবিকভাবে এ নামটির প্রতি অভিভাবকদের দূর্বলতা রয়েছে। শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের সহজে আকৃষ্ট করতে তারাও প্রতিষ্ঠানের এমন নামকরণ করেছেন। তবে প্রতিষ্ঠানের শিক্ষা কার্যক্রম কিংবা পরিচালনা পর্ষদের সঙ্গে মতিঝিল আইডিয়ালের কোনো সম্পর্ক নেই।

চটকদার বিজ্ঞাপণ, আছে চতুরতাও 

মধ্য অক্টোবর থেকেই রাজধানীর বেসরকারি বিদ্যালয়গুলো নেমেছে প্রচারণার কাজে। রঙ-বেরঙের ব্যানার, পোস্টার, ফেস্টুন, লিফলেট শোভা পাচ্ছে অলিগলিতে। কেউ কেউ বড় বড় দেয়ালে নিজেদের বিজ্ঞাপন দিয়ে শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের মনযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করছেন। চটকদার এসব বিজ্ঞাপণ কাণ্ডে কোনো স্থানের স্বাভাবিক সৌন্দর্য্য নষ্ট হলেও ভর্তি মৌসুমের এমন কর্মযজ্ঞকে স্বাভাবিক হিসেবে দেখছেন সংশ্লিষ্টরা। তবে এমন চটকদার বিজ্ঞাপণের পরও কেউ কেউ জুড়ে দিচ্ছেন চতুরতাও। এক্ষেত্রে শিক্ষাঙ্গণে পরিচিত কোনো শিক্ষাবিদকে ব্যবহার করছেন একাধিক প্রতিষ্ঠান। তাদেরই একজন মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ একেএম নিয়াজ। যিনি বর্তমানে রাজধানীর বনশ্রী এলাকার আব্দুর রাজ্জাক স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে নিয়োজিত রয়েছেন।

অনুসন্ধানে দেখা যায়, আব্দুর রাজ্জাক স্কুল অ্যান্ড কলেজের ২০১৮ শিক্ষাবর্ষের বিভিন্ন প্রচার কার্যক্রমে একেএম নিয়াজকে অধ্যক্ষ হিসেবে দেখানো হয়েছে। ব্যানার, পোস্টার কিংবা লিফলেটই নয়, প্রতিষ্ঠানটি প্রসপেক্টাসেই তার নাম শোভা পাচ্ছে অধ্যক্ষ হিসেবে। এই একই ব্যক্তিকে একই শিক্ষাবর্ষে অধ্যক্ষ হিসেবে ঘোষণা করেছে আফতাবনগর আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজও। তারাও তাদের প্রসপেক্টাসহ যাবতীয় প্রচারকাজে একেএম নিয়াজকে অধ্যক্ষ হিসেবে প্রচার করছে।

এ বিষয়ে অধ্যক্ষ একেএম নিয়াজ সারাবাংলাকে বলেন, সব প্রতিষ্ঠানই চায় ভালো লোকগুলোকে সামনে রেখে এগিয়ে যেতে। আফতাবনগর আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ এবার কলেজের কার্যক্রম শুরু করবে বলে আমাকে জানিয়েছে। আমি তাদের সঙ্গে থাকব বলে কথা দিয়েছি। তবে একই সঙ্গে একাধিক প্রতিষ্ঠানে থাকা যায় কি না এমন প্রশ্ন এড়িয়ে যান তিনি।

প্রতিষ্ঠান ব্যক্তিমালিকানার, শিক্ষকরা সাময়িক

বেসরকারি এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে কেবলমাত্র ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে। এক্ষেত্রে মালিকানা হচ্ছে একক কিংবা যৌথ। সমমনা কয়েকজন মিলে বাসাবাড়ি ভাড়া নিয়ে গড়ে তুলছেন প্রতিষ্ঠান। বহুতল ভবনের কোনো ফ্লোর কিংবা কয়েকটি কক্ষ নিয়ে যাত্রা শুরু করে ব্যবসা ভালো হলে টিকে থাকছেন, না হলে ছেড়ে দিচ্ছেন উদ্যোক্তারা। তবে যারা ব্যবসার পাশাপাশি কোয়ালিটি এডুকেশন দেয়ার চেষ্টা করছেন, তারা টিকে থাকছেন। বড় করছেন প্রতিষ্ঠানকে। আর ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে না পারলে ১০-১৫ বছরের প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিচ্ছেন কেউ কেউ। তেমনই একজন হলি ফ্লাওয়ার স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা প্রধান শিক্ষক কানাইলাল সমদ্দার শুভ্র। তিনি জানান, প্রথম দিকে তার প্রতিষ্ঠানটিতে প্রায় ৪শ শিক্ষার্থী ছিল। নানা কারণে ধীরে ধীরে তা কমে এক একশর নিচে এসে দাঁড়িয়েছে। তার এবছরই স্কুলটিকে বন্ধ করে দিচ্ছেন তিনি।

শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে এসব প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদ থাকেন কৌশলী। কম বেতনে ভাল শিক্ষক চান তারা। তাই বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানের নজরে থাকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করা শিক্ষার্থীরা। প্রচারকাজে এসব শিক্ষকদের ব্যাকগ্রান্ড ইতিবাচক ভূমিকা রাখে বলে মনে করে থাকে কর্তৃপক্ষ। তবে শিক্ষক হিসেবে ক্যারিয়ার শুরু করলেও এসব তরুণদের মূল লক্ষ্য থাকে ভাল কোনো চাকরি পাওয়া। তাই ভাল কোনো চাকরি হওয়া মাত্রই এসব ‘ব্যাকগ্রাউন্ড’ সম্পন্ন শিক্ষকরা আর থাকেন না সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে। এমনকী এক বছরে একই বিষয়ে একাধিক শিক্ষকও পরিবর্তন হন কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানে। এতে করে বিপাকে পড়েন শিক্ষার্থীরা।

অস্থির শিক্ষাখাত সুদৃষ্টি আসবে কবে
সরকারি শিক্ষাসেবাখাত বর্তমানে একটি অস্থির সময় পার করছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন সরকারি প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় এতটাই অপ্রতুল যে বেসরকারি খাতের অনিয়ম কমানো যাচ্ছেনা। উপরন্তু সরকারি বিভিন্ন ভুল সিদ্ধান্ত ও অস্বচ্ছ নীতিমালার কারণেও বেসরকারিখাতে অনিয়ম বাড়ছে। সংশ্লিষ্টরা এখনই সুদৃষ্টি না দিলে শিক্ষাখাতে বিপর্যয় নেমে আসতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন কেউ কেউ।
এ বিষয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও শিক্ষা গবেষক ড. রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, রাজধানীতে জনসংখ্যার তুলনায় সরকারি বিদ্যালয়ের সংখ্যা একেবারেই নগণ্য। এটাকে বেসরকারি উদ্যোক্তারা সুযোগ হিসেবে নিয়ে ইচ্ছেমত ব্যবসা করছেন। এ খাতে এখনই শৃঙ্খলা আনা না গেলে অবস্থা আরো ভয়াবহ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ওয়াহিদুজ্জামান সারাবাংলাকে বলেন, সরকারি খাতের চেয়ে শহর অঞ্চলে বেসরকারি পর্যায়ের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রতি সরকারের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। শিক্ষার মান ও অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য সরকার কাজ করছে।

দেড়লাখ শিশু ভর্তি হতে পারবে না পছন্দের স্কুলে

সারাবাংলা/এমএইচএস/এসঅাই

বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর