৭ মাস পর সংক্রমণের হার নেমেছে ১৬ শতাংশের নিচে
২৯ ডিসেম্বর ২০২০ ২৩:১৭
ঢাকা: বাংলাদেশে প্রথম নভেল করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) সংক্রমণ শনাক্ত হয় চলতি বছরের ৮ মার্চ। এরপর থেকে করোনাভাইরাসের নমুনা পরীক্ষার বিপরীতে বাড়তে থাকে শনাক্তের হার। তবে সম্প্রতি দেশে কোভিড-১৯ সংক্রমণের হার বিগত সময়ের তুলনায় কমেছে। নভেম্বর ও ডিসেম্বরের প্রথম ভাগে সংক্রমণের হার বাড়তে থাকলেও সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহ থেকেই মোট নমুনা পরীক্ষার বিপরীতে সংক্রমণের হার কমতে থাকে। একইসঙ্গে জুন মাসের পরে প্রথমবারের মতো দেশে কোভিড-১৯ সংক্রমণের হার ১৬ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে। বিশেষজ্ঞরা শনাক্তের বর্তমান হারকে করোনা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হিসেবে দেখছেন। তবে এতে ‘রিল্যাক্স’ না থেকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার দিকে জোর দিচ্ছেন তারা। জনগণের মাঝে সচেতনতা আরও বাড়াতে হবে বলেও জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
মঙ্গলবার (২৯ ডিসেম্বর) স্বাস্থ্য অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. নাসিমা সুলতানার সই করা দৈনিক স্বাস্থ্য সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, ২৪ ঘণ্টায় দেশে ১৪ হাজার ৫৮৮টি নমুনা পরীক্ষা করে এক হাজার ১৮১ জনের মাঝে কোভিড-১৯ সংক্রমণ পাওয়া গেছে। সে হিসাবে এদিন সংক্রমণ শনাক্তের হার ছিল ৮ দশমিক ১০ শতাংশ। আর এখন পর্যন্ত দেশে ৩১ লাখ ৯৯ হাজার ১১৫টি নমুনা পরীক্ষা করে ৫১ হাজার ২৬১ জনের মাঝে কোভিড-১৯ সংক্রমণ পাওয়া গেছে। মোট নমুনা পরীক্ষার বিপরীতে সংক্রমণের হার দাঁড়িয়েছে ১৫ দশমিক ৯৮ শতাংশ। ৪ জুনের ২০৮ দিন পর এই সংক্রমণের হার ১৬ শতাংশের নিচে নামলো।
মোট নমুনা পরীক্ষার বিপরীতে করোনা সংক্রমণের হার
দেশে ৮ মার্চ প্রথমবারের মতো করোনা সংক্রমণের পরে রোগীর সংখ্যা বাড়তে থাকে এপ্রিল মাস থেকে। ৯ এপ্রিল দেশে প্রথমবারের মতো শতাধিক (১১২ জন) সংক্রমণ শনাক্ত হয়। ওই দিন দেশে প্রথমবারের মতো দৈনিক সংক্রমণের হার দুই অঙ্কে (১২ দশমিক ৩৮ শতাংশ) পৌঁছে। নমুনা শনাক্তের বিপরীতে মোট সংক্রমণের হার প্রথমবারের মতো ১০ শতাংশের ওপরে যায় ১৮ এপ্রিল। পরবর্তী সময়ে এই হার বাড়তে থাকে। ৩০ মে দেশে মোট নমুনা পরীক্ষার বিপরীতে সংক্রমণের হার ১৫ শতাংশ অতিক্রম করে। ওই দিন থেকে ৩ জুন (১৫ দশমিক ৯৫ শতাংশ) পর্যন্ত মোট নমুনা পরীক্ষার বিপরীতে সংক্রমণের হার ১৫ শতাংশের বেশি ছিল। ৪ জুন দেশে মোট নমুনা পরীক্ষার বিপরীতে সংক্রমণের হার ১৬ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়। সংক্রমণের এই হার ২০ শতাংশ অতিক্রম করে গত ২৩ জুলাই। ৫ সেপ্টেম্বর থেকে দেশে মোট নমুনা পরীক্ষার অনুপাতে সংক্রমণের হার ২০ শতাংশের নিচে নামতে থাকে।
সাপ্তাহিক সংক্রমণ হার বিবেচনায় দেখা যায়, দেশে করোনা সংক্রমণের ষষ্ঠ সপ্তাহে (১২ এপ্রিল থেকে ১৮ এপ্রিল) সংক্রমণের হার ১২ দশমিক ৯১ শতাংশে পৌঁছায়। পরে এই হার বাড়তে থাকলেও ৪১তম সপ্তাহে (১৩ ডিসেম্বর থেকে ১৯ ডিসেম্বর) এসে সংক্রমণের হার ৯ দশমিক ৮৪ শতাংশে নেমে আসে। এই সপ্তাহে এক লাখ পাঁচ হাজার ৪৮২ জনের নমুনা পরীক্ষা করে ১০ হাজার ৩৮২ জনের মাঝে কোভিড-১৯ সংক্রমণ শনাক্ত হয়। সংক্রমণের এই হার আরও কমে আসে ৪২তম সপ্তাহে (২০ ডিসেম্বর থেকে ২৬ ডিসেম্বর)। এই সপ্তাহে ৯৬ হাজার ৮৯৬টি নমুনা পরীক্ষা করে আট হাজার ৫৩৯ জনের মাঝে কোভিড-১৯ সংক্রমণ শনাক্ত করা হয়। এই সপ্তাহে সংক্রমণের হার ছিল ৮ দশমিক ৮১ শতাংশ পাওয়া যায়। এই ৪২তম সপ্তাহে এসে সংক্রমণের হার কমে গিয়ে প্রথমবারের মতো ১৮ এপ্রিলের আগের সময়ে ফেরত আসে। আর আজ মঙ্গলবারসহ সবশেষ সপ্তাহে (২৩ ডিসেম্বর থেকে ২৯ ডিসেম্বর) ৯২ হাজার ৬২১ পরীক্ষার বিপরীতে শনাক্ত ছিল ৭ হাজার ৭৬০ জন। এ সপ্তাহে সংক্রমণের হার ৮ দশমিক ৩৭ শতাংশ।
বিশেষজ্ঞরা যা বলছেন
স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এবং বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) কার্যকরী সদস্য ডা. মোশতাক হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, দেশে বর্তমানে দৈনিক হিসাবে যদি দেখা যায়, সংক্রমণের হার কিন্তু কম দেখা যাচ্ছে। একইসঙ্গে সার্বিকভাবে মোট নমুনা পরীক্ষার অনুপাতেও সংক্রমণের হার কমে আসছে। এখানে সংক্রমণের হার কমছে, কারণ শনাক্তের সংখ্যা কিন্তু কমে আসছে। পরিস্থিতি বিবেচনায় পরিসংখ্যানগত দিক দেখে বলা যায় আমাদের পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে। কিন্তু এক্ষেত্রে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রিণে আছে ভাবা যাবে না। কারণ যেকোনো সময় এই পরিসংখ্যান পাল্টাতেও পারে। সংক্রমণ শনাক্তের হার যদি পাঁচ শতাংশের নিচে নেমে কয়েক সপ্তাহ অবস্থান করে, তবে সেক্ষেত্রে হয়তো বলা যায় পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশে কিন্তু এখন সংক্রমণ হার নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রশাসনিকভাবে অনেক ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। মাস্ক পরা বিষয়ে সরকারিভাবে ‘নো মাস্ক, নো সার্ভিস’ ক্যাম্পেইন চালু করা হয়েছে। এ কারণে মাস্কের ব্যবহার আগের তুলনায় বেড়েছে— এটা অস্বীকার করার উপায় নেই। মাস্ক পরার কারণে সংক্রমণের হার হয়তো কমে আসছে। তবে এখনো আমাদের রিল্যাক্স থাকার কোনো সুযোগ নেই।
ডা. মুশতাক আরও বলেন, আমাদের দেশের প্রান্তিক পর্যায়েও যদি সম্ভব হয়, তবে সামাজিকভাবে আইসোলেশনের সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে, যেন মানুষ সামাজিকভাবে হেয় হওয়ার ভয় কাটিয়ে উঠে নমুনা পরীক্ষা করানোর জন্য আরও আগ্রহী হয়ে ওঠে। কারণ বাস্তবতা হলো— আমাদের দেশের এখনো একটা বিশাল অংশ কিন্তু সামাজিকভাবে হেয় হওয়ার ভয়ে কোভিড-১৯ সংক্রমণ শনাক্তকরণ পরীক্ষায় নিরুৎসাহিত হচ্ছে। তাই প্রাতিষ্ঠানিকভাবে চিকিৎসা সেবা বাড়ানোর পাশাপাশি আমাদের আইসোলেশন ও কোয়ারেনটাইনের ব্যবস্থা করতে হবে। মানুষকে যদি আস্থায় নেওয়া যায়, তখন সময়মতো নমুনা পরীক্ষা করে হাসপাতালে চিকিৎসাব্যবস্থা নিশ্চিত করা গেলে মৃত্যুর হারও কমে আসবে।
আইইডিসিআরের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. এ এস এম আলমগীর সারাবাংলাকে বলেন, আমাদের দেশে সংক্রমণের সংখ্যা যদি বিবেচনা করা হয় তবে দেখা যাবে রাজধানীতেই বেশি পরিমাণ শনাক্ত হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে সরকার ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়সহ স্বাস্থ্য অধিদফতরের নানামুখী উদ্যোগে রাজধানীতে মাস্কের ব্যবহার বেড়েছে। স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণে সরকারি প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানেও নানা ধরনের কর্মসূচি নেওয়া হচ্ছে। এক্ষেত্রে বলা যায় মাস্ক ব্যবহারের কারণে দৈনিক শনাক্তের সংখ্যা কিন্তু কমছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে— শনাক্তের হার শতকরা পাঁচ শতাংশের নিচে নেমে এলে সেটিকে স্থিতিশীল বা সহনীয় পর্যায় বলা যেতে পারে। এ হিসাবের কথা উল্লেখ করে ডা. আলমগীর বলেন, আমরা কিন্তু এখনো সেখানে পৌঁছাতে পারিনি। তাই রিল্যাক্স হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এ ক্ষেত্রে মাস্ক পরাসহ অন্যান্য স্বাস্থ্যবিধি আমাদের মেনে চলতেই হবে। ভ্যাকসিনের প্রয়োগ করার পরও কিন্তু আমাদের মাস্ক পরার অভ্যাস ধরে রাখতে হবে। একসময় দেশে সবাই ভাবছিল শীতকালে সংক্রমণের হার বাড়বে। কিন্তু মাস্ক ব্যবহারের কারণে সেটা কিন্তু তেমন হয়নি। একইসঙ্গে নমুনা পরীক্ষা বিষয়ে আগে যে স্টিগমা ছিল, সেটিও কিছুটা কমে আসছে হয়তো। তাই মানুষ নমুনা পরীক্ষা করাচ্ছে।
দেশে কোভিড-১৯ নিয়ন্ত্রণে গঠিত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্য এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সাবেক উপাচার্য ও ভাইরোলজি বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, দেশে গত দুই সপ্তাহের পরিসংখ্যান লক্ষ করলে দেখা যায় সংক্রমণের হার কমছে। প্রতিদিনের হিসাবেই নমুনা পরীক্ষার বিপরীতে শনাক্তের হার কমছে। এর প্রভাবে মোট নমুনা পরীক্ষার বিপরীতে সংক্রমণের হার কমে আসছে। এটা ভালো দিক। তবে এই পরিসংখ্যানেও ‘রিল্যাক্স’ থাকার সুযোগ নেই বলে মত এই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরও।
তিনি বলেন, শীতকালে নানা রকমের রেসপিরেটরি ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা সবসময়ই থাকে। ইনফ্লুয়েঞ্জা, প্যারা-ইনফ্লুয়েঞ্জা, রাইনোভাইরাস ও রেসপিরেটরি সিনসিটিয়ার ভাইরাসের মতো প্রায় একই প্রজাতির হলো করোনাভাইরাস। মানুষের শরীরে যদি এ চার ভাইরাসের কোনো একটাও প্রবেশ করে, তবে সেটির একই ধরনের অন্য ভাইরাসকে শরীরে প্রবেশে বাধা দেওয়ার প্রবণতা থাকে। আর যদি প্রবেশ করেও থাকে, সেটি বেশিদিন শরীরে থাকে না। এই রেসপিরেটরি ভাইরাসগুলোতেই কিন্তু আমাদের দেশে অনেকে আক্রান্ত হয়ে থাকে, যার মধ্যে শিশুরা বেশি ঝুঁকিতে থাকে। হতে পারে, এসব রেসপিরেটরি ভাইরাসের কোনো একটির উপস্থিতির কারণে এখনো অনেকে করোনা আক্রান্ত হয়নি।
মাস্ক পরার প্রবণতা বাড়লেও একে আরও বাড়ানোর পক্ষে মত দেন ডা. নজরুল। তিনি বলেন, এটি যত বাড়বে তত ভালো। কারণ সামনের দিনগুলোতে যখন স্কুল খোলার সিদ্ধান্ত হবে, তখন এর গুরুত্ব আরও বেড়ে যাবে। বিশ্বব্যাপী কোথাও কিন্তু এখনো ১৮ বছরের কম বয়সীদের ওপর ভ্যাকসিনের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল হয়নি। ফলে দেশে করোনার ভ্যাকসিন এলেও শিশু-কিশোর-তরুণদের করোনা প্রতিরোধে মাস্ক পরার অভ্যাস বাড়াতেই হবে। পাশাপাশি অন্যদেরও স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে। অসুস্থ বোধ করলেই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়াটাও জরুরি, যেন প্রাথমিক পর্যায়েই চিকিৎসা শুরু করা যায়।