রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে প্রয়োজন শক্তিশালী কূটনৈতিক তৎপরতা
২৭ ডিসেম্বর ২০২০ ১৯:৪৭
ঢাকা: সমস্যাটি মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ। দেশটির সরকারি বাহিনী ও সেনাবাহিনীর অকথ্য নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার হয় দেশটির রাখাইন প্রদেশের লাখ লাখ রোহিঙ্গা নাগরিক। গত শতক থেকে শুরু হওয়া সেই সংকট যুগ যুগ ধরে বয়ে চলছে বাংলাদেশ। সবশেষ ২০১৭ সালে দেশটি থেকে ১০ লাখেরও বেশি নাগরিক এসে আশ্রয় নিয়েছেন বাংলাদেশে। এখন পর্যন্ত তাদের মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না।
সারাবাংলার সঙ্গে আলপকালে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া লাখ লাখ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে আগামী এক দশকেও হয়তো মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো যাবে না। আন্তর্জাতিক এই সংকটটি এখন বাংলাদেশের জন্য বড় সংকট হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই সংকট সমাধানে বাংলাদেশকে শক্তিশালী কূটনৈতিক তৎপরতা চালাতে হবে।
অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল এবং বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের প্রেসিডেন্ট আ ন ম মুনিরুজ্জামান সারাবাংলাকে বলেন, ‘এই সংকট কাটাতে যথার্থ উদ্যোগ নিয়ে বিশ্বের কেউই বাংলাদেশকে সমর্থন জানায়নি। সবাই মানবিক সহায়তার মধ্যে তাদের উদ্যোগ সীমিত রেখেছে। আমাদের বন্ধু রাষ্ট্র ভারত বা চীন, আঞ্চলিক জোট সার্ক বা আসিয়ানে বাংলাদেশের বন্ধুরাষ্ট্রদের কেউই সরাসরি বাংলাদেশকে সমর্থন করেনি।’
তিনি আরও বলেন, ‘এই ইস্যুতে বাংলাদেশের পক্ষে যে ধরনের কূটনৈতিক পদক্ষেপ আসা উচিত ছিল, তা আসেনি। রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে কূটনৈতিকভাবে বাংলাদেশকে শক্তিশালী অবস্থান নিতে হবে। কূটনৈতিক তৎপরতায় এখনো ঘাটতি রয়েছে।’
নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, ‘মিয়ানমার একটি জেনোসাইডাল স্টেট। মিয়ামারের জন্মলগ্ন বা ১৯৪৮ থেকেই তারা এমন। দেশটিতে তারা যেভাবে সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন চালাচ্ছে, সে হিসাবে মিয়ানমার ৭০/৭২ বছর ধরে একটি অস্থিতিশীল রাষ্ট্র।’
তিনি বলেন, ‘মিয়ানমার বলছে, রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেবে। কিন্তু নিচ্ছে না। মিয়ানমারের আচরণে ফিরিয়ে নেওয়ারও কোনো ইতিবাচক বিষয় দেখা যাচ্ছে না। তাই আমাদের কূটনৈতিক প্রচেষ্টা আরও শক্তিশালী করতে হবে। পাশাপাশি এই সংকট সমাধানে বিকল্প চিন্তা করতে হবে।’
এম সাখাওয়াত হোসেন আরও বলেন, ‘এই সংকট সমাধানের শেষ ধাপ হচ্ছে এক ধরনের সংঘর্ষে যাওয়া। কিন্তু বাংলাদেশে সেটাতে যাবে না। আবার বিভিন্ন দেশের সঙ্গে মিয়ানমারের শান্তি-সমঝোতাও হচ্ছে। তাই বাংলাদেশকে নিজেদেরই এক ধরনের চাপ প্রয়োগ করতে হবে। এ বিষয়ে সরকারের উচ্চ পর্যায়ের সিদ্ধান্ত নেয়া জরুরি।’
জানতে চাইলে সাবেক পররাষ্ট্র সচিব তৌহিদ হোসেন বলেন, ‘চলমান পরিস্থিতির নিরিখে যদি ধরে নেই যে রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান হচ্ছে, তবে তাতেও কমপক্ষে আরও ১০ বছর লাগবে। এমনকি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে সম্পৃক্ত করেও যদি আলোচনা চালিয়ে যাই, এর মধ্যে এমনকি যদি একটি রায়ও (আইসিসি ও আইসিজে’তে চলমান বিচার প্রক্রিয়া থেকে) আসে যে এই রেজিম (মিয়ানমারের ক্ষমতাসীনরা) জেনোসাইড করেছে, তারপরও আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি— এই ১০/১২ লাখ বা ততদিনে ১৫ লাখ রোহিঙ্গার নিজেদের বসত-ভিটেতে ফিরে যাওয়ার নিশ্চয়তা তৈরি হবে না। তবে হ্যাঁ, একটা চাপ তৈরি হবে মিয়ানমারের ওপর।’
তিনি বলেন, তারপরও আমি মনে করি— মিয়ানমারের রেজিমের যে ধরন, কিছু সংঘাত ছাড়া এই সমস্যার সমাধান (রোহিঙ্গা সংকট) হবে না। তাই আমাদের আরেক ধাপ এগিয়ে চিন্তা করা প্রয়োজন।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সাহাব এনাম সারাবাংলাকে খান বলেন, ‘বিভিন্ন দেশ মিয়ানমারকে বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করছে— সেটা অস্ত্র দিয়ে হোক আর গোলাবারুদ দিয়ে হোক। ভারত তো দিয়েই যাচ্ছে। বৈশ্বিক ফোরাম ইন্দো-প্যাসিফিকে যে চারটি দেশের কথা বলা হচ্ছে, তার মধ্যে রয়েছে ভারত, অস্ট্রেলিয়া, জাপন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। তবে এটা নিয়ে আমাদের এখনো স্বচ্ছ ধারণা আসেনি। সুতরাং বাংলাদেশকে রোহিঙ্গা বিষয় নিয়ে চিন্তা করতে হলে সামগ্রিক বিষয়গুলোই দেখতে হবে। আমাদের বিভিন্ন গ্রুপের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে নিজেদের সামর্থ্য বাড়াতে হবে।’
মিয়ানমার রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন রোহিঙ্গা সংকট